
মানুষের জীবনে সুশিক্ষা ও মূল্যবোধ হলো দুইটি মূল স্তম্ভ, যার ওপর গড়ে ওঠে একটি পরিবার, একটি সমাজ এবং একটি রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ। মূল্যবোধের অবক্ষয় কোনো সমাজকে মুহূর্তেই দুর্বল করে দিতে পারে। পরিবারে অবহেলা, সামাজিক অবনতি, অপরাধ বৃদ্ধি কিংবা মানবিক সম্পর্কের শীতলতা—সব কিছুর মূলে থাকে নৈতিকতার এই ভাঙন। তাই ব্যক্তি পর্যায় থেকে শুরু করে সামগ্রিক জাতীয় পর্যায় পর্যন্ত মূল্যবোধকে ধারণ করা এখন সময়ের সবচেয়ে বড় দাবি।
আজকাল প্রায়ই দেখা যায়, বৃদ্ধ মা-বাবা সন্তানের অবহেলায় দুঃখময় জীবন কাটাচ্ছেন। টিভি স্ক্রিন কিংবা পত্রিকার পাতা উল্টালেই এ ধরনের বেদনাদায়ক দৃশ্য চোখে পড়ে। অথচ বাবা-মা হচ্ছেন সন্তানের জীবনের সবচেয়ে বিশ্বাসযোগ্য আশ্রয়স্থল, সবচেয়ে বড় আত্মত্যাগী মানুষ। তাদের মূল্যায়ন না করা শুধু অমানবিকই নয়, বরং এটি সমাজে দুর্ভাগ্যের বার্তা দেয়। যদিও কিছু পরিবারে ভালোবাসা, দায়িত্ববোধ ও শ্রদ্ধাবোধের সুন্দর উদাহরণ আছে, তবে তার সংখ্যা ক্রমশই কমছে। এ অবস্থার পরিবর্তনে প্রয়োজন সচেতনতা এবং পরিবারভিত্তিক নৈতিক শিক্ষার প্রসার।
গণমাধ্যমে কাজ করতে গিয়ে অসংখ্য মানুষের সঙ্গে কথা বলার সুযোগ হয়েছে। প্রায় সবার ভাষ্য, সমাজে মানবিক মূল্যবোধের সংকট দিন দিন বেড়েই চলছে। এর প্রধান কারণ শৈশবেই সঠিক শিক্ষা ও নৈতিকতার ভিত্তি শক্তভাবে গড়ে না ওঠা। যে বয়সে শিশুরা উদারতা, ভালোবাসা, শিষ্টাচার, সহমর্মিতা শিখবে—সে বয়সেই তারা অনেক সময় প্রতিযোগিতার অস্বাস্থ্যকর চাপের নিচে হারিয়ে যায়। ফলে বড় হয়ে তারা হয়ে ওঠে স্বার্থকেন্দ্রিক, অসহিষ্ণু ও কঠোর হৃদয়ের মানুষ।
মূল্যবোধ গঠনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ স্থান হলো পরিবার। গুড প্যারেন্টিং-এর মাধ্যমে শিশুকে ছোট থেকেই শেখাতে হবে—ভাগ করে খাওয়া, অন্যের প্রতি শ্রদ্ধা, মায়া-মমতা, বড়দের সম্মান এবং সত্য ও ন্যায়ের প্রতি অবিচল থাকা।
এক মায়ের গল্পটিই এ ক্ষেত্রে দারুণ শিক্ষণীয়। স্কুলগেটের সামনে ছেলেকে বললেন, “টিফিনটা কাউকে দিবি না।” পাশে থাকা বয়স্ক মানুষটি মন্তব্য করলেন, “আপনি তাকে স্বার্থপরতা শেখালেন। বড় হলে আপনাকেও অপ্রয়োজনীয় মনে করতে পারে আপনার সন্তান।”
এই গল্প আমাদের শেখায়, শুধু ভালো রেজাল্ট নয়, ভালো মানুষ হওয়াই বড় বিষয়। শিশুর মনে ভাগাভাগি, সহানুভূতি ও দায়িত্ববোধের বীজ বপন করা প্রয়োজন। শৈশবের অভিজ্ঞতাই পরবর্তীতে তাকে পূর্ণ মানুষ হিসেবে গড়ে তোলে।
পিতা-মাতা শুধু ভরণপোষণের জন্য নয়—শিশুর মানসিক বিকাশে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখেন। তাই শত ব্যস্ততার মাঝেও সন্তানদের সঙ্গে সময় কাটাতে হবে, তাদের কথা শুনতে হবে, অনুভূতি বুঝতে হবে, বন্ধুর মতো পাশে থাকতে হবে। সন্তান যেন মনে করে, বাবা-মাই তার জীবনের রিয়েল হিরো। ধর্মীয় শিক্ষা, বিশেষ করে কুরআনের আদেশ—“বাবা-মাকে সম্মান কর”—এই মূল্যবোধ শিশুর মধ্যে জাগ্রত করতে হবে।
অন্যদিকে, সন্তানরা বড় হয়ে যেন বৃদ্ধ মা-বাবাকে একাকিত্বে ফেলে না যায়, এটি নিশ্চিত করা প্রত্যেক পরিবারের দায়িত্ব। বাবা-মা কোনো বোঝা নন, তারা আমাদের জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ। সন্তান যদি সুশিক্ষিত, নৈতিক ও মানবিক মূল্যবোধসম্পন্ন হয়ে ওঠে, তবে সমাজে আর অমানবিক দৃশ্যের পুনরাবৃত্তি ঘটবে না।
সমাজে মূল্যবোধ পুনঃস্থাপনের পথ শুরু হতে হবে পরিবার থেকেই। সুশিক্ষা, ধর্মীয় চেতনা, নৈতিকতা এবং পরিবারে পারস্পরিক শ্রদ্ধা—এসবের সমন্বয়ে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম হবে আলোকিত ও দায়িত্বশীল।
আসুন, আমরা সবাই মিলেই আগামী প্রজন্মকে মানবিক, নৈতিক ও আদর্শ মানুষ হিসেবে গড়ে তুলি। সুশিক্ষা ও মূল্যবোধের আলোয় আলোকিত হোক আমাদের পরিবার, সমাজ ও দেশ।