ঢাকা শুক্রবার, ১২ ডিসেম্বর ২০২৫, ২৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

বাংলাদেশে ষষ্ঠ বিমূর্ত সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য টাঙ্গাইলের ‘শাড়ি বুনন শিল্প’

বাংলাদেশে ষষ্ঠ বিমূর্ত সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য টাঙ্গাইলের ‘শাড়ি বুনন শিল্প’

বাংলাদেশের ষষ্ঠতম বিমূর্ত সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃতি পেল ঐতিহ্যবাহী টাঙ্গাইলের শাড়ি বুনন শিল্প। ভারতের লাল কেল্লায় অনুষ্ঠিত ২০তম ইউনেস্কোর বিমূর্ত সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের আন্তঃসরকারি কমিটির অধিবেশনে আজ বাংলাদেশ সময় ... দিকে এই ঘোষণা করা হয়। ইউনেস্কোর বিমূর্ত সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য বিভাগ থেকে সর্বশেষ ২০২৩ সালে বাংলাদেশের ‘ঢাকা শহরের রিকশা ও রিকশাচিত্র’ ইউনেস্কোর ইনটেনজিবল কালচারাল হেরিটেজ হিসেবে স্বীকৃতি পায়।

মূলত বিশ্বের বিভিন্ন বিমূর্ত বা স্পর্শাতীত শিল্প সুরক্ষার্থেই এ স্বীকৃতি দেওয়া হয়। সারা বিশ্বের বিমূর্ত সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সুরক্ষার জন্য ইউনেস্কো ২০০৩ সালের কনভেনশনের ভিত্তিতে প্রতিবছর বিভিন্ন দেশের ঐতিহ্যকে বিশ্ব তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করে। প্রতিবছর ডিসেম্বর মাসের প্রথমভাগে ইউনেস্কোর বিমূর্ত সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের আন্তঃসরকারি কমিটির চূড়ান্ত সভা অনুষ্ঠিত হয়।

ইউনেস্কোর নিয়মানুযায়ী রাষ্ট্র পক্ষ হিসেবে সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের হয়ে ২০২৪ সালে বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর টাঙ্গাইলের শাড়ি বুননের নমিনেশন ফাইল তৈরি করেছিল। পরবর্তীতে ইউনেস্কোর আন্তঃসরকারি কমিটির সিদ্ধান্ত এবং বাংলাদেশের ইউনেস্কোস্থায়ী প্রতিনিধির পরামর্শ অনুযায়ী ফাইলটি সংশোধন ও তথ্যহালনাগাদ করে ১০ এপ্রিল ২০২৫ তারিখে চূড়ান্তভাবে ইউনেস্কোর স্বীকৃতির জন্য প্রেরণ করা হয়।

২০২৪ সালে টাঙ্গাইলের শাড়ি বুনন শিল্পকে ইউনেস্কোর ২০০৩ কনভেনশনের আর্টিকল–১২–এর অত্যাবশ্যকীয় শর্তানুযায়ী বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত বাংলাদেশের বিমূর্ত সংস্কৃতির অনলাইনভিত্তিক জাতীয় ইনভেন্টরিতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। ঐতিহ্যবাহী টাঙ্গাইলের শাড়ি বুনন শিল্পের স্বীকৃতির মধ্য দিয়ে টাঙ্গাইল শাড়ির দেশ হিসেবে আবারও বিশ্বমঞ্চে উজ্জ্বল হলো বাংলাদেশের নাম।

টাঙ্গাইলের শাড়ি বুনন শিল্প ঐতিহ্যগত কারুশিল্প উৎপাদনের জ্ঞান ও দক্ষতা—ট্রাডিশনাল ক্রাফটম্যানসিপ—ক্যাটাগরিতে লিভিং বিমূর্ত সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃতি অর্জন করেছে।

ইউনেস্কো প্রতিবছর পাঁচটি ক্যাটাগরিতে বিমূর্ত সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে বিশ্বের ঐতিহ্যের অংশ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। এর মধ্যে রয়েছে—মৌখিক ঐতিহ্য বা ওরাল ট্রেডিশনস অ্যান্ড এক্সপ্রেশনস, পরিবেশনা শিল্প বা পারফরমিং আর্টস, সামাজিক অনুশীলন, আচার-অনুষ্ঠান ও উৎসব (সোশ্যাল প্র্যাকটিসেস, রিচুয়ালস অ্যান্ড ফেস্টিভ ইভেন্টস), প্রকৃতি ও মহাবিশ্ব সম্পর্কিত জ্ঞান ও অনুশীলন, এবং ঐতিহ্যগত কারুশিল্প উৎপাদনের জ্ঞান–দক্ষতা।

এসব বিমূর্ত সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য আমাদের স্বকীয় রীতিনীতি ও জ্ঞান–দক্ষতায় গড়ে ওঠা এবং যা সাধারণত আমাদের পূর্বপুরুষদের কাছ থেকে উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত। বাংলাদেশে রয়েছে এমন অসংখ্য বিমূর্ত সাংস্কৃতিক উপাদানের ভান্ডার। দেশের আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে থাকা এসব ঐতিহ্যের সুরক্ষার বাধ্যবাধকতা ও গুরুত্ব উপলব্ধি করে বাংলাদেশ ইউনেস্কোর ২০০৩ কনভেনশন স্বাক্ষর করেছে।

ইতিমধ্যে বাউল গান (২০০৮), ঐতিহ্যবাহী জামদানি বুনন শিল্প (২০১৩), পহেলা বৈশাখের মঙ্গল শোভাযাত্রা (২০১৬), সিলেট অঞ্চলের শীতলপাটি বুনন শিল্প (২০১৭), ঢাকা শহরের রিকশা ও রিকশাচিত্র (২০২৩) এবং সর্বশেষ ঐতিহ্যবাহী টাঙ্গাইলের শাড়ি বুনন শিল্প—এই তালিকায় যুক্ত হলো।

বাঙালির আদিতম ঐতিহ্যের অংশ টাঙ্গাইলের তাঁতের শাড়ি। এই শাড়ির নির্দিষ্ট প্যাটার্ন ও মোটিফ একে অন্যান্য বুনন থেকে স্বতন্ত্র করেছে। টাঙ্গাইল অঞ্চলের ভৌগোলিক কারণেও এই শাড়ি ‘টাঙ্গাইলের শাড়ি’ নামে পরিচিত। এখানকার তাঁতিরা বিশ্বাস করেন, অঞ্চলের জলবায়ু এই শাড়ি তৈরির জন্য আশীর্বাদ স্বরূপ। টাঙ্গাইলের তাঁতিরা ছোটবেলা থেকেই পরিবারের সদস্যদের দেখে দেখে শাড়ি বুননের কৌশল রপ্ত করে।

টাঙ্গাইল শাড়ি বুননের প্রধান কারিগর বসাক ও জোলা সম্প্রদায়ের মানুষ। বসাকরা হিন্দু এবং জোলারা মুসলিম হলেও তাঁরা একই ঐতিহ্যের অংশীদার। এখানকার তাঁতিরা নান্দনিক নকশাযুক্ত সুক্ষ্ম শাড়ি ছাড়াও সেলোয়ার-কামিজ, গজ কাপড়, পাঞ্জাবিসহ বিভিন্ন কাপড় বুনে থাকে। টাঙ্গাইলের তাঁতিরা তাদের শাড়ির প্রতিটি অংশ সতর্কতার সাথে তৈরি করেন, যা বাংলাদেশের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক গল্পকে ফুটিয়ে তোলে।

একসময় বাংলাদেশের নারীদের নিত্যব্যবহারের প্রধান পোশাক ছিল টাঙ্গাইল তাঁতের শাড়ি। আশির দশকের পর থেকে এতে এসেছে নতুনত্ব, বৈচিত্র্য ও নকশার আধুনিকতা। আটপৌরে, উৎসব, পূজা–পার্বণ থেকে শুরু করে বিভিন্ন দিবসে আজও বাঙালি নারীর পছন্দের তালিকায় টাঙ্গাইল শাড়ি এক বিশেষ স্থান দখল করে আছে।

টাঙ্গাইলের পাথরাইল, চন্ডী ও আশপাশের এলাকায় প্রায় ৫০০ পরিবার এই শিল্পে জড়িত। তাঁতিরা পিট লুম (হস্তচালিত ঐতিহ্যগত তাঁত) ও চিত্তরঞ্জন তাঁত (যন্ত্রচালিত, জ্যাকোয়ার্ড প্রযুক্তিভিত্তিক) পদ্ধতিতে শাড়ি তৈরি করেন। সুতি শাড়ির পাশাপাশি তাঁরা তৈরি করেন সিল্ক, হাফসিল্ক, এ্যান্ডি, কৃত্রিম সিল্ক ও মাসলাইস কটন শাড়িও। নকশা ও রঙে টাঙ্গাইল শাড়ি বরাবরই বৈচিত্র্যময়।

ইউনেস্কোর বিমূর্ত সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য বিভাগ থেকে স্বীকৃতি পাওয়ায় টাঙ্গাইল শাড়ি বুনন শিল্পের সুরক্ষা ও সংরক্ষণের নতুন পথ উন্মুক্ত হলো। আন্তর্জাতিক এ স্বীকৃতি তাঁতিদের আরও উৎসাহী করবে এবং এই ঐতিহ্যকে এক প্রজন্ম থেকে আরেক প্রজন্মের কাছে পৌঁছে দিতে সাহায্য করবে।

বিশ্বব্যাপী টাঙ্গাইল শাড়ি বাংলাদেশের ব্র্যান্ডিংকে আরও শক্তিশালী করবে এবং টাঙ্গাইল শাড়ির দেশ হিসেবে বাংলাদেশকে নতুনভাবে চিনিয়ে দেবে।

কীপার (জনশিক্ষা বিভাগ), বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর

‘শাড়ি বুনন শিল্প’,টাঙ্গাইল,সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য,বাংলাদেশে ষষ্ঠ বিমূর্ত
আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত