ঢাকা রোববার, ১৪ ডিসেম্বর ২০২৫, ২৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

মহাকাশে শিশুর জন্ম কি আদৌ সম্ভব

মহাকাশে শিশুর জন্ম কি আদৌ সম্ভব

মঙ্গল গ্রহে মানব অভিযানের পরিকল্পনা করছে বিশ্বের বিভিন্ন মহাকাশ সংস্থা। যার সঙ্গে সঙ্গে উদ্বেগ দেখা দিয়েছে মহাকাশে মানুষের প্রজনন নিয়ে। মঙ্গলে যাওয়া ও ফিরে আসার পুরো সময়টা একটি মানব গর্ভকালের সমান হতে পারে। ফলে স্বাভাবিকভাবেই যে প্রশ্নটি এখন ঘুরপাক খাচ্ছে, তা হল, মহাকাশে গর্ভধারণ ও নিরাপদভাবে সন্তান জন্ম দেওয়া আদৌ সম্ভব কি না। বিজ্ঞানবিষয়ক সাইট ‘সায়েন্স অ্যালার্ট’ প্রতিবেদনে লিখেছে, মাধ্যাকর্ষণের কারণে মহাকাশে গর্ভধারণ শারীরিকভাবে কঠিন হতে পারে। তবে একবার ভ্রূণ জরায়ুতে বসানো গেলে মহাকাশে গর্ভাবস্থা পৃথিবীর মতোই সাধারণভাবে চলবে। তবে নবজাতকের জন্ম ও যত্নের বিষয়টি শূন্য মাধ্যাকর্ষণ পরিবেশে অনেক বেশি জটিল। বিজ্ঞানী অরুন ভি. হোল্ডেন তার গবেষণায় বলেছেন, মহাকাশে মাধ্যাকর্ষণ না থাকায় তরল পদার্থ ও মানুষ ভেসে থাকে। ফলে সন্তানপ্রসব ও শিশুর যত্ন নেওয়ার কাজটি জটিল হয়ে ওঠতে পারে। যেসব কাজ পৃথিবীতে সহজ, যেমন শিশুকে ঠিকভাবে ধরে রাখা, খাওয়ানো সেগুলো মাধ্যাকর্ষণের অভাবে মহাকাশে অনেক কঠিন।

বিস্ময়কর বিষয় হচ্ছে, গর্ভে থাকা একটি ভ্রূণ এরইমধ্যে মাধ্যাকর্ষণের মতো এক পরিবেশে বড় হতে থাকে। ভ্রূণটি ‘এমনিওটিক’ তরলের ভেতরে ভেসে থাকে, যা ভ্রূণকে ভাসিয়ে রাখে ও বাইরের ধাক্কা থেকে সুরক্ষা দেয়। এই ভেসে থাকার অবস্থা অনেকটা সেই ওজনহীন অবস্থার মতোই, যেটি নভোচারীরা মহাকাশে অনুভব করেন। গবেষকরা বলছেন, নভোচারীরা মহাকাশে হাঁটার প্রশিক্ষণ পান পানির ট্যাংকের মধ্যে, যেখানে মাধ্যাকর্ষণের মতো পরিবেশ তৈরি করা হয়। এ বিষয়টিও অনেকটা গর্ভের ভেতরের পরিবেশের সঙ্গে মেলে। তবে এখানে কেবল মাধ্যাকর্ষণের অভাবই সমস্যা নয়, বরং অন্য অনেক জটিল বিষয়ও রয়েছে। পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের বাইরে এক ভয়ংকর হুমকি হচ্ছে কসমিক রে বা মহাজাগতিক রশ্মি। এসব রশ্মি হচ্ছে খুব উচ্চ-শক্তির কণা বা পরমাণুর কেন্দ্র অর্থাৎ নিউক্লিয়াস, যেগুলো থেকে ইলেকট্রন সরে যায় ও প্রায় আলোর গতিতে মহাকাশে ছুটে চলে।

গবেষকরা বলছেন, এসব কণিকা প্রোটন ও নিউট্রন দিয়ে তৈরি এবং খুব ঘন। এগুলো যখন মানুষের দেহের কোষে আঘাত করে তখন তা মারাত্মক ক্ষতি করতে পারে। এ ঝুঁকি গভীর মহাকাশ অভিযানের জন্য বিশেষভাবে চিন্তার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। কারণ এতে গর্ভবতী মা এবং গর্ভস্থ শিশুর শরীরে দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতি হতে পারে। বেশিরভাগ মহাজাগতিক রশ্মি থেকে পৃথিবীতে মানুষ নিরাপদে থাকেন। কারণ পৃথিবীর বায়ুমণ্ডল ও চৌম্বক ক্ষেত্র মানুষকে ক্ষতিকর রশ্মি থেকে রক্ষা করে। এ সুরক্ষা কখনো হাজার হাজার কিলোমিটার আবার কখনো লাখ লাখ কিলোমিটার পর্যন্ত ছড়িয়ে থাকে, এমনকি দিনের সময় অনুসারে এটি বদলায়ও। তবে মহাকাশে এ সুরক্ষা থাকে না। সেখানে মানুষ সরাসরি এ ক্ষতিকর রশ্মির মুখে পড়েন। মহাজাগতিক রশ্মি যখন মানবদেহের সঙ্গে সংঘর্ষ করে তখন তা খুব নির্দিষ্ট জায়গায় ক্ষতি করতে পারে। এসব রশ্মি দেহের কোষ বা কোষের ভেতরের অংশ নষ্ট করে দিলেও কোষের আশপাশের টিস্যু ঠিকই থাকে। এসব রশ্মি ডিএনএ’তে আঘাত করলে তা মিউটেশন বা জেনেটিক পরিবর্তন ঘটাতে পারে, যা ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ায়। অনেক সময় কোষের ক্ষতি না হলেও এসব রশ্মির প্রভাব দেহে এক ধরনের প্রদাহ তৈরি করে। তখন দেহের ইমিউন সিস্টেম অনেক সক্রিয় হয়ে পড়ে এবং এমন রাসায়নিক পদার্থ ছাড়তে শুরু করে, যা সুস্থ কোষের ক্ষতি করে ও অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের স্বাভাবিক কার্যক্রমে ব্যাঘাত ঘটায়। গর্ভধারণের প্রথম কয়েক সপ্তাহে ভ্রূণটির কোষ দ্রুত বিভাজিত হয়, সরে যায় ও বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ তৈরি হয়। এ সময়টি ভ্রূণের বিকাশের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

গর্ভধারণের প্রথম মাসটা বিশেষভাবে সংবেদনশীল। এ সময়ে শক্তিশালী কোনও মহাজাগতিক রশ্মি ভ্রূণের জন্য বিপজ্জনক হতে পারে। তবে ভ্রূণ খুব ছোট হওয়ায় সরাসরি আঘাত পাওয়ার ঝুঁকি কম থাকে। এমন কিছু ঘটলে তা গর্ভপাতের কারণ হতে পারে ও অনেক সময় সেটি অজান্তেও ঘটতে পারে। গর্ভাবস্থার অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে মহাজাগতিক রশ্মির ঝুঁকি বদলায়। প্রথম ত্রৈমাসিকের শেষে যখন প্লাসেন্টার রক্ত সঞ্চালন সম্পূর্ণভাবে গড়ে ওঠে তখন ভ্রূণ ও জরায়ুর দ্রুত বৃদ্ধি ঘটে। ফলে মহাজাগতিক রশ্মির জন্য জরায়ু বড় একটি টার্গেট হয়ে দাঁড়ায়। এসব রশ্মি জরায়ুর পেশিতে আঘাত করলে তা সংকোচন শুরু করে এবং সময়ের আগেই শিশুর জন্ম বা প্রিম্যাচিউর লেবার ঘটাতে পারে। এমন আগাম প্রসবের ফলে নানা জটিলতা দেখা দেয়, বিশেষ করে মহাকাশের মতো জায়গায়, যেখানে চিকিৎসা সুবিধা সীমিত। আরেকটি বিষয় হচ্ছে, মহাকাশে জন্ম নেওয়া শিশুর সামনে বিশেষ কিছু বিকাশগত সমস্যা আসতে পারে। কারণ সেখানে মাধ্যাকর্ষণ থাকে না। মাধ্যাকর্ষণের অভাবে শিশুর দেহের সঠিক অবস্থান বুঝতে সাহায্য করা ও দেহের সমন্বয় বিকাশে বাধা দিতে পারে। ফলে শিশুর জন্য মাথা তুলতে পারা, বসতে পারা, হামাগুড়ি দেওয়া ও হাঁটা-চলা শেখার মতো গুরুত্বপূর্ণ শারীরিক দক্ষতা অর্জন করা কঠিন হয়ে পড়বে। গবেষকরা বলছেন, শিশু জন্মানোর পরও মহাজাগতিক রশ্মির ঝুঁকি কমে যায় না। কারণ শিশুর মস্তিষ্ক তখনও বিকাশ ও বৃদ্ধি পেতে থাকে। দীর্ঘ সময় ধরে মহাজাগতিক রশ্মির সংস্পর্শে থাকার ফলে মস্তিষ্কে স্থায়ী ক্ষতি হতে পারে, যা শিশুর বুদ্ধি, স্মৃতি, আচরণ এবং দীর্ঘমেয়াদি স্বাস্থ্যের ওপর প্রভাব ফেলতে পারে। মহাকাশে একটি শিশু জন্ম নেওয়া সম্ভব হলেও এর জন্য অনেক বড় বড় চ্যালেঞ্জ সামনে রয়েই গেছে।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত