বাংলা সাহিত্যের সত্তর দশকের অন্যতম এবং গণ্যতম সাহিত্যস্রষ্টা রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ (জন্ম: ১৬ অক্টোবর ১৯৫৬, মৃত্যু: ২১ জুন ১৯৯১)। অসামান্য মেধা, মানবিকতা, সংবেদনশীলতা এবং দেশপ্রেমের মিশেলে ক্ষণজন্মা এই কবি-শিল্পী-সাহিত্যিক স্থান করে নিয়েছেন বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে। সাহিত্যের প্রচলিত শাখাগুলোতে তার লেখনীর যাতায়াত থাকা সত্ত্বেও তিনি ‘কবি’ হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছেন তার মুগ্ধ পাঠক এবং সাহিত্যের সমালোচকদের কাছে। রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ সেই সব মহৎ বাঙালি কবিদের মধ্যে অন্যতম- যাদের কবিতার আবৃত্তি বাংলাদেশের আবৃত্তিশিল্পীদের কাছে অত্যন্ত আদৃত, কাঙ্খিত, শিল্প-হাতিয়ার হিসেবে পরম প্রত্যাশিত। বিগত শতাব্দীর আশির দশকের শুরু থেকে আজ পর্যন্ত আবৃত্তির এমন কোনো বড় আয়োজন কমই দেখা যায়- যেখানে রুদ্রের অন্তত একটি কবিতার আবৃত্তি বিরল।
রুদ্রের কবিতাগুলোর মধ্যে আমরা দেখতে পাই অসাধারণ শক্তিশালী সব পঙক্তি-বিন্যাস। উৎসাহী পাঠকের নিবিড় পাঠের পাশাপাশি আবৃত্তিশিল্পীদের কণ্ঠে ধ্বনিত-উচ্চারিত এরকম কিছু উল্লেখযোগ্য অসামান্য পঙক্তি- যা দেশে তো বটেই, দেশের গণ্ডি পেরিয়ে সারাবিশ্বের শিল্পরস পিপাসু শুভবাদী আবৃত্তিপ্রেমী বাঙালি মাত্রই আস্বাদন করেছেন- অনুপ্রাণিত হয়েছেন প্রেমে-বিরহে-বিক্ষোভে; প্রতিজ্ঞায়-সংকটে-সংকল্পে এবং প্রতিবাদের ভাষা হিসেবে ধারণ করেছেন নিজ নিজ অবস্থান থেকে। আমরা এখন তার এমন কিছু পঙক্তির সাথে পরিচিত হবো-
১). “অভিলাষী মন চন্দ্রে না-পাক জ্যোৎস্নায় পাক সামান্য ঠাঁই, / কিছুটাতো চাই, কিছুটাতো চাই। /...বেদনার পায়ে চুমু খেয়ে বলি এইতো জীবন, / এইতো মাধুরী, এইতো অধর ছুঁয়েছে সুখের সুতনু সুনীল রাত!” (কবিতা: অভিমানের খেয়া)
২). “আজো আমি বাতাসে লাশের গন্ধ পাই, / আজো আমি মাটিতে মৃত্যুর নগ্ন নৃত্য দেখি, /... / স্বাধীনতা— সে-আমার স্বজন হারিয়ে পাওয়া একমাত্র স্বজন, / স্বাধীনতা- সে-আমার প্রিয় মানুষের রক্তে কেনা অমূল্য ফসল। / ধর্ষিতা বোনের শাড়ি ওই আমার রক্তাক্ত জাতির পতাকা।” (কবিতা: বাতাসে লাশের গন্ধ)
৩). “কুশল শুধোলে মনে হয় তুমি আসোনি,/ পাশে বসলেই মনে হয় তুমি আসোনি। / করাঘাত শুনে মনে হয় তুমি এসেছো, / দুয়োর খুললেই মনে হয় তুমি আসোনি। /... / চলে গেলে মনে হয় তুমি এসেছিলে,/ চলে গেলে মনে হয় তুমি সমস্ত ভুবনে আছ।” (কবিতা: এ কেমন ভ্রান্তি আমার)।
৪). “ফুলের পোশাকে ঢাকা শরীর, দারুণ মাংশভুক পাখি, / ওই শকুন, ওই হিংস্র গোপন নোখ জুড়ে থাকা শত্রু-স্বভাব, / আমাদের দিন থেকে খেয়ে যায় প্রিয়তম রোদের মাংশ।” (কবিতা: মাংশভুক পাখি)।
৫). “উৎসব থেকে ফিরে যাওয়া আমি সেই প্রত্যাখ্যান, / আমি সেই অনিচ্ছা নির্বাসন বুকে নেয়া ঘোলাটে চাঁদ। / আমাকে আর কী বেদনা দেখাবে? /... / আমি সেই নতমুখ, পাথরের নিচের করুন বেদনার জল, / আমি সেই অভিমান- আমাকে গ্রহণ করো।” (কবিতা : আমি সেই অভিমান)।
৬). “ফাঁসির মঞ্চ থেকে আমাদের যাত্রার শুরু। / এক একটি জন্মের সমান মেধাবী মৃত্যু / এক একটি প্রতিজ্ঞা-পুষ্ট মৃত্যুর সোপান / দুর্যোগ-অন্ধকারে তুলে রাখে সূর্যময় হাত- / তুমুল তিমিরে তবু শুরু হয় আমাদের সঠিক সংগ্রাম।” (কবিতা: ফাঁসির মঞ্চ থেকে)
৭). “হে আমার বিষণ্ণ সুন্দর / দুচোখে ভাঙন নিয়ে কেন এই রুক্ষ দুঃসময়ে এলে / কেন সমস্ত আরতির শেষে আজ এলে শূন্য দুখানি হাত! / কেন এলে, বিষণ্ণ সুন্দর, তুমি কেন এলে। “(কবিতা : হে আমার বিষণ্ণ সুন্দর)।
৮). “ঝোপে জঙ্গলে আসে দঙ্গলে আসে গেরিলার / দল, হাতিয়ার হাতে চমকায়। হাত ঝলসায় / রোষ প্রতিশোধ। শোধ রক্তের নেবে তখ্তের / নেবে অধিকার। নামে ঝনঝায়- যদি জান যায় / যাক, ক্ষতি নেই ; ওঠে গর্জন, করে অর্জন মহা ক্ষমতার,/ দিন আসবেই, দিন আসবেই, দিন সমতার।” (কবিতা: হাড়েরও ঘরখানি)।
৯). ‘ওলো নারী, সহজে খুলি না তনু, খুলি না জবান। / নিশিথে নিশির ডাক শুনে যদি শিথিল হয়েছে শাড়ি / তবে আর দ্বিধা কেন? / কাঁকরের রাঙা মাটি অপরূপ শয্যা হবে / চন্দনের ঘ্রাণ হবে শরীরের উষ্ণতম ঘাম- ” (কবিতা : পৌরানিক চাষা)।
১০). একবার বৃষ্টি হোক, অবিরল বৃষ্টি হোক, / উষর জমিনে, / নিরীহ রক্তের দাগ মুছে নিক জলের প্লাবন, / মুছে নিক পরাজিত ব্যর্থ বাসনার গান, গ্লানির পৃথিবী।’ (কবিতা: বৃষ্টির জন্য প্রার্থনা)।
১১). ‘মুখোমুখি দাঁড়াবার এইতো সময়, / শত্রুকে চিনে গেছে অমিত মানুষ,/ হৃদয় জেনেছে ঠিক কতোটা পচন- / মুখোমুখি দাঁড়াবার এইতো সময়।” (কবিতা: মুখোমুখি দাঁড়াবার দিন)।
১২). “তামাটে রাখাল তোর বাঁশিটি বাজে না কেন? / বাজে তোর নিঃসঙ্গতা, বাজে তনু, ব্যথিত খোয়াব, / গহন সুরের মতো বাজে তোর দিবসরজনী- / তবু কেন বাঁশিটি বাজে না? / একবার বেজেছিল বাঁশি- বাঁশি শুধু একবারই বাজে?” (কবিতা : তামাটে রাখাল)।
১৩). “তাদের বলি শোনো, ২ যদি কোনো না করো উপায় /হাজার মানুষ ভাঙবে ও-সুখ হাজার হাতের ঘায়। / কোনো নিষ্কৃতি নেই, ২ আমি জানাই শোনো স্বার্থপর- / আর্ত মানুষ কেড়ে নেবে তাদের অধিকার। / তারা জেগে উঠছে ...” (কবিতা : রাস্তার কবিতা)।
১৪). “আমারে বানাও ফের তোমার নাহান /তোমার নাহান ঋজু স্বাস্থ্যবান হিয়া,/ আমারে বানাও শুদ্ধ- স্বপ্ন-জাগানিয়া।” (কবিতা : স্বপ্ন-জাগানিয়া)
১৫). “ভাসান যে দিতে চাও, কোন দেশে যাবা? যাবা সে কোন বন্দরে / আমারে একলা থুয়ে? এই ঘর, যৈবনের কে দেবে পাহারা? / এমন কদমফুল- ফোটা-ফুল থুয়ে কেউ পরবাসে যায়! / তুমি কেন যেতে চাও বুঝি সব, তবু এই পরাণ মানে না।” (কবিতা : মানুষের মানচিত্র-৪)।
১৬). “আমরা গান গাইবো / আমাদের বসন্ত আর বৃষ্টির বন্দনা কোরে। / আমরা উৎসব করবো শস্যের। /আমরা উৎসব করব পূর্ণিমার।/ আমরা উৎসব করবো/ আমাদের গৌরবময় মৃত্যু আর বেগবান জীবনের।” (কবিতা : ইশতেহার)।
১৭). “এদেশের গঞ্জে গ্রামে শকুনের এখনো সুদিন- / মাটি কাঁপে, বৃষ্টি হোক, লাশগুলো আবার দাঁড়াক।” (কবিতা: লাশগুলো আবার দাঁড়াক)।
১৮). “আমরা তেভাগার কৃষক, নাচোলের যোদ্ধা/আমরা চটকলের শ্রমিক, আমরা সূর্যসেনের ভাই/ আমরা একাত্তুরের স্বাধীনতা যুদ্ধ থেকে এসেছি / কাঁধে স্টেন, কোমরে কার্তুজ, হাতে উন্মত্ত গ্রেনেড- / আমরা এসেছি।” (কবিতা: মুখোমুখি)।
১৯). “দাঁড়াও, নিজেকে প্রশ্ন করো- কোন পক্ষে যাবে?” (কবিতা : সশস্ত্র বাহিনীর প্রতি)।
২০). “মিছিলে তোমার দৃপ্ত পদক্ষেপ, / উন্নত হাতে জীবনের দাবি মাখা। / মিছিলেই তুমি নারী হয়ে ওঠো বেশি, / যেমন শিশু ও শস্যের উৎসবে।” (কবিতা : মিছিল ও নারীর গল্প)
২১). “সহজে যদিও ভালোবেসে ফেলি / সহজে থাকি না কাছে, / পাছে বাঁধা পড়ে যাই। / বিস্মিত তুমি যতোবার টানো বন্ধন-সুতো ধরে, / আমি শুধু যাই দূরে।” (কবিতা : উল্টো ঘুড়ি)।
এরকমই আরও অনেক অনেক হিরন্ময় পঙক্তি ছড়িয়ে আছে রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ’র কাব্যগ্রন্থ ‘উপদ্রুত উপকূল’, ‘ফিরে চাই স্বর্ণগ্রাম’, ‘মানুষের মানচিত্র’, ‘ছোবল’, ‘গল্প’, ‘দিয়েছিলে সকল আকাশ’, ‘মৌলিক মুখোশ’, ‘একগ্লাস অন্ধকার’, কাব্যনাট্য ‘বিশ বিরিক্ষের বীজ’ এর মতো অনবদ্য সব সৃষ্টির ভেতরে।
সাহিত্য-সৃষ্টির মগ্নতার ধারায় রুদ্র ঝুঁকেছিলেন গীত রচনায়। আমরা পেয়েছি তাঁর তুমুল জনপ্রিয় ‘আমার ভেতর-বাইরে অন্তরে অন্তরে / আছো তুমি হৃদয়জুড়ে...’ সহ ‘দিন গ্যালো দিন গ্যালো রে’, আমরা পাড়ি দেবো / রুদ্র সমুদ্র, কালো রাত’, ‘ছিঁড়িতে না পারি দড়াদড়ি’, ‘ঢোলক বাজাও দোতারা বাজাও / সুর মিলছে না, / অন্তর বাজাও নইলে তাল মিলবে না’, ‘নূর হোসেনের রক্তে লেখা / আন্দোলনের নাম’, ‘ও নিঠুর দরিয়ার পানি, / কেন যে ডোবাও তুমি আমার জীবন’, ‘যদি চোখে আর চোখ রাখা না-ই হয়, / নদী বয়ে যায় সমুদ্র সীমানায় ক্ষতি কী?’, এর মতো মানবিক হৃদয়াবেগ মিশ্রিত এবং রাজনীতি-ঘনিষ্ট সব গান।
মাত্র ৩৫ বছরের জীবনে রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ সাহিত্য রচনার জন্য আর কতটাইবা সময় পেয়েছিলেন; তারপরও গদ্য-পদ্য মিলিয়ে এ সংখ্যা নেহায়েত অপ্রতুল নয়। তার ছিল স্বতঃস্ফূর্ত মননশীল সৃষ্টিক্ষমতা। শব্দ প্রয়োগে, অলঙ্কার ব্যবহারে বা বাক্যবিন্যাসেই কেবল নয়, শ্রুতিমধুর ধ্বনিবিন্যাসেও তিনি ছিলেন পারঙ্গম। তার কণ্ঠে সদ্য স্বরচিত কবিতার আবৃত্তি বন্ধু-স্বজন-শ্রোতাকে করেছে মন্ত্রমুগ্ধ।
সর্বাবস্থায় শিল্পিত আচরণ এবং জীবনযাপনই ছিল তার আরাধনা। আর তার রচনার মূল দর্শন ছিল সমতা ও মানবিকতা। যার মধ্যে দিয়ে আমরা এ অকাল প্রয়াত সাহিত্যস্রষ্টার বহুমুখী সৃষ্টিশীলতার পরিচয় লাভ করি।