ঢাকা সোমবার, ১৪ জুলাই ২০২৫, ৩০ আষাঢ় ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

জুলাইয়ে সাধারণ মানুষ

রেদওয়ান শরীফ
জুলাইয়ে সাধারণ মানুষ

মা আমি রাহাতদের বাসা থেকে আসছি বলে বাসা থেকে বেরিয়ে পরল আকিব। সঙ্গে তার দুই বন্ধু তরিকুল ও আশরাফ। তারা এখন নারায়নগঞ্জের দিকে যাচ্ছে। গলায় কলেজের আইডিকার্ড ঝোলানো। এক সপ্তাহ কারফিউ জারি করার পর আজ সবাই আবার রাস্তায় নেমেছে। এই কারফিউর সময় পুলিশ ছাত্রদের কিভাবে মেরেছে তা আর বলার মতো না। নেটওয়ার্ক অফ করে হেলিকপ্টার থেকে মানুষদের উপর নির্বিচারে গুলিবর্ষণ করছে। গরম পানি ঢেলেছে। মাঝ রাস্তায় দাঁড়িয়ে মানুষদের গুলি করেছে। কোনদিক দিয়ে ছাড় দেয়নি। সেদিন আন্দোলনে যাওয়ার সময় আকিব ধরা পরে গিয়েছিল। বাসা থেকে বের হতে দিচ্ছিল না। গুলি লাগবে, মরে যাবে বলে বাসায় বন্দি করে রেখেছিল। তার থেকেও বড় কারণ হচ্ছে তার ফ্যামিলি খাজ আওয়ামী লীগ। তাই বাসা থেকে বের হতে দিচ্ছিল না। কিন্তু আকিব কোন কথা না শুনে জোর করে বাসা থেকে বের হয়ে যায়। বের হওয়ার সময় পেছন থেকে তার বাবা বলে, ‘তুই যদি আওয়ামী লীগের ভাত খেতে চাস তাহলে বাসা থেকে এক পাও নড়বি না। তখন আকিব আজকে থেকে আর খাব না বলে বাসা থেকে বের হয়ে যায়। নিজের ক্লাসের বন্ধুবান্ধব যদি মরার ভয় উপেক্ষা করে রাস্তায় দাঁড়িয়ে আন্দোলন করতে পারে তাহলে সে কেন পারবে না। তাছাড়া সেও তো ছাত্র। এই আন্দোলন তো তাদেরই। আন্দোলনে যোগ দেওয়ার জন্য যদি পরিবার রাগ করে থাকে, থাকুক। তবুও আন্দোলনে না গিয়ে থাকতে পারবে না। কোথায় যেন পরেছিল সবকিছুর শুরু ঘর থেকেই করতে হয়। তাই প্রথম বৈষম্যটা না হয় ঘর থেকেই শুরু হোক। মনে মনে একথা বলে ঘরে যুদ্ধ করে বাইরে বেরিয়ে পরল আকিব বৈষম্য করতে।

চারদিক দিয়ে সবকিছু থমথমে হয়ে গেছে। রাস্তায় ইট, পাথর, গাছপালার ডাল ভেঙে ভেঙে পরে আছে। গুলির শব্দে সারা এলাকা ভয়ানক হয়ে উঠেছে। পুলিশের তারা খেয়ে আকিব রা এখন একটা বাসার ভেতর। কিছুক্ষণ পর পর বোমা ফাটার শব্দ হচ্ছে। আকিবরা এসেছিল তিনজন। কিন্তু পুলিশের তারা খেয়ে এই বাসায় আশ্রয় নেওয়ার পর এখন দেখতে পারছে তরিকুল নেই। কোথাও দেখা যাচ্ছে না তাকে। অনেকজন একসঙ্গে দৌড় দেওয়ার সময় কখন আলাদা হয়ে গেছে খেয়াল করেনি। আকিব আশরাফ আবার আশপাশটা ভালো ভাবে দেখে নিল, না কোথাও তরিকুলকে দেখা যাচ্ছে না। বুকের ভেতরটা হালকা করে কাপুনি দিয়ে উঠল আকিবের। তরিকুলের আবার কিছু হয়ে গেল না তো। তারা তিনজন যেভাবে এসেছিল ঠিক সেভাবেই বাড়ি ফিরতে পারবে তো। বুকের ভেতর একটা আতঙ্ক অনুভব করে আশরাফকে রেখে বাইরে বেরিয়ে গেল আকিব। গলির মাথা থেকে কিছুদূর এগোতেই দেখল তরিকুল হাটু গেড়ে বসে আছে। মুখ উল্টিয়ে বমি করছে। সম্ভবত টিহার্সেলের গ্যাস ভেতরে ঢুকে গেছে। তরিকুলের এ অবস্থা দেখে তাকে ধরে উঠিয়ে নিয়ে আসছিল আকিব। তাকিয়ে দেখে তরিকুলের হাত দিয়ে রক্ত বেরুচ্ছে। খানিকটা গর্ত হয়ে গেছে। গলি চামড়া ভেদ করে বেরিয়ে গেছে। রক্ত দিয়ে হাত মাখামাখি। আকিব কোনদিকে না তাকিয়ে দ্রুত কপাল থেকে পতাকা খুলে তরিকুলের হাতে বেধে দিল। তাকে ধরে ধরে আশরাফের কাছে নিয়ে গেল আকিব। তরিকুলের কথা শোনার পর আবার বেরিয়ে পরল সে। গুলি খাওয়ার সময় হাত থেকে নাকি মোবাইল আইডিকার্ড পরে গেছে তার। সেগুলো আনার জন্য আবার রাস্তায় নামল। গলি থেকে বেরিয়ে রাস্তার মাথায় আসতেই দেখতে পেল কয়েকটা পুলিশ চলে এসেছে। তদের হাতে বন্দুক দেখে কিছুটা ঘাবড়ে গেল আকিব। কি করবে বুঝতে না পেরে দু হাত টান করে ধরে রাখল এবং বলল; গায়ে হাত দিলে খবর আছে। চাইলে গুলি করুক সমস্যা নেই। কিন্তু গায়ে হাত দেয়া যাবে না। আকিবের কথা শুনে পুলিশ দাঁড়িয়ে রইল। কিছুই করল না। অনেকক্ষণ কেটে যাওয়ার পর এক অপরিচিত আপু লক্ষ্য করল আকিব আসছে না। আইডিকার্ড আনতে এত দেরি হবে ভেবে কিছুটা দুশ্চিন্তায় পরে গেলেন তিনি। আর কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে চিন্তিত মুখ নিয়ে বের হয়ে গেলেন। বাসা থেকে বের হয়ে দেখেন গলির মাথায় আকিব দাঁড়িয়ে আছে। তার সামনে পুলিশ। সরাসরি বন্দুক তাক করা তার দিকে। আকিবকে পুলিশের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে দ্রুত পায়ে আকিবের সামনে গেলেন আপু। আকিবের এক হাত ধরে তাকে পেছন দিকে টানতে টানতে বলে যেতে থাকল, গায়ে হাত দিলে খবর আছে গায়ে যেন হাত না দেয়। প্রয়োজনে গুলি খেয়ে সারা শরীর রক্তপাত হয়ে যাক। কিন্তু গায়ে হাত দেয়া যাবে না। আপুর গর্জন শুনে পুলিশ কিছুটা নাতিয়ে পরল। তারপর বন্দুক নামিয়ে পেছনে হেটে বড় রাস্তার দিকে চলে গেল। আপুটা আকিবের হাত থেকে আইডিকার্ড নিয়ে দেখে বলল, ‘তোমাদের সাহস আছে। এ সাহস আজীবন ধরে রাখার চেষ্টা করবে। অন্যায় দেখলেই প্রতিবাদ করতে ঝাপিয়ে পরবে। তাহলে দেখবে সাহস আরও বেড়ে গেছে।’

আকিব, আশরাফ, তরিকুল বাসার উদ্দেশ্য রওয়ানা হয়েছে। আসার সময় যে রাস্তা দিয়ে এসেছিল এইরাস্তায় পুলিশ দাঁড়িয়ে আছে বলে তারা এখন শীতলক্ষ্যা নদী পার হচ্ছে। ট্রলারে করে আসার সময় এক ভদ্রমহিলার সঙ্গে কথা হয়েছিল তাদের। জিজ্ঞেস করেছিল আন্দোলন এখনও চলছে কি না। ভদ্রমহিলা জিজ্ঞেস করার সঙ্গে সঙ্গে এক অল্প বয়স্ক ভদ্রলোক গালি দিয়ে বললেন, ‘আমরা সাধারণ জনগণেরা আরও বেশি খারাপ। আমাদের ভেতর মনুষ্যত্ব নেই। আমাদের উচিত ছাত্রদের পাশে থাকা। তাদের সাহায্য করা। কন্তু আমরা তা না করে চুপচাপ ঘাপটি মেরে বসে আছি। ছাত্রদের মরা লাশ দেখছি। আমরা সাধারণ জনগনেরা এই সরকারের চেয়েও খারাপ। আমরা এখন আর মানুষ নই। পশুরও অধম।

ভদ্রলোকের কথা শুনে সবাই চুপচাপ বসে রইল। কেউ কোন কথা বলল না। কিছুক্ষণ কেটে যাওয়ার পর ভদ্রমহিলা তার পার্স থেকে তিন হাজার টাকা বের করে তরিকুলের হাতে দিয়ে বলল, ‘বাবা আমার ছোট বাচ্চা আছে। তাই বাসা থেকে বের হতে পারি না। নাহলে আমিও তোমাদের সঙ্গে আন্দোলনে যোগ দিতাম। তোমরা এই টাকাটা রাখ। তোমরা যারা ছাত্ররা আন্দোলন করছ তারা সবাই মিলে পানি বিস্কুট খাবে। আমরা সাধারণ জনগণরা সবসময় তোমাদের পাশে আছি। সবসময়।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত