দেশের খাদ্য শস্যা ও মৎস্য ভাণ্ডার খ্যাত উত্তরাঞ্চলের প্রায় এক হাজার মাইল বিস্তীর্ণ জলাভূমির বৃহত্তম বিল চলনবিল দখল-দূষণে জৌলুস হারিয়ে সংকুচিত হয়ে পড়ছে। চলনবিলে বছরের সব সময়ই পানির প্রবাহ থাকত। রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে বর্তমানে বিলটি অতীত ঐতিহ্য হারিয়েছে। ফলে চলনবিল এলাকার প্রায় ৫০ লাখ মানুষের দৈনন্দিন জীবনযাত্রায় নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে।
জানা গেছে, উত্তরাঞ্চলের পাবনা, নাটোর ও সিরাজগঞ্জের প্রায় এক হাজার মাইল বিস্তীর্ণ এই বিলের পানি নদীর স্রোতের মতো চলন্ত বা গতিশীল ছিল বলে এর নামকরণ করা হয় চলনবিল। শুষ্ক মৌসুমে বিস্তীর্ণ এলাকা পরিণত হয় ফসলের মাঠে। চলনবিলের উৎপাদিত ধান দেশের খাদ্যনিরাপত্তায় বড় ভূমিকা রয়েছে। এক সময় এই বিলের মাছ দেশের চাহিদা পূরণ করে বিদেশেও রপ্তানি হতো। চলনবিলের সেই জৌলুস এখন আর নেই।
যুগে যুগে মানুষের বসতি, নানা উন্নয়ন কর্মকাণ্ডসহ দখল-দূষণে চলনবিল শুধু সংকুচিতই হয়নি, হারিয়ে ফেলছে তার চিরচেনা বৈশিষ্ট্য।
অধ্যক্ষ মোহাম্মদ আব্দুল হামিদ রচিত ১৯৬৭ সালে প্রকাশিত ‘চলনবিলের ইতিকথা’ গ্রন্থ থেকে জানা যায়, দুই হাজার বছর আগে চলনবিল নামে কোনো জলময় ভূভাগ ছিল না। তখন এ বিল ছিল সমুদ্রগর্ভে। কিছুকাল পর সমুদ্র চলনবিলকে জন্ম দিয়ে দক্ষিণে সরে যায়। পদ্মা ও যমুনা ধাত্রী রূপে শিশু চলনবিলকে ধারণ করে। খ্রিষ্টীয় তৃতীয় শতাব্দীতে চলনবিলের কোনো কোনো অঞ্চলে পলি জেগে ওঠায় লোকবসতি শুরু হয়। চতুর্থ ও পঞ্চম শতাব্দীতে গুপ্ত রাজাদের রাজত্বকালের নিদর্শন পাওয়া যায় চলনবিলে। বর্তমানে পাবনা জেলার চাটমোহর ও ভাঙ্গুড়া, নাটোরের সিংড়া, গুরুদাসপুর ও বড়াইগ্রাম এবং সিরাজগঞ্জ জেলার তাড়াশ, রায়গঞ্জ, উল্লাপাড়ার ও সলঙ্গা এ ৯টি উপজেলা জুড়ে চলনবিল অবস্থান করছে। দেশের বৃহৎ বিল চলনবিলের আয়তন কমার অন্যতম প্রধান কারণ নদীবাহিত পলি মাটি। নদীপথে প্রতি বছর ২২২ দশমিক ৫ মিলিয়ন ঘনফুট পলি চলনবিলে প্রবেশ করে। ৫৩ মিলিয়ন ঘনফুট পলি বিল থেকে বেরিয়ে যায়।
প্রতি বছর ১৬৯ দশমিক ৫ মিলিয়ন ঘনফুট পলি বিলে জমা হয়। এ ছাড়া বিলের মধ্য দিয়ে সড়কপথ, রেলপথ নির্মাণ, ব্রিজ, কালভার্ট, স্লুইসগেট, ইটভাটা, বাড়িঘর, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান স্থাপন, ময়লা-আবর্জনা জমে ও অবৈধ দখলের কারণে চলনবিল সংকুচিত হয়ে পড়ছে। এছাড়া স্থানীয় নদনদী, খাল ও বিল নাব্যতা হারিয়েছে। যার নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে চলনবিল এলাকার প্রায় ৫০ লাখ মানুষের দৈনন্দিন জীবনযাত্রায়।
‘চলনবিল রক্ষায় আমরা’ নামের একটি সংগঠনের সমন্বয়কারী জাহাঙ্গীর আলম জানান, একসময় এই এলাকার মানুষ কৃষি, ব্যবসা-বাণিজ্য, মৎস্য শিল্পসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে চলনবিলের পানির ওপর নির্ভরশীল ছিল। কিন্তু চলনবিল এখন মরা বিলে পরিণত হয়েছে। বিলের বিভিন্ন স্থানে নির্মিত স্লুইসগেট পানির প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করেছে। এক সময় এ বিলের পানিতে শুষ্ক মৌসুমে সেচকাজ হতো। নৌযোগাযোগ ব্যবস্থা ছিল। জমিতে ভালো ফসল উৎপাদন হতো। ব্যবসা-বাণিজ্যের অবস্থাও ভালো ছিল। সড়কপথ হওয়ায় মানুষ সড়কপথে পণ্য পরিবহণ করতে পারলেও তা ব্যয়বহুল। বর্তমান সময়ে চলনবিলের সব নদী বছরের অর্ধেকের বেশি সময় পানিশূন্য থাকে। এতে ব্যাহত হচ্ছে সেচকাজ, ফসল উৎপাদন। এরই মধ্যে বিলুপ্ত হয়েছে অনেক ফসল। মৎস্যভান্ডার খ্যাত চলনবিল আজ মাছশূন্য হওয়ার পথে। পানিস্বল্পতাসহ চায়না জাল, কারেন্ট জাল, স্বোতী জালসহ বিভিন্ন নিষিদ্ধ জালের ব্যবহার বাড়ায় বিভিন্ন প্রজাতির মাছ বিলুপ্ত হয়ে গেছে।
তিনি আরো জানান, চলনবিল এলাকার মানুষই ভুলতে বসেছে নদী, খাল, বিলের দেশি মাছের স্বাদ। খাদ্যশৃঙ্খল ভেঙে পড়ায় বিলুপ্ত হচ্ছে জীববৈচিত্র, প্রাণপ্রকৃতি। বছরের অধিকাংশ সময় বেকার সময় কাটান এ এলাকার প্রায় ৭৫ হাজার জেলে। বাধ্য হয়ে এরই মধ্যে পেশা পরিবর্তন করেছেন অনেকেই। চলনবিলে অতীত ঐতিহ্য রক্ষায় সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি উদ্যোগ গ্রহণ জরুরি বলে সচেতন মহল দাবি করেছেন।