
‘গুরুমশায় বলেন তারে/বুদ্ধি যে নেই একেবারে/দ্বিতীয় ভাগ করতে সারা ছ’মাস ধরে নাকাল।’ রেগেমেগে বলেন, ‘বাঁদর, নাম দিনু তোর মাকাল।’ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শিশুতোষ ‘মাকাল’ কবিতায় অনুন্নত বালকটির পরিচয় তুলে ধরেছিলেন এভাবেই। উপমা থেকেই ফলটির নামকরণ।
মাকালের আদি নাম ছিল ‘মহাকাল’। সময়ের পরিক্রমায় এ নামটি হারিয়ে গিয়ে উপমাশ্রিত রূপ নিয়েছে। এর বৈজ্ঞানিক নাম Trichosanthes tricuspidata।
টকটকা লাল এ ফলটির ভেতর কালো ও তিতা হলেও এটি ওষুধি গুণসম্পন্ন। তবে বিপন্ন প্রকৃতিতে এর অস্তিত্ব এখন আরও সংকটে। পাঠ্যপুস্তকে মাকাল ফলের উল্লেখ থাকলেও বাস্তবে নতুন প্রজন্মের কাছে তা অচেনাই রয়ে গেছে।
দেখতে আপেলের মতো হলেও ভেতরে তিতা মাকাল কিশোরগঞ্জের আঞ্চলিক ভাষায় ‘কাওয়াজাঙ্গি’, ‘কাওয়াকাডি’ কিংবা ‘কাওয়াজিঙ্গা’ নামেও পরিচিত। একসময় এই জেলায় মাকালের বিষ ব্যাপকভাবে ব্যবহার হতো। কিন্তু পরিবেশ বিপর্যয়ে এটি এখন প্রায় বিলুপ্তির পথে।
মাকাল মূলত লতাজাতীয় বহুবর্ষজীবী উদ্ভিদ। বড় বড় গাছে আশ্রয় নিয়ে এ গাছ বেড়ে ওঠে এবং লম্বায় ৩০ থেকে ৪০ ফুট পর্যন্ত হয়। পাতার কক্ষে ফোটে সাদা ফুল। ফল দেখতে অনেকটা ডিমের মতো—কাঁচা অবস্থায় গাঢ় সবুজ, পরে হলুদ এবং পাকলে লাল। সাধারণত বর্ষাকালে ফুল ও ফল ধরে।
ভেষজ গুণে ভরপুর মাকাল গাছ। এর শিকড় কোষ্ঠকাঠিন্য ও বদহজমে কার্যকর। কফ ও শ্বাসকষ্ট নিরাময়ে, নাক ও কানের ক্ষতে ওষুধ হিসেবে ব্যবহৃত হয়। জন্ডিস, শ্লোথ রোগ, স্তনের প্রদাহ, প্রস্রাবের সমস্যা, বাতব্যথা, কাশি, শিশুদের অ্যাজমা চিকিৎসায়ও কার্যকর। বীজের তেল ব্যবহৃত হয় সাপ ও বিছার কামড়ে, আমাশয়-ডায়রিয়া, মৃগীরোগ নিরাময়ে, এমনকি সাবান তৈরিতেও।
এছাড়া চুলের বৃদ্ধি ও রং কালো করতেও এর বীজের তেল কার্যকর। মাকালের বীচি ও আঁশ শুকিয়ে গুঁড়ো করে পানিতে মিশিয়ে ফসলে প্রয়োগ করলে তা প্রাকৃতিক কীটনাশক হিসেবে কাজ করে। বহু যুগ ধরে কৃষকরা এটি ব্যবহার করে আসছেন।
বাংলাদেশের ঢাকা, ময়মনসিংহ, টাঙ্গাইল ও কিশোরগঞ্জের জঙ্গলে একসময় প্রচুর মাকাল গাছ দেখা যেত। কিন্তু গত এক যুগে এর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে পূর্বের মাত্র দশ ভাগের এক ভাগে। পরিবেশবিদদের আশঙ্কা, এভাবে চলতে থাকলে আগামী দশকেই দেশ থেকে চিরতরে হারিয়ে যাবে মাকাল ফল।
বিশেষজ্ঞরা জানান, প্রাকৃতিক বন উজাড় এবং দেশি-বিদেশি রাসায়নিক কীটনাশকের প্রভাবে এ ফল বিলুপ্তির পথে। বাজারেও আর পরিবেশবান্ধব মাকালের বিষের চাহিদা নেই।