ঢাকা বৃহস্পতিবার, ১১ ডিসেম্বর ২০২৫, ২৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

মানবতা যেখানে গুমরে মরে

আসাদ পারভেজ
মানবতা যেখানে গুমরে মরে

জাতিসংঘের স্থায়ী পরিষদ নিয়ে গত কয়েক বছর বিশ্ব মঞ্চে প্রশ্ন উঠেছে। এরা কি মানবতার জন্য প্রতিষ্ঠিত নাকি মার্কিনিদের জন্য যুদ্ধরীতিকে সহজকরণে কাজ করছে! জাতিসংঘকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে যুদ্ধের ১১তম (১৭ অক্টোবর, ২০২৩ মঙ্গলবার রাত) দিনে গাজা ভূখণ্ডের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত আল-আহলি হাসপাতালে বিমান হামলা করে ইসরাইল। এতে অন্তত ৫০০ ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। এর আগে ইসরায়েলি হামলায় আহত শত শত রোগী ও গৃহহীন অসংখ্য বাসিন্দা নিরাপদ ভেবে ওই হাসপাতালে আশ্রয় নিয়েছিল। অপরদিকে হাসপাতালে অভিযানের আগের দিনগুলোতে ইসরায়েল জোর দিয়ে বলেছিল, আশ-শিফা হাসপাতালের নিচে হামাসের কমান্ড সেন্টার রয়েছে, যেখান থেকে তারা টানেল পরিচালনা করছে। এ দাবির ভিত্তিতে তারা আশ-শিফা হাসপাতালে আক্রমণ করে। তারা ১৫ নভেম্বর ২০২৩ বুধবার দুপুর ২টায় প্রথম বারের মতো হামলা চালায়। পরের দিনও হামলা চালায়। এরপর ইসরায়েলি বাহিনী দাবি করেছে, অভিযানে তাদের দাবির পক্ষে প্রমাণ মিলেছে।

ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী হাসপাতালের একটি অব্যবহৃত ভবনের ভিডিও ফুটেজ প্রকাশ করেছে। সেখানে দেখানো হয়েছে, তিনটি ডাফেল ব্যাগ, প্রতিটিতে একটি অ্যাসল্ট রাইফেল, গ্রেনেড, হামাসের ইউনিফর্ম ও ফ্ল্যাক জ্যাকেট রয়েছে। এ ছাড়া ভিডিও ছাড়াই আরও একটি অ্যাসল্ট রাইফেল ও ল্যাপটপ পাওয়া গেছে বলেও দাবি করে। প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনও ইসরায়েলি দাবিগুলোকে সমর্থন করেন। তিনি হাসপাতালের নিচ থেকে যুদ্ধ পরিচালনার অভিযোগ এনে হামাসকে যুদ্ধাপরাধের জন্য অভিযুক্তও করেন। মার্কিন প্রশাসন সমর্থন জানিয়ে বলেন, আশ-শিফা হাসপাতালের নিচে সুড়ঙ্গে ‘কমান্ড অ্যান্ড কন্ট্রোল সেন্টার’ তথ্য রয়েছে।

দাবি বনাম পাল্টা দাবি : প্যালেস্টাইন ন্যাশনাল ইনিশিয়েটিভের জেনারেল সেক্রেটারি মুস্তফা বারঘৌতি বলেন, ইসরায়েলের প্রকাশিত ভিডিওতে যা দেখা গেছে, তা তো তারাই সেখানে রাখতে পারে। এটি তো খুব বেশি কিছু নয়। তিনি আরও বলেন, ইসরায়েল প্রথমে কিছু দর্শককে আশ-শিফার ওই অব্যবহৃত কামরায় নিয়ে যাওয়ার ভিডিও প্রকাশ করেছে। সেখানে তারা দাবি করেছিল, কোনো সম্পাদনা বা কাটছাঁট ছাড়াই তারা ভিডিওটি প্রকাশ করেছে। পরে তারা ওই ভিডিওটি আবার ডিলিট করে দেয়। এরপর তারা পুনরায় ভিডিওটি প্রকাশ করছে। কিন্তু নতুন ভিডিওর সঙ্গে পুরোনো ভিডিওর অভিন্নতা পাওয়া যায়নি। এ বিষয়টিও ইসরায়েলি বাহিনীর দাবির সত্যতা নিয়ে সন্দেহকে ঘনীভূত করে। হামাস ইসরায়েলি বাহিনীর সর্বশেষ বিবৃতি অস্বীকার ও প্রত্যাখ্যান করেছে। কাতারভিত্তিক হামাসের সিনিয়র সদস্য ইজ্জত আর-রাশক বলেছেন, দখলদার বাহিনী এখনও মিথ্যাচার করছে। তারা কিছু অস্ত্র, কাপড় ও সরঞ্জাম পাওয়ার দাবি করেছে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, তারা নিজেরাই সেগুলো আগে এনে রেখেছে। তিনি আরও বলেন, হামাস বারবার জাতিসংঘ, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও রেড ক্রিসেন্টের আন্তর্জাতিক কমিটির অধীনে ইসরায়েলের দাবির সত্যতা যাচাইয়ের আহ্বান জানিয়েছে। কিন্তু তারা তো ওই আহ্বানে সাড়া দেয়নি। ইসরায়েল বরাবরই আশ-শিফা হাসপাতালের পরিস্থিতি তদন্তের জন্য একটি স্বাধীন ও আন্তর্জাতিক সংস্থার অধীনে তদন্তের আহ্বান প্রত্যাখ্যান করে এসেছে। কারণ, তারা নিজেদের মিথ্যাচার সম্পর্কে সচেতন। তাই অন্যদের সামনে মিথ্যা যেন প্রকাশ না পায়, সেজন্য ওই আহ্বান প্রত্যাখ্যান করেছে।

ভয়াবহ ও করুণ পরিস্থিতি : আল-জাজিরার হানি মাহমুদ বলেন, ইসরায়েলের সামরিক বাহিনী আশ-শিফাতে আক্রমণ চালিয়ে হাসপাতালের অপারেশন সেক্টর ধ্বংস করে ফেলেছে। এ ছাড়া কক্ষের মাঝখানের দেয়াল ও ভেতরের চিকিৎসাসামগ্রীও সম্পূর্ণ অকেজো করে ফেলেছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসেবে, গাজার সবচেয়ে বড় এ হাসপাতালে সাতশ রোগী, চারশ স্বাস্থ্যকর্মী এবং প্রায় তিন হাজার বেসামরিক লোকের অবস্থান। এদিকে বিদ্যুৎ লাইন বিচ্ছিন্ন থাকার ফলে হাসপাতালের ভেন্টিলেটরে থাকা অধিকাংশ রোগীই মারা গেছে। বিশ্ব মিডিয়ার বদৌলতে দেখা যাচ্ছে, অবরুদ্ধ হাসপাতালে ১৫০-এর অধিক লাশ পড়ে আছে। তাদের দেহে পচন ধরেছে। চারদিকে দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। আশপাশের লাশ কুকর পর্যন্ত খাচ্ছে। কোনোভাবেই লাশ দাফন করতে পারছে না হাসপাতালগুলো। ইসরায়েলের স্নাইপাররা কাউকে বাইরে দেখলেই গুলি ছুড়ছে। স্পষ্টভাবে বলা যায়, আমরা আজকে যা দেখছি, তা হলো এ যুদ্ধটি বেসামরিক নাগরিকদের ওপর আক্রমণ, হাসপাতাল আক্রমণ ও চিকিৎসাসামগ্রী ধ্বংসের জন্য করা হয়েছে। অবশেষে কাতারের সহায়তায় চারদিনের যুদ্ধ বিরতির দ্বার উন্মোচিত হয়েছে। বিনিময়ে ৫০ জন ইসরায়েলি মুক্তি পাবে। অপরদিকে ১৫০ জন ফিলিস্তিনি নারী ও শিশু ইসরায়েলের কারাগার থেকে বেরিয়ে আসবে।

দগ্ধ গাজা নিঃস্ব করে জীবন : ১২০০ ইসরায়েলি নিহত ও ২৫১ জন জিম্মি হয়েছিল হামাসের হাতে। বিপরীতে জায়নবাদী অবৈধ ইসরায়েল গত প্রায় ২২ মাসের যুদ্ধে ১ লাখের অধিক ফিলিস্তিনিকে হত্যা করেছে। এটি এ উপত্যকার মোট জনসংখ্যার প্রায় ৪ শতাংশের সমান (হারেৎজের প্রতিবেদন, আনাদোলু, ইস্তাম্বুল)। গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের হিসেবমতে, প্রথম ১২ মাসেই ৪৬ হাজার ৭৮৮ জন (এখন পর্যন্ত ৫৬ হাজার ৩০০ জন) মৃত্যুবরণ করেছে। যার মধ্যে ৫৯ শতাংশ নারী, শিশু ও বৃদ্ধ। নভেম্বর ২০২৪-এ জাতিসংঘের বিশ্লেষণে নারী ও শিশুর সংখ্যা ৭০শতাংশ প্রতীয়মান। জাতিসংঘের আরেক (ইউএনওস্যাট) বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০২৪-এর ডিসেম্বরেই গাজার ৬৯ শতাংশ ভবন ও স্থাপনা পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে গেছে। সেই সঙ্গে ৬৮ শতাংশ রাস্তাঘাট ধ্বংস হয়েছে। তা ছাড়া ১০৬০ জন চিকিৎসাকর্মী নিহত হয়েছে। মূলকথা, এ যুদ্ধে গাজার চিকিৎসা, শিক্ষা ও নাগরিক জীবন পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে গেছে। জাতিসংঘের মানবিক সহায়তা সমন্বয় অফিস (ওসিএইচএ) ধারণা করছে, গাজায় অন্তত ১৯ লাখ মানুষ অভ্যন্তরীণ বাস্তুচ্যুত হয়েছে; যা অঞ্চলটির মোট জনসংখ্যার ৯০ শতাংশ।

মৃত্যুহারে গাজা শীর্ষে : মানবিক বিশ্বে চলছে এক অমানবিক তাণ্ডব; যা বিশ্ববাসী বসে বসে দেখছে। বলতে গেলে গাজার ২৩ লাখ মানুষই আজ বাস্তুচ্যুত। জাতিসংঘের হিসেবমতে, ৯১ শতাংশ মানুষ তীব্র খাদ্যসংকটে। গাজায় চলছে দুর্ভিক্ষ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বিশ্বের অন্যান্য প্রায় সব সংঘাতের সঙ্গে তুলনা করলে এ সংখ্যা ব্যতিক্রমী। স্পষ্টত, এ গাজা যুদ্ধ একবিংশ শতাব্দীর অন্যতম রক্তক্ষয়ী সংঘাত হিসেবে চিহ্নিত। সিরিয়া, ইউক্রেন ও সুদানে যুদ্ধে নিহত ব্যক্তির সংখ্যা গাজার তুলনায় হয়তো বেশি। কিন্তু সাধারণ মানুষ ও যোদ্ধাদের মৃত্যুর হার এবং জনসংখ্যার অনুপাতে মৃত্যুর হারে গাজা সম্ভবত শীর্ষে। গাজায় সহিংস মৃত্যুর শিকার নারী ও শিশুদের অনুপাত প্রায় সব সাম্প্রতিক সংঘাতের চেয়ে দ্বিগুণেরও বেশি। কসোভোতে এ হার ছিল ২০ শতাংশ ও সুদানে ২৩ শতাংশ। ২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে ইসরায়েল গাজায় ইতিহাসের নিষ্ঠুরতম সামরিক অভিযান চালিয়ে যাচ্ছে। দায় এড়ানোর উপায় নেই : ২০২৪-এর নভেম্বরে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত (আইসিসি) গাজায় যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু ও তার তৎকালীন প্রতিরক্ষা মন্ত্রী ইয়োভ গ্যালান্টের বিুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করে। এ ছাড়া গাজায় ইসরায়েলের হামলাকে গণহত্যা হিসেবে আখ্যায়িত করে আন্তর্জাতিক বিচার আদালতেও (আইসিজে) মামলা চলছে। এ সবকিছু প্রমাণ করে, আধুনিক এ বিশ্বে মানবতা আজ প্রশ্নাতীত। কেননা, জাতিসংঘই প্রমাণ দিচ্ছে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ ইউরোপীয় বহু দেশের সহায়তায় ইসরাইল সরকার গাজায় ইতিহাসের নিষ্ঠুরতম গণহত্যা চালাচ্ছে। কিন্তু এর সমাধান কোথায়! আমরা চূড়ান্ত ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংকটের সমাধান চাই। এ সংঘাত এখন কত শিশুর, কত মায়ের, কত নিরীহ পিতা বা সন্তানের জীবন নেবে! বিশ্ব মানবতা এ দায়ের ভার আর অপরাধ এড়াতে পারে না।

লেখক : ভূরাজনীতির গবেষক ও রাষ্ট্রচিন্তক

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত