পাবনার ঈশ্বরদী উপজেলায় নির্মিত দেশের সর্ববৃহৎ রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের প্রথম ইউনিট উদ্বোধনের অপেক্ষায় দেশ। তারই ধারাবাহিকতায় প্রথম ইউনিটের রিয়্যাক্টর কম্পার্টমেন্টের কন্টেইনমেন্ট (সুরক্ষা ব্যুহ) এর অভেদ্যতা ও দৃঢ়তার পরীক্ষা সম্পন্ন করেছে প্রকল্প সংস্থা। পরীক্ষায় নকশা অনুযায়ী কন্টেইনমেন্টের সর্বোচ্চ নিরাপত্তামান নিশ্চিত করা হয়েছে।
বুধবার (২৫ জুন) দুপুরে রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় পরমাণু সংস্থা রোসাটম একটি বেসরকারি বার্তা সংস্থার মাধ্যমে এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তি দিয়ে এ তথ্য জানিয়েছে। বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, পরীক্ষাকালে নকশা অনুযায়ী কন্টেইনমেন্টের অভ্যন্তরীণ চাপ বৃদ্ধি করা হয় এবং এর জন্য ব্যবহৃত হয় একটি উচ্চ ক্ষমতা সম্পন্ন কম্প্রেসার। এ সময় এই অবকাঠামোটির দৃঢ়তা ও অভেদ্যতার পরীক্ষা করা হয়। এর লক্ষ্য হলো কোনও অস্বাভাবিক পরিস্থিতিতে কন্টেইনমেন্টের ভেতরে চাপ বৃদ্ধি পেলে তা কতটুকু সহ্য করতে সক্ষম। পরমাণু জ্বালানি লোডিং এর পূর্বে এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষা। কারণ কোনও কাল্পনিক বিপর্যয় ঘটলে কন্টেইনমেন্টই হচ্ছে শেষ সুরক্ষা ব্যুহ।
কন্টেইনমেন্ট মূলত একটি অতি সুদৃঢ় কাঠামো, যা নির্মাণে ব্যবহৃত হয় প্রিস্ট্রেসড রিইনফোর্সড কংক্রীট এবং এর ভেতরের দেয়ালে থাকে একটি শক্ত ইস্পাতের আবরণ। এটির নকশা এমনভাবে করা হয় যাতে কোনও জরুরি পরিস্থিতিতে তেজস্ক্রিয় পদার্থ রিয়্যাক্টর কমপার্টমেন্টের বাইরে বের হতে না পারে। সমস্ত তেজস্ক্রিয় পদার্থ এই কন্টেইনমেন্টের ভেতরেই আবদ্ধ ও সুরক্ষিত অবস্থায় থাকতে পারে। বাহ্যিক বড় কোনও আঘাত ও বিপর্যয় রোধ করতে সক্ষম এই কন্টেইনমেন্ট বা সুরক্ষা ব্যুহ।
রূপপুর প্রকল্পের প্রথম ইউনিটে শীঘ্রই কিছু ‘হট মিডিয়া টেস্ট’ চালানো হবে। উদাহরণ স্বরূপ কুল্যান্ট সার্কিটকে নকশা অনুযায়ী নির্ধারিত তাপমাত্রায় উত্তপ্ত করা এবং বাষ্প উৎপাদন। অন্যান্য নিরাপত্তা প্যারামিটারগুলো চূড়ান্তভাবে পরীক্ষা করা হবে, যেমন সক্রিয় অবস্থায় বাষ্প নির্গমনকারী ডিভাইসের নিরাপত্তা।
বিজ্ঞপ্তিতে আরো বলা হয়, এই পরীক্ষার সময় বেশ কিছু অনাকাংখিত শব্দ তৈরি হবে যা সম্পূর্ণ পূর্ব নির্ধারিত। এ নিয়ে স্থানীয় জনসাধারণের আতংকিত হওয়ার কিছু নেই। কারণ প্রক্রিয়াটি সম্পূর্ণ নিরাপদ। রসাটম নিরাপত্তাকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে থাকে, তাই সংস্থাটির মূল লক্ষ্য হলো সকল নিরাপত্তা চাহিদা পূরণ।
রাশিয়ার আর্থিক ও কারিগরী সহায়তায় বাস্তবায়নাধীন রূপপুর পারমানবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পে দু’টি ৩+ প্রজন্মের ভিভিইআর-১২০০ চুল্লী স্থাপিত হয়েছে। প্রতিটির উৎপাদন ক্ষমতা ১,২০০ মেগাওয়াট। রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় সংস্থা রসাটমের প্রকৌশল বিভাগ জেনারেল কন্ট্রাকটর হিসেবে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে।
এদিকে ইতিমধ্যেই বিদ্যুতের জাতীয় গ্রিডের সঞ্চালন লাইনের সাথে সংযুক্ত হয়েছে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র। ২ জুন বিকেলে বিদ্যুৎ সরবরাহের এই সঞ্চালন লাইন সংযুক্তের কাজ সম্পন্ন হয়। ১৫ জুন এনার্জাইস (পরীক্ষা) করে বিদ্যুৎ সরবরাহ ত্রুটিমুক্ত কিনা নিশ্চিত হবে বলে প্রকল্প সূত্রে জানা গেছে।পিজিসিবি’র নির্বাহী প্রকৌশলী এনায়েত করিম জানান, রূপপুর-গোপালগঞ্জ ৪০০ কেভি সঞ্চালন লাইন সফলভাবে সংযুক্তের মধ্য দিয়ে বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিড সঞ্চালন সক্ষমতার মাইলফলক স্পর্শ করেছে। গত ২৯ মে এই কাজ শেষ হয়েছে বলে জানান তিনি। এর মাধ্যমে পারমাণবিক কেন্দ্রের বিদ্যুৎ বাংলাদেশের গ্রিডে সঞ্চালনের লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হলো। রূপপুর-গোপালগঞ্জ ৪০০ কেভি লাইনের দৈর্ঘ্য ১৫৮ কিলোমিটার (প্রায়) ও টাওয়ার সংখ্যা ৪১৪টি।
জানা গেছে, রূপপুর পারমাণবিকের বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে সঞ্চালনের জন্য ৪০০ কেভির চারটি এবং ২৩০ কেভির চারটি মোট আটটি লাইনের প্রকল্প হাতে নেয়া হয়। ৪০০ কেভির সঞ্চালন লাইনগুলো হলো: রূপপুর-বগুড়া, রূপপুর-গোপালগঞ্জ এবং ডাবল সার্কিটের রূপপুর-আমিনবাজার-কালিয়াকৈর। ২৩০ কেভির লাইনগুলো হলো: রূপপুর-বাঘাবাড়ি ডাবল কেভি এবং রূপপুর-ধামরাই ডাবল কেভির সঞ্চালন লাইন। ফিজিক্যাল স্টার্টআপের এর আগে আরও দুটি হাই-ভোল্টেজ লাইন প্রস্তুত করা হয়। ২০২২ সালের ৩০ জুন ‘রূপপুর-বাঘাবাড়ি ২৩০ কেভির ডাবল সঞ্চালন লাইন’ এবং ২০২৪ সালের ৩০ এপ্রিল ‘রূপপুর-বগুড়া ৪০০ কেভি সঞ্চালন লাইন’ চালু হয়। রূপপুর-গোপালগঞ্জ লাইন চালুর মধ্য দিয়ে মোট চারটি লাইন প্রস্ততের কাজ হলো, প্রতিটির সঞ্চালন সক্ষমতা ২ হাজার মেগাওয়াট।
৪০০ কেভির ডাবল সার্কিটের রূপপুর-আমিনবাজার-কালিয়াকৈর সঞ্চালন লাইন এবং ২৩০ কেভির ডাবল ডাবল সার্কিটের রূপপুর-ধামরাই সঞ্চালন লাইনের কাজ আগামী বছরে সম্পন্ন হবে বলে প্রকৌশলী এনায়েত করিম জানিয়েছেন।
এব্যাপারে নিউক্লিয়ার পাওয়ার গ্রিড কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক ড. জায়েদুল হাছান জানান, জাতীয় গ্রিডের এই সঞ্চালন লাইনের মাধ্যমে বিদ্যুৎ সরবরাহ এবং প্রয়োজনে বিদ্যুৎ সংগ্রহ করা যাবে। যে পর্যন্ত সঞ্চালন লাইনের কাজ শেষ হয়েছে তাতে ফিজিক্যাল র্স্টার্টআপের কাজ শুরু করা সম্ভব হবে বলে জানান তিনি।
এদিকে চলতি বছরের শেষ নাগাদ পাবনার ঈশ্বরদীর রুপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের প্রথম ইউনিট উদ্বোধন হতে যাচ্ছেন বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশে নিযুক্ত রাশিয়ার রাষ্ট্রদুত আলেকজান্ডার জি খোজিন। ১৫ জুন ঢাকায় রাশিয়া দিবস বলে আয়োজিত এক বিশেষ অনুষ্ঠানে তিনি এ কথা বলেন। তিনি আরো বলেন, রুশ ও বাংলাদেশি প্রকৌশলীদের যৌথ পরিশ্রমের ফলেই রুপপুর প্রকল্পের কাজ দ্রুত গতিতে এগিয়ে চলেছে। প্রথম ইউনিট চালুর প্রক্রিয়াও এখন চূড়ান্ত পর্যায়ে।