প্রিন্ট সংস্করণ
০০:০০, ১১ অক্টোবর, ২০২৫
নিঃস্ব, গরিব গো-বেচারা ফকির। দারিদ্র্যের কষাঘাতে দুঃখের ঘানি টেনে ক্লান্ত। কোথাও কারও সাহায্য পাওয়ার আশা নেই। তার একমাত্র ভরসা আল্লাহতায়ালা। আল্লাহর কাছে দোয়া করে, নামাজে মোনাজাতে আর্তি জানায়, প্রভু হে, অগতির গতি। ওহে বিশ্বপতি। অগণিত সৃষ্টির জীবন-জীবিকার জোগানদাতা। তুমি আমাকে সৃষ্টি করেছ নিজের দয়ায়। আমার কোনো চেষ্টা বা চাওয়া ছিল না আমার সৃষ্টির বেলায়। এখনও চাই, তুমি আমাকে রিজিক দাও বিনা চেষ্টায়। কাজ করব না, শুধু তোমার রহমতের ওপর বাঁচতে চাই। তোমার কাছে আমার এই আবদার অমূলক নয়। তুমি না চাইতে অগণিত নেয়ামতে ভরে দিয়েছ আমাকে। শরীরে অঙ্গপ্রত্যঙ্গ দিয়েছ। শরীরের শোভা মাথা দিয়েছ। মাথার অলঙ্কার পাঁচটি রত্নভান্ডার, পঞ্চেন্দ্রিয়। মুখে স্বাদ, চোখে দৃষ্টিশক্তি, কানে শ্রবণশক্তি, নাকে ঘ্রাণশক্তি আর চামড়ায় ত্বকে দিয়েছ স্পর্শ অনুভূতি। এই পাঁচটি দান বাইরের। ভেতরে আলাদা আরও পাঁচটি ইন্দ্রিয় দিয়েছ। তা দিয়ে আমি ধারণা করি, চিন্তা করতে পারি, কল্পনার ফানুস উড়াই, জানা নানা তথ্য স্মৃতিতে ধারণ করতে পারি, আবেগে চালিত হই আর দিয়েছ অনুভব শক্তি।
এভাবে বছরের পর বছর ফকির দোয়া করে। বিগলিত প্রাণে কাকুতি-মিনতি করে আল্লাহর দরবারে। কখনও দোয়া কবুল হতে বা ফল প্রকাশ পেতে বিলম্ব হলে দোয়ার ব্যাপারে সে সন্দিহান হয়ে পড়ে। কিন্তু আল্লাহর পক্ষ থেকে অলক্ষে তাকে শক্তি জোগানো হয়। আবার ফিরে আসে দোয়ায়। পুনরায় আশায় তার বুক ভরে যায়। মনের কানে যেন কে বলে যায়, প্রতিমুহূর্তে আল্লাহর দুটি শান। খাফেজ ও রাফে। খাফেজ মানে যিনি কাউকে নিচে নামান, রাফে মানে যিনি কাউকে ওপরে উঠান। অথবা অর্থ যিনি কমান ও বাড়ান। উভয়ই আল্লাহর গুণবাচক নাম।
এতসব চিন্তার মাঝে ফকির একদিন স্বপ্ন দেখে। স্বপ্ন কিসের। সুফির কাছে তো স্বাভাবিক অবস্থাতেই হাকিকতের অনেক বিষয় উদ্ঘাটিত হয়। গায়েবি আওয়াজে বলা হলো, তোমার প্রতিবেশি কাগজ বেপারি, তার পরিত্যক্ত কাগজের মাঝে খুঁজে দেখ, এই রং ও সাইজের একটি কাগজ আছে। সাবধান, কেউ যেন টের না পায়। কাগজটি পাওয়ার পর নির্জনে গিয়ে পড়ে দেখবে। সজাগ থাকবে, কেউ যেন না দেখে। অবশ্য দেখলেও ভয় নেই। এই কাগজ সুফল দেবে না তুমি ছাড়া অন্য কারও বেলায়। তোমার মনোবাঞ্ছা পূরণ হতে বিলম্ব হলে মন খারাপ করো না। আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হয়ো না।
নিদ্রায় গায়েবি জগতের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন হলে ফকির জেগে উঠে প্রফুল্ল মনে। গুপ্তধন পাওয়ার বেসামাল আনন্দে সে প্রতিবেশীর বইয়ের দোকানে যায়। কাগজ কেনার ভান করে কাগজপত্র ওলটপালট করতে থাকে। হঠাৎ তার নজর কাড়ে স্বপ্নে দেখা গুপ্তধনের তথ্যলেখা সেই কাগজটি। লেখাটি লুফে নিয়ে বগলদাবা করে দোকাানিকে বলে, খোদা হাফেজ, আল্লাহ আপনার মঙ্গল করুন, আবার আসব আমি। দ্রুত নির্জনে গিয়ে কাগজটি খুলে নিমিষে পড়ে ফেলে। হ্যাঁ, হুবহু সেই কাগজ। আল্লাহর দরবারে হাজার শোকর। আল্লাহ সবসময় মানুষের সহায়। গুপ্তধনের তথ্যলেখা সেই গঞ্জনামায় লেখা রয়েছে, এই শহরের বাইরে একজন বুজুর্গের কবর আছে। সেই কবরের ওপর একটি গম্বুজ (দরগাহ) আছে। গম্বুজের একটি দরজা শহরের দিকে, আরেকটি দরজা খোলা মাঠের দিকে। তুমি গম্বুজটি পেছনে রেখে কেবলামুখি হয়ে দাঁড়াবে। তারপর একটি ধনুক হাতে তীর নিক্ষেপ করবে। তোমার তীর যেখানে পড়বে সেখানে খনন করলে গুপ্তধন পেয়ে যাবে।
চোন ফগন্দি তির আজ কুস আই সুআদ
বরকন আন মওজা কে তিরত উফতাদ
যখন ছুঁড়বে ধনুক হতে তীর ওহে ভাগ্যবান
যেখানে তীর পতিত হবে কর সেখানে খনন।
ফকির একটি ধনুক নিয়ে এলো মজবুত, তারপর শুরু হলো ধনুকের তীর নিক্ষেপণ। প্রতিদিন একই স্থানে দাঁড়িয়ে তীর নিক্ষেপ করে, তারপর তীর পতনের জায়গা খনন করে। তার ধারণা, আমার স্বপ্ন মিথ্যা হতে পারে না। আমার নিক্ষিপ্ত তীরই ঠিক করতে পারছে না নিশানা। প্রতিদিন তার অবস্থা দেখে লোকেরা সন্দেহপ্রবণ হয়। এ খবর তারা দেশের বাদশাহর কাছে জানায়। বাদশাহ লোক পাঠিয়ে তাকে তলব করে। বহুবার চেষ্টায় ব্যর্থ বিরক্ত ফকির গঞ্জনামাটি বাদশাহর কাছে দিয়ে বলে, আমি অনেক চেষ্টা করেছি, আমার ভাগ্যে জুটেনি, হয়তো আপনার ভাগ্য সুপ্রসন্ন হবে।
বাদশাহ দেশের দক্ষ তীরান্দায নিয়োগ দিয়ে তীর নিক্ষেপণ আর খননকার্য চালান। দীর্ঘ ছয় মাস অভিযান শেষে বাদশাহও ব্যর্থ ক্লান্ত হয়ে পড়ে। মাঠের প্রতি গজ মাটিতে বাদশাহ খননকাজ চালায়। শেষ পর্যন্ত গঞ্জনামাটি ফকিরের দিকে ছুঁড়ে দিয়ে বলেন, এসব বাজে কাগজ তোমার মতো বেকার লোকের জন্য। গুপ্তধন পেলে তোমার তো লাভ হবে। যদি না পাও তোমার ম্মানে লাগবে না। কাজেই হতাশার কারণ নেই। মওলানা রুমি (রহ.) বলেন,
আকল রাহে না উমিদি কেই রওয়াদ
এশক বাশদ কান তরফ বর সার দাওয়াদ
বুদ্ধি যাবে না নিরাশা যেখানে, সাহস নাই
প্রেমই ঝাপ দেয় লাভণ্ডক্ষতির তার চিন্তা নাই। (১৯৬৬)
যার আকল-বুদ্ধি প্রখর, সবকিছুতে বৈষয়িক হিসাব-নিকাশ নিয়ে চলে, সে যেদিকে লাভ দেখে সেদিকেই পা বাড়ায়। যেখানে লাভের আশা নেই, সেখানে সে নেই। কিন্তু-
লা উবালি এশক বাশদ নাই খেরাদ
আকল আন জুয়দ কাজ আন সুদি বরদ
প্রেমের গতি বেপরোয়া বুদ্ধি নয় সেরূপ
বুদ্ধি কেবল খোঁজে কোথায় লাভের যোগ।
ফকির ছিল প্রেমের রোগে আক্রান্ত। দুনিয়ার লাভণ্ডক্ষতির হিসাব তার কাছে নেই। তাই বারবার ব্যর্থ হয়েও বাদশাহর মতো নিরাশা তাকে আক্রান্ত করে না। সে আশেক তাই তার বিশ্বাস, মাশুক অনর্থক তার মনে আশার সঞ্চার করেননি। অতএব, মহান প্রেমিকের স্মরণই তার জপনা, তার আদেশ পালনই জীবন সাধনা।
পাক মি বাজদ নবাশদ মোজদজু
আনচুনান কে পাক মি গিরদ যে হু
আশেক সবকিছু বিলায় মাশুকের পথে, চায় না মজুরি
নিষ্পাপ প্রাণ যেভাবে পেয়েছে সেভাবেই দেয়ার বাহাদুরি। (১৯৭০)।
প্রেমিক সবকিছু মহান প্রেমাষ্পদের পথে উজাড় করে। তার জন্য কোনো বিনিময় বা মজুরি চায় না সে। নিজের প্রাণ যেভাবে পবিত্র, নিখাদ, নিষ্পাপরূপে আল্লাহর কাছ থেকে পেয়েছে, সেভাবে মজুরি, বিনিময়, স্বার্থ উদ্দেশ্য বা লাভণ্ডক্ষতির হিসাব থেকে পুতপবিত্ররূপে প্রেমাষ্পদের কাছে ফেরত দিতে চায়।
জাংকে মিল্লত ফজল জুয়াদ বা খেলাস
পাকবাজান আন্দ কুরবানানে খাস
ধার্মিকদের ইবাদত সওয়াবের লোভে দোজখের ভয়ে
প্রেমিক প্রাণবাজি রাখে প্রেমাষ্পদের সান্নিধ্যের আশে।
বাদশাহ গঞ্জনামা ফকিরকে ফেরাত দেয়াতে লাভ হলো। দুশমনরা ফকিরের কাছ থেকে সরে গেল। তাদের কটাক্ষপাতের পথ বন্ধ হলো। এখন কারও তিরষ্কারের পরোয়া নেই।
তাকে যে আদেশ দেওয়া হয়েছে তা পালনে কোনো বাধা নেই। ফকিরের ধ্যানজ্ঞানে এখন তার স্মরণ, তার সাধনা প্রেমাষ্পদের আদেশ নিষেধ পালন। তার আর কেউ নেই। প্রেমই তার একমাত্র সাথী।
নিস্ত আজ আশেক কাসি দিওয়ানে তর
আকল আজ সওদায়ে উ কুর আস্তো কর
প্রেমিকের চেয়ে পাগল আর কেউ নেই
প্রেমের মর্ম বোঝার সাধ্য আকলের নেই।
ফকির এখন অনুশোচনা করে, প্রভু হে আমি অপরাধ করেছি। গুপ্তধন পেতে তাড়াহুড়া করেছি। আমার দোয়া সাথে সাথে কবুল হবে কেন- এমন মনোভাব দেখিয়ে অন্যায় করেছি। কাজেই যে দুয়ার তুমি বন্ধ করেছ তুমি নিজেই তা খুলে দাও। আমার মনে দোয়ার প্রেরণা, তোমারই দান। যেহেতু প্রেরণা দিয়েছ সেহেতু কবুল কর, এটিই আমার প্রার্থনা। এভাবে নানা কথায় দোয়ায় প্রেমিক ফকির ঘুমে আনমনা হলে গায়েবি আওয়াজ হলো, তোমাকে তো প্রথমেই বলা হয়েছিল, তুমি একটি ধনুকে তীর বসাও। বলা হয়নি তীর নিক্ষেপ কর। ফকির এবার তাই করল। যথানিয়মে ধনুকে তীর রেখে যেইনা দাঁড়াল, তীর খসে পড়ে গেল পায়ের কাছে। তাড়াতাড়ি সেখানে খনন করে দেখল যে, গুপ্তধন তার একান্ত কাছেই।
হ্যাঁ, তার খোঁজে কেন তুমি তোমার চিন্তার তীরকে দূরে দূরে নিক্ষেপ কর, ভেবে দেখ তিনি তোমার একান্ত নিকটেই আছেন। আল্লাহ বলেন, ‘আমার বান্দারা যখন আমার সম্বন্ধে আপনার কাছে জানতে চায়, (আপনি বলে দিন) আমি তো নিকটেই। আহ্বানকারী যখন আমাকে আহ্বান করে আমি তার আহ্বানে সাড়া দিই। সুতরাং তারাও আমার ডাকে সাড়া দিক এবং আমার ওপর ঈমান আনুক। যাতে তারা ঠিকপথে চলতে পারে।’ (সুরা বাকারা : ১৮৬)।
অনচে হক আস্ত আকরব আজ হাবলুল ওয়ারিদ
তো ফাকান্দে তীরে ফিকরাত রা বয়িদ
আল্লাহ তোমার নিকটে গর্দানের শাহরগের চেয়ে
তুমি চিন্তার তীর ছুঁড়েছ তিনি কিনা দূরের গাঁয়ে। (২৩৫৩)
আই কামান ও তীরহা বর সাখতে
গাইদ নজদিক ও তো দুর আন্দাখতে
ওহে যে ধারণ করেছ ধনুক তীর নিজের হাতে
শিকার নিকটে অথচ তুমি তীর ছুঁড় তফাতে।
ঘাকে দুর আন্দাজ তর উ দুর তর
ওজাজ চুনিন গাঞ্জাস্ত উ মাহজুরতর
যে চিন্তার তীর ছুঁড়বে দূরে সে দূরেই যাবে
অস্তিত্বে লুক্কায়িত গুপ্তধন থেকে বঞ্চিত রবে।
ফলসফি খোদ রা আজ আন্দিশা বকুশত
গু বেদু কুর আস্ত সুয়ে গাঞ্জ পুশত
দার্শনিক বাজে চিন্তাকলায় কতল করেছে নিজেকে
বলে দাও, দৌঁড়াতে পার, তবে ধনভাণ্ডা পশ্চাতে।
গু বেদু চন্দানকে আফজুন মি দাওয়াদ
আয মুরাদে দেল জুদাতর মি শাওয়াদ
দার্শনিককে বল, যত দৌড়াবে তুমি যুক্তির অশে^
প্রাণের মানুষ থেকে ততবেশি বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে।
জাহেদু ফিনা বগুফত আন শাহরিয়ার
জাহেদু আন্না নাগুফত আই বেকারার
আমার মধ্যে সাধনা কর, বলেছেন বিশ্বপতি
বলেননি আমায় ছেড়ে সাধনা কর, হে অস্থিরমতি। (২৩৫৮)
আল্লাহর নির্দেশ হলো, আমার মধ্যে, একান্ত আমার রাস্তায় সংগ্রাম সাধনা কর। তিনি বলেননি, আমায় ছেড়ে যাওয়ার সাধনা কর। কোরআনের আয়াতটি এমন- ‘যারা আমার উদ্দেশ্যে সংগ্রাম করে আমি তাদেরকে অবশ্যই আমার পথে পরিচালিত করব। আল্লাহ অবশ্যই সৎকর্মপরায়ণদের সঙ্গে থাকেন।’ (সুরা আনকাবুত : ৬৯; মওলানা রুমির মসনবি শরিফ, খণ্ড : বয়েত : ১৯০৮-২৩৫৮)।
(ড. মুহাম্মদ ঈসা শাহেদী রচিত মসনবি শরিফের গল্প ১-৬ খণ্ড প্রকাশ করেছে ছায়াপথ প্রকাশনী, মসজিদ বায়তুশ শরফ কমপ্লেক্স, ১৪৯/এ, এয়ারপোর্ট রোড, ফার্মগেট, ঢাকা। ফোন ০১৭১১১১৫৮২৯। মসনবির গল্পভিত্তিক আলোচনা শুনতে ইউটিউবে ভিজিট করুন- CHAYAPATH PROKASHONI)