প্রশাসনের কোনো ধরনের তদারকি না থাকায় পানিযুক্ত ট্রাকযোগে লবণ বোঝাই কারণে কক্সবাজার-চট্টগ্রাম মহাসড়ক ও টেকনাফের আঞ্চলিক সড়কে দুর্ঘটনা বাড়ছে। গত তেরো মাসে কক্সবাজার -চট্টগ্রাম মহাসড়ক ও টেকনাফ সড়কে ৮৭ জনের মৃত্যু হয়েছে। এতে আহত হয়েছে আরো ৮০ জন। পানিযুক্ত লবণ বোঝাই কারণে সড়ক পিচ্ছিল হয়ে শুধু দুর্ঘটনা নয়, কোটি টাকা ব্যয়ে সড়কের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতিও হচ্ছে। হাইওয়ে পুলিশের সামনে এইসব পানিযুক্ত লবণ বোঝাই গাড়ি চলাচল করলেও টাকা কারণে অনেকটা অন্ধ তারা। অনেকটা বিনাবাধায় পানিযুক্ত লবণ ট্রাকযোগে দেশের বিভিন্ন স্থানে সরবরাহ করা হচ্ছে।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, টেকনাফের হূীলা এলাকায় প্রধান সড়ক দখল করে পানিযুক্ত লবণ তুলা হচ্ছে ট্রাকে। ওই সব ট্রাক দেশের বিভিন্ন স্থানে যাচ্ছে। এতে করে লবণ-পানিতে নষ্ট হচ্ছে কক্সবাজার-টেকনাফ মহাসড়কের অন্তত ৮৬ কিলোমিটার অংশ। অনেক স্থানে কার্পেটিং উঠে গিয়ে সড়কে সৃষ্টি হচ্ছে ছোট-বড় গর্ত। কক্সবাজার-টেকনাফ সড়কের নীলা, খারাংখালী মিনাবাজারসহ বিভিন্ন এলাকায় গিয়ে দেখা গেছে, সড়কের ওপর ট্রাক দাঁড় করে মাঠে উৎপাদিত ভেজা লবণ বোঝাই করা হচ্ছে। এসব লবণ পরিবহনের সময় পলিথিন মোড়ানোর নির্দেশনা থাকলেও তা মানা হচ্ছে না।
লবণ ব্যবসায়ীদের সূত্র মতে, টেকনাফ-কক্সবাজার সড়কের জাদিমুরা, দমদমিয়া, লেদা, হ্নীলা, রঙ্গিখালী, হোয়াইক্যং, সাবরাং, নয়াপাড়া, কক্সবাজার সদরের ভারুয়াখালী, খুরুশকুল, ইসলামপুর ও চকরিয়া উপজেলার বিভিন্ন এলাকা থেকে প্রতিদিন অন্তত দুই শতাধিক ট্রাক বোঝাই করে শত শত মেট্রিক টন লবণ চট্টগ্রাম ও ঢাকায় সরবরাহ করা হচ্ছে।
কয়েকজন লবণ ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, লবণ ব্যবসায়ী জানান, ট্রাকের নিচে পলিথিন বিছিয়ে লবণ বোঝাই করলে সড়কে পানি পড়বে না, এটা ঠিক। কিন্তু পলিথিনের ওপর জমে থাকা পানিতে অর্ধেক লবণ গলে যায়, যার জন্য পলিথিন বিছানো হয় না।
কক্সবাজারের সড়ক ও জনপদ বিভাগের উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী মোস্তফা মুন্সী বলেন, লবণ-পানির কারণে কক্সবাজার-টেকনাফ ও চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কের প্রায় ২৭০ কিলোমিটারে ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে। সম্প্রতি কক্সবাজার-টেকনাফ সড়কের উনচি প্রাং পর্যন্ত কার্পেটিং কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে। উনচিপ্রাং থেকে টেকনাফ পর্যন্ত অংশে কোটি কোটি টাকার সংস্কার কাজ চলছে। কিন্তু লবণ-পানিতে ভিজে নতুন কার্পেটিং উঠে যাচ্ছে। এই বিষয়ে প্রশাসনের নজরদারি বাড়ানো দরকার।
টেকনাফের বাসিন্দা তাহের নঈম বলেন, লবণের পানিতে সড়ক পিচ্ছিল থাকার কারণে যানচলাচলে চরম বিগ্ন ঘটছে। অনেক সময় ৩০ মিনিটের পথে এক ঘণ্টা সময় পার হচ্ছে।
বিআরটিএ কক্সবাজার কার্যালয়ের মোটরযান পরিদর্শক মো. মামুনুর রশীদ দুর্ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করে বলেন, তেরো মাসে কক্সবাজার -চট্টগ্রাম মহাসড়ক ও টেকনাফ সড়কে ৮৭ জনের মৃত্যু হয়েছে। এতে আহত হয়েছে আরো ৮০ জন। শীত মৌসুমে এমনিতেই সড়ক পিচ্ছিল থাকে। অন্যদিকে পানিযুক্ত লবণ পরিবহনের কারনে দুর্ঘটনার কারণ বলে মন্তব্য করেন এই কর্মকর্তা।
রামু ক্রসিং হাইওয়ে থানা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. নাসির উদ্দীন বলেন,বিষয়টি নজরে এসেছে। পলিথিন ছাড়া কোনো লবণ বোঝাই ট্রাক পেলে ব্যবস্থা নেয়া হবে।
লবণ পরিবহনের প্রধান এলাকা টেকনাফের হোয়াইক্যং হাইওয়ে পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সুকান্ত চক্রবর্তীর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, বিষয়টি নজরে আসার পর, ইতিমধ্যে কয়েকটি পানিযুক্ত লবণ বোঝাই ট্রাককে মামলা দেয়া হয়েছে। এবং সতর্ক করা হয়েছে। অর্থ আদায়ের বিষয়টি অস্বীকার করেন তিনি।
বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশনের (বিসিকের) তথ্য অনুযায়ী, কক্সবাজার জেলার বিভিন্ন জায়গা থেকে দেশে লবণের চাহিদার ৮০ ভাগই মেটানো হয়। এবার জেলায় প্রায় ৭০ হাজার একর জমিতে লবণ চাষ হচ্ছে। লবণ উৎপাদনের নতুন লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ২৬ লাখ ১০ হাজার মেট্রিক টন। গত বছর ৬৮ হাজার ৫০৫ একর জমিতে লবণ উৎপাদিত হয়েছিল ২৪ লাখ ৩৮ হাজার মেট্রিক টন। যা বাণিজ্যিক লবণ উৎপাদন শুরুর পরবর্তী ৬২ বছরের সর্বোচ্চ রেকর্ড। এবারও শতভাগ জমিতে পলিথিন প্রযুক্তিতে ব্যবহার হচ্ছে। এ বিষয়ে চাষিদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। সনাতন পদ্ধতির তুলনায় পলিথিন প্রযুক্তিতে লবণ উৎপাদন আড়াই গুণ বেশি হয়। কক্সবাজার জেলার ৪৪ হাজার প্রান্তিক চাষি, ১ লাখ শ্রমিকসহ অন্তত ১০ লাখ মানুষ লবণ উৎপাদন, বিপণন, পরিবহণ ও ব্যবসার সঙ্গে জড়িত।