
ক্রমাগত লোকসানে পাবনার ঐতিহ্যবাহী তাঁত শিল্প বিলীন হবার পথে। আয়-ব্যয়ের হিসাব না মেলায় তাঁত মালিকরা পেশা বদলাতে বাধ্য হচ্ছেন। কাঁচামালের (রং ও সুতা) দরবৃদ্ধি এবং তাঁতে বোনা কাপড়ের চাহিদা কমায় নিঃস্ব হয়েছেন অনেক তাঁত মালিকরা। ফলে ১০ বছরে পাবনা জেলায় দুই-তৃতীয়াংশ তাঁত কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। কয়েক হাজার মানুষ পেশা বদলেছে।
পাবনার তাঁতবোর্ডের তথ্য সূত্রে জানা গেছে, ২০১৮ সালের জরিপ অনুযায়ী পাবনা জেলায় তাঁতের সংখ্যা ছিল ২৩ হাজার ৯৭৫টি। ১১ হাজার শ্রমিক এর সঙ্গে জড়িত ছিলেন। পাবনা সদর, সাঁথিয়া ও সুজানগর উপজেলায় সবচেয়ে বেশি তাঁত কারখানা ছিল। ২০২৪ সালে তাঁতের সংখ্যা কমে দাঁড়িয়েছে প্রায় সাড়ে ১৬ হাজারে। এর মধ্যে অনেক তাঁত মালিক হয়েছেন শ্রমিক এবং পেশা বদলেছেন অনেকেই।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, ৮০ কাউন্টের ২১ হাজার টাকার সুতার দাম এখন ২৮ হাজার টাকা। ১৫০০ টাকার রঙের দাম হয়েছে ৪ হাজার টাকা। তাঁতে যাওয়ার আগে সুতা প্যাঁচানোর কাজের ২০০ টাকার শ্রমিকের মজুরি এখন ৪০০ টাকা। সবমিলিয়ে ২৫০ টাকার লুঙ্গির উৎপাদন খরচ বেড়ে ৩৫০ টাকায় উঠেছে। ব্যাংক লোনের জটিলতা ও সুদও বেড়েছে। এর বিপরীতে মানুষের পোশাক ব্যবহারে পরিবর্তন ও অন্যান্য কারণে আশঙ্কাজনক হারে কমেছে বিক্রি। তাঁতবোর্ড বা সরকারের পক্ষ থেকে এ শিল্প বাঁচাতে তেমন উদ্যোগ নেই। এভাবেই তাঁতের সোনালি দিনের গল্প নিঃশেষ হচ্ছে। অথচ পাবনার তাঁতের লুঙ্গির সুনাম বহু যুগের। সোনালি অধ্যায় ছিল। তবে এসব সুনাম ও ঐতিহ্য এখন শুধুই বইয়ের পাতায় স্থান পেতে চলেছে। নেই তাঁত বা তাঁতিদের রঙিন সুতোয় বোনা সেই সোনালি দিনের গল্প।
পাবনার তাঁতপল্লী খ্যাত সদর উপজেলার জালালপুর, চাচকিয়া, কুলনিয়া ও দোগাছিসহ তাঁতের সঙ্গে জড়িত জেলার দুই তৃতীয়াংশ মানুষ।
সদর উপজেলার দোগাছী ইউনিয়নে প্রায় ৮০-৯০ শতাংশ তাঁত ছিল। দুই বছর আগেও এ এলাকায় তাঁতের সংখ্যা ছিল ৫ হাজারের মতো। এসব তাঁতের ওপর নির্ভরশীল ছিল প্রায় ২০ হাজার পরিবার। তবে এখন সেদিন নেই। ব্যাপক লোকসানে দু’বছরে তাঁত কমেছে দেড় হাজার। পেশা হারিয়ে বিপাকে ৬ হাজার পরিবার।
তাঁত শ্রমিক লোকমান হোসেন জানান, ৫ বছর আগেও ১০টি তাঁতের মালিক ছিলেন তিনি। দারুণ রোজগারে পরিবার নিয়ে সুখের দিন ছিল তার। এখন তিনি শুধুই শ্রমিক। তিনি জানান, একদিকে সুতা ও রংসহ কাপড় তৈরির খরচ বৃদ্ধি, অন্যদিকে বাজারে কাপড়ের চাহিদা কম। এতে ব্যয়ের সঙ্গে আয়ের হিসাবের গরমিলে ২০ লাখ টাকা দেনা হয়ে দিশাহারা হয়ে পড়েন। পরে দেনা মেটাতে বাধ্য হয়ে সব তাঁত বিক্রি করে ৫০০ টাকা হাজিরায় কাজ করে জীবিকা চালাচ্ছেন।
অর্ধশত বছরের পুরোনো তাঁত ব্যবসায়ী আসাদুজ্জামান জানান, তাদের কারখানায় ৫০টি তাঁতে ২০০ শ্রমিক কাজ করতেন। এলাকায় অত্যন্ত সমৃদ্ধ জীবনযাপন ছিল তাদের। তবে লোকসানে ২ কোটি টাকার ঋণের বোঝা সইতে না পেরে তাঁত বিক্রি করে ব্যাংকলোন পরিশোধ করেন। এখন কোনোমতে জীবন জীবিকা চালাচ্ছেন।
সুজানগর উপজেলার সাতবাড়িয়া ইউনিয়নের কুড়িপাড়া এলাকার আজিজ কাজী বলেন, শুরুতে ব্যবসা ভালোই চলছিল। প্রথম ধাক্কাঁ খাই করোনায় কারখানা ও বেচাবিক্রি বন্ধ হওয়ায়। সেসময় অর্ধকোটি টাকার মতো লোকসান হয়। এরপর ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টাতেও কাজ হয়নি। উল্টো লোকসানে দেনা শুধু বাড়ছিল। পরে বাধ্য হয়ে ব্যবসা গুটিয়ে নিয়েছি।
তিনি আরও বলেন, কয়েক বছর আগেও এক গাতা (৪টি লুঙ্গি) ১৪০০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। এখন দাম কমে ১১০০-১২০০ টাকায় নেমেছে। সেখানে তাঁত চলবে কী করে?
সুজানগর উপজেলা তাঁত মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক আসাদুজ্জামান রোকন বলেন, ক্রমাগত লোকসানে তাঁতিরা সর্বস্বান্ত হয়েছেন। অনেক মালিক এখন শ্রমিক হিসেবে অন্যের কারখানায় কাজ করছেন। তিনি এই শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখতে রং-সুতার ন্যায্যমূল্য নিশ্চিতসহ প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিতে সরকারের কাছে অনুরোধ জানান।
এ ব্যাপারে তাঁতবোর্ডের পাবনার দোগাছি কার্যালয়ের লিয়াজোঁ কর্মকর্তা ফারুখ আহমেদ ও সাঁথিয়া কার্যালয়ের লিয়াজোঁ কর্মকর্তা বসুদেব চন্দ্র দাস বলেন, প্রতিবছর ধারাবহিকভাবে তাঁত কমেই চলেছে। বিভিন্ন সময় আমরা তাঁতিদের প্রণোদনা বা নানাভাবে পাশে দাঁড়াচ্ছি।
তবে উৎপাদন খরচ বৃদ্ধির কারণে তাঁতিরা পুষিয়ে উঠতে পারছেন না। ফলে কারখানা বন্ধ হচ্ছে। বিশেষ করে হস্তচালিত তাঁত একেবারেই কমে গেছে। এ শিল্পকে বাঁচাতে সরকারের উদ্যোগ গ্রহণ জরুরি। পাবনার জেলা প্রশাসক মো. মফিজুল ইসলাম বলেন, হস্তচালিত তাঁতের উৎপাদন সক্ষমতা কম। ফলে এটি থেকে সরে আসছেন তাঁতিরা। তবে আধুনিক পদ্ধতির তাঁত অনেক রয়েছে। এরপরও তাদের কোনো সমস্যা থাকলে সেগুলো জানালে আমরা শিল্প ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে সুরাহার চেষ্টা করবো।