বিষাদ বাতি
যখন বিষাদ বাতিটি
ঘরের কোণে টিমটিম জ্বলে
আমি বুঝে যাই এ পৃথিবীর কোথাও নিয়নের আলো নেই;
তবু সন্ধে নামলেই
বড় রাস্তার ওপারে সেজে ওঠে মদের দোকান,
মোহরের ঝনৎকারে জেগে ওঠে নগরীর পান্থ নিবাস
এসব জেনে জেনে একদিন আমি নিজেই নিলাম হয়ে যাই।
আমি জেনে গেছি
এই হাত স্মরণের স্পর্শ লেখে না মাটির পাতায়
এই হাত হর্ম্যরে ভিত গড়ে ক্লেশে ক্লেশে,
তা থেকে যত মাটি ওঠে—
একটি একটি করে উনুন বানিয়ে দিই জলপুর গাঁয়ে;
ভাবি, একদিন জ্বলে ওঠে যদি।
আমার সমস্তই বিফলে যায়
লগ্ন বলে কিছুই থাকে না
জখমগুলো আয়ু খেয়ে মরা পাতা ফেলে যায়
গগনবাবুর ফুল বাগানে;
কায়ক্লেশে বাঁচি, তবু তোর কাছেই ফিরে যাবার এ যাত্রা
থামেনি
শ্যামা মেয়ে, এখানে এই অন্ধকারে
তোর কথা ভেবেই এই স্থবির প্রবহমানতার ভেতরও
স্বপ্ন বাঁচে : একদিন বিষাদ বাতির আলো কাচফুল হবে।
আমাকে ভাঙো
আমাকে ভাঙো।
দেখবে অবিকল আমারই মতো আরেকটা
অশ্মর কাঠামো দাঁড়িয়ে আছে,
ভাঙা যায় না।
তার পায়ের কাছে ঝরা শেফালির মতো
মুঠো মুঠো অক্ষর
যা দিয়ে জীবনানন্দ বনলতা এঁকেছিলেন।
আমাকে আরও ভাঙো।
দেখবে কুমোরটুলির চেয়েও বড় এক ঠাকুরপাড়া,
যেখানে বিসর্জনের কাঠামোর গায়ে মাটি লেপে লেপে
নতুন করে প্রতিমা গড়া হয়।
আমাকে ভাঙো।
ভাঙতে ভাঙতে শেষ বিন্দুতে গেলে দেখবে
রাত ফিকে হয়ে ক্রমশ ভোর ফুটছে!
একদিন দিনগুলো নিয়ে গিয়েছিলে। সন্ধ্যাগুলোও।
এরপর রাত্রি নামে। নকশি কাঁথা রাত্রি। পারোনি তবুও।
আমাকে ভেঙেছ।
তবু তোমাকে জ্যোৎস্না দিয়েছিলাম। ঝাড়লণ্ঠন।
অনেকখানি যৌন সুবাস। তবু কথারা বসেনি
জোনাকি জোনাকি শব্দমালাও, এমনকি বেলফুল সুঘ্রাণও।
আমি সেইসব দুঃস্বপ্ন থেকে খুঁজে নিয়েছি
মায়াবী কথালোক।
আর কী ভাঙবে আমাকে!
ভোরের কুসুম
জানকী এবার তুমি পিঠ ফিরে শোও
আমার কোনও সাবিত্রী চাই না
আমার দু’হাত ভরা সন্তাপের ইতিহাস
আমার যতখানি ঘুম তার চেয়ে অনেক বেশি অধিবাস
এই করে করে নীল জলের সমুদ্রে শেষমেশ ভাসিয়েছি
এক বিলম্ব জাহাজ।
জানকী পিঠ ফিরে শোও
কত আর পার করি মিথ্যের মন্ত্রতপঃ
এ সাগর বৈকালিক নয়, এ সাগর পুষ্পের নেশা
আমাকে ছুঁতে হবে অনেক দূরের ভোর-কুসুম।
ইদানীং বৃষ্টি হয় খুব আমার বুকের ভেতর
কোনও এক শান্ত দ্বীপে ভেসে থাকা নলিনীর বুক
আমাকে শয়ান রাখে যেন তার মখমল গোলাপি শরাব
ফিরিয়ে দেবে পৃথিবীর ডিঙাভরা ঘুম।
জানকী এবার তো পিঠ ফিরে শোও
আমি অ্যালবাট্রস, ছুঁয়ে ফেলি আকাশ ও সমুদ্রকে
তার সুগন্ধি রুমালি-গোলাপজল সাঁতরে স্থির এখনও,
অরুণাভ ছায়ায় ডুবে আছে তার ব্যথার শরীর।
জানকী এবার তুমি পিঠ ফিরে শোও।
আমাকে পুড়িয়ে ফেলাই ভালো
আমাকে পুড়িয়ে ফেলাই ভালো!
যার সাথে মিলিনি আমি, তার সাথে মৃত্যুতে কী লাভ?
চুম্বনের পালক ওড়েনি আকাশে
তরঙ্গ স্পর্শ করব বলে ছুটে যাইনি সমুদ্রে
মেটেনি অনেক তৃষ্ণা তবু জগত ঘোরে
তৃষ্ণারা ভস্ম হলে একদিন হাওয়ায় ওড়া কাগজের নৌকো পেতো।
ডাহুকীর নরম পালকে আজ যে ওম
কালও কি সে ওমের উষ্ণতায় গা ভেজে?
দরজার ওই পাশে যেতে হলে অন্য এক চাবি প্রয়োজন
আজীবন কান পেতে বসে আছি
মৃত্তিকার কোল থেকে উঠে আসা মায়াডাক শুনিনি তবু।
আমাকে বরং পুড়িয়ে ফেলাই ভালো!
আমি আজ দু’হাত দিয়ে পৃথিবীর সকল বেদনার
যে ভার উত্তোলন করি, তার কিছুটা ওই পাহাড় শীর্ষের হিম বাতাস;
কিছু অবশেষ ডানা মেলে উড়ে চলে যাক
আমিই তো ব্যথাদের প্রান্তিক বিরহ-সুর।
আমরা এবং আগামী
মন্দির থেকে ভেসে আসছে
প্রার্থনা সংগীত,
মসজিদ থেকে পাঠের সুর;
তার পাশেই ঘুমিয়ে আছে সাদা পতাকা;
আমরা ঘষে ঘষে আগুন জ্বালাই
আমরা বুনে চলি বিভাজন-বীজ
আমরা ফিনকির তরল কালি দিয়ে লিখি...
ভবিষ্যতের দেওয়াল।
মা
আমার মায়ের
আলতা পরা পায়ের পাতায় একটি সোনার ধান
নূপুরের শব্দ নিয়ে স্থির হয়ে আছে;
একবার নতজানু হও
একবার অভিভূত হয়ে চুম্বন করো এই অভাবিত দৃশ্যে।
প্রেম ও প্রণামের গৌরব আঁকন হয়ে জাগে
ছিঁড়ে যাওয়া এইসব চাঁদনির ভেতর।
আমি তাকে স্পর্শ করি
ঝাপসা হয়ে আসা ঘোলা চোখের দৃষ্টি দিয়ে;
ভিজে পায়ের কোলে যেখানে গুল্মের মতো লতিয়ে উঠেছে
মাটির টিপ,
শ্রাবণের আকুল মেঘের আয়োজনের মতো
জলের ফোঁটায় ধারণ করে চলে আমার সারা জীবনের
নরম ছায়ার আশ্রয়।
আমার জবুথবু মায়ের শরীর
নুয়ে পড়া দেহের কাঠামো তবু সর্বনাশ মুছে ফেলে
আগলের পরাগ ওড়ায় দখিন বাতাসে।