ঢাকা ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ৪ ফাল্গুন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

সুন্দর ভবিষ্যতের জন্য জলাভূমি সংরক্ষণ করি

মো. তাহমিদ রহমান
সুন্দর ভবিষ্যতের জন্য জলাভূমি সংরক্ষণ করি

জাতি হিসেবে বাঙালির কাছে ১৯৭১ সাল একটি গুরুত্বপূর্ণ বছর। এই বছরেই স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে বিশ্ব মানচিত্রে বাংলাদেশ স্থান করে নেয়। একই বছরের ২ ফেব্রুয়ারি পৃথিবীব্যাপী সমুদ্রতটরেখা, সমান্তরাল ভূমি, সারিবদ্ধ পাহাড়-পর্বত, জলপ্রপাত, সবুজ ঘেরা বন-বনানী, নদী, হাওর-বাঁওড়, বিল-ঝিল, হ্রদ, জলাশয়কে সংরক্ষণ করতে ইরানের রামসার শহরে পরিবেশবাদীদের একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সে সম্মেলনে জলাভূমির আন্তর্জাতিক উপযোগিতার কথা তুলে ধরা হয়েছিল এবং জলাভূমি বিষয়ে চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়।

১৯৭৫ সালে সেই চুক্তি কার্যকর হয় এবং সেই সাথে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয় বিশ্বব্যাপী প্রতিবছর ২ ফেব্রুয়ারিকে ‘বিশ্ব জলাভূমি দিবস’ হিসাবে পালন করার। এ বছর ‘সুন্দর ভবিষ্যতের জন্য জলাভূমি সংরক্ষণ’ প্রতিপাদ্যকে সামনে রেখে বিশ্বব্যাপী পালিত হচ্ছে বিশ্ব জলাভূমি দিবস-২০২৫। এই প্রতিপাদ্যের সঙ্গে জলাভূমি হারিয়ে যাওয়া বন্ধ করতে এবং অবনমিত জলাভূমি পুনরুদ্ধারে আর্থিক, মানবসম্পদ ও রাজনৈতিক মূলধন বিনিয়োগের আহ্বান জানানো হয়েছে। ১৯৯২ সালে বাংলাদেশ এ চুক্তিতে সই করে। এখন পর্যন্ত ১৭২টি দেশ এ চুক্তি অনুমোদন করেছে। পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা, জীববৈচিত্র্য, কৃষি, মৎস্য, খাদ্যনিরাপত্তা, পর্যটনসহ নানা ক্ষেত্রে জলাভূমির ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। দেশে মোট ৩৭৩টি জলাভূমি আছে যার মোট আয়তন ৮,৫৮,৪৬০ হেক্টর। দেশের বৃহত্তম জলাভূমি চলনবিল, নওগাঁ বরেন্দ্রভূমির আন্ধাসুরা বিল, রাজশাহীর তানোরের বিলকুমারী, চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়ার গুমাই বিল, মুন্সীগঞ্জ ও ঢাকা জেলার তিনটি উপজেলায় বিস্তৃত আড়িয়ল বিল, খুলনার ডুমুরিয়া ও ফুলতলা উপজেলার ডাকাতিয়া বিল, গাজীপুর জেলার কালীগঞ্জ উপজেলার বেল্লা বিল, গোপালগঞ্জ ও মাদারীপুরে চান্দার বিল, সুনামগঞ্জ, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, সিলেট, নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জ এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়া এই সাতটি জেলায় প্রায় ৪৮টি বড় হাওর নিয়ে মোট ৪২৭টি হাওরভূমি আমাদের দেশের মোট জাতীয় উন্নয়নে এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। এই জলাভূমিগুলোর রয়েছে বিশেষ গুরুত্ব।

অবহেলায় পড়ে থাকা এই জলাভূমিগুলো অসংখ্য জীবের চারণ ও প্রজননক্ষেত্র, অনেক প্রাণীর নিরাপদ বাসস্থান, জলাভূমির তলদেশের সবুজ উদ্ভিদ, গাছের পাতা এবং অন্যান্য অংশের পচনক্রিয়ায় উৎপন্ন বায়োমাস থেকে মৎস্য প্রজাতির আশ্রয় ও খাদ্য সংস্থান হয়, জলাভূমির উপরিতল আমাদের পর্যাপ্ত পরিমাণে পানির যোগান দেয়, মাটির বিভিন্ন স্তরে পানি সরবরাহ করে, যাকে ‘ওয়াটার রিচার্জ’ বলা হয়। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে যখন পানির চাহিদা বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং বন্যা ও খরার ঝুঁকি বাড়ছে, তখন টেকসই উন্নয়নে জলাভূমির ভূমিকা আগের তুলনায় অনেক বেশি তাৎপর্যপূর্ণ। জলবায়ু পরিবর্তনের মূল কারণ যে কার্বন নিঃসরণ, তা কমানোরও এক প্রাকৃতিক পদ্ধতি জলাভূমিগুলো। এছাড়াও বন্যা নিয়ন্ত্রণ, জল বিশুদ্ধিকরণ, স্থানীয় জলবায়ুর স্থিতাবস্থা বজায় রাখা, কৃষিব্যবস্থায় সহযোগিতাসহ নানাভাবে উপকার করে জলাভূমি। এরইমধ্যে সুন্দরবন ও টাঙ্গুয়ার হাওরের জলাভূমি আন্তর্জাতিক মর্যাদা লাভ করেছে। জলাভূমির উদ্ভিদ, প্রাণী ও অণুজীবের সঙ্গে মাটি ও অন্যান্য জড় পদার্থের সম্পর্ককে বলা হয় জলাভূমির বাস্তুতন্ত্র।পৃথিবীর ৪০ শতাংশ প্রাণী ও উদ্ভিদ বাস করে জলাভূমিতে। উপকূলীয় জলাভূমি গ্রীষ্মমণ্ডলীয় বৃষ্টিস্নাত অরণ্যের চেয়ে ৫৫ গুণ বেশি দ্রুতগতিতে কার্বন সঞ্চয় করতে পারে। জলাভূমিতে জন্মানো ধানের ওপর পৃথিবীর প্রায় সাড়ে ৩০০ কোটি মানুষ নির্ভরশীল। পরিবেশ বিজ্ঞানীদের মতে, জলাভূমিগুলো পৃথিবীর সবচেয়ে বড় কার্বন রিজারভার। জলাভূমিতে পৃথিবীর প্রায় ৩ ভাগের ১ ভাগ টেরেস্ট্রিয়াল কার্বন জমা রয়েছে। যদি কোনো কারণে জলাভূমিগুলোর ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যায়, তাহলে বায়ুমণ্ডলে গ্রিনহাউজ গ্যাসের পরিমাণ বেড়ে যাবে। জলাভূমিগুলো কার্বন সিংক হিসাবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে।

বাংলাদেশের সংবিধানের ১৮ক এর অনুচ্ছেদে পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের কথা বলা হয়েছে-রাষ্ট্র বর্তমান ও ভবিষ্যৎ নাগরিকদের জন্য পরিবেশ সংরক্ষণ ও উন্নয়ন করিবেন এবং প্রাকৃতিক সম্পদ, জীববৈচিত্র্য, জলাভূমি, বন ও বন্যপ্রাণীর সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা বিধান করিবেন। যা সরকারের পরিবেশবান্ধব নীতির প্রতিফলন হিসেবে বিবেচনা করা যায়। কিন্তু দেশের বেশিরভাগ জলাভূমির গুণগত মান এখন ভালো নেই। বিশেষ করে নানা ধরনের বিপুল পরিমাণ দূষিত পদার্থ মিশে এসব জলাভূমি অনেক জায়গায় মানুষের জন্য স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি করেছে। জলাভূমির জন্য প্লাস্টিক বর্জ্যও বড় ধরনের হুমকি তৈরি করে চলেছে। জলাভূমিকে বলা হয় পৃথিবীর কিডনি। মানুষের কিডনির ওপর তার ক্ষমতার অতিরিক্ত চাপ প্রয়োগে যেমন তা বিকল হয়, তেমনি জলাভূমি পৃথিবীর কিডনি হিসেবে কাজ করলেও মানবসৃষ্ট নানা ধরনের বিপুল পরিমাণ বর্জ্যে তার ক্ষতি হচ্ছে। শীতকালে আমাদের দেশের জলাভূমি গুলোতে উত্তর মেরু, ইউরোপ, সাইবেরিয়া, রাশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চল, মঙ্গোলিয়া ও হিমালয়ের পাদদেশের দেশগুলো থেকে পরিয়া পাখি দলবেঁধে আসে। এ জলাভূমি গুলোতে অতিথি পাখি ল্যাঙ্গাহাঁস, গিরিয়াহাস ভূতিহাঁস, সুরচেরং, রাজস রাইল, পাতি সরাইল, ঠেঙ্গি মেটেমাথাটিটি, গেওলা বাটান, সৈকত, পালান, কাস্তেচরা, কালোমাথা, বেগুনি কালেম, পানমুরগি, নেউপিপি, দলপিপি, রাঙ্গাবক, পানকৌড়ি, মাছরাঙা, শামুক ভাংড়ি, গাংচিল ধনেশসহ বিলুপ্ত অনেক প্রজাতির পাখির দেখা মেলে। পশু-পাখি, মাছ জীববৈচিত্র্যের অভয়াশ্রমের কারণে জলাভূমিগুলো দেশ ও জাতির বড় সম্পদ। জলপর্যটনের ক্ষেত্রেও জলাভূমি গুলো অর্থনৈতিক উন্নয়নে শক্তিশালী হাতিয়ার। নগরজীবনে ডেভলপার বা প্রোমোটারদের কারণে জলাভূমি দিন দিন হ্রাস পাচ্ছে। নব্বই দশকের মাঝামাঝিতেও রাজধানীর শাহবাগ, শান্তিনগর, বাসাবো, রাজারবাগ, খিলগাঁও, শেরেবাংলা নগর, উত্তরা, কমলাপুরসহ বিভিন্ন এলাকায় ছিল ব্যক্তি মালিকানাধীন ও সরকারি জলাশয়। এসব এলাকার প্রকৃতিতে চোখ রাখলে মন প্রফুল্ল হয়ে উঠত। কিন্তু কয়েক দশকের ব্যবধানে এসব এলাকার প্রকৃতি ধ্বংস করে জলাশয়গুলোর বুকে গড়ে তোলা হয়েছে বিশাল অট্টালিকা। দ্রুত নগরায়নে নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে আমাদের দেশের অধিকাংশ জলাভূমি। শহরের জলাভূমি ভরাটের মাত্রা সবচেয়ে বেশি। জলাভূমি অপব্যবহারে এরইমধ্যে অনেক জলাভূমি হারিয়ে গেছে। বিকাশমান নগরায়ন ও শিল্পায়নের কারণে জলাভূমিগুলো শ্রেণি পরিবর্তন হয়ে আবাসিক ও বাণিজ্যিক অবকঠামোয় রূপান্তরিত হচ্ছে। উন্মুক্ত প্রাকৃতিক জলাশয়গুলোতে নিয়ন্ত্রণ বাঁধ দেয়ায় সেগুলো ডোবা ও নালায় পরিণত হচ্ছে। ফলে এসব জলাভূমির উপর নির্ভরশীল মানুষ ও জীববৈচিত্র্যের জীবনযাত্রা দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) গবেষণা অনুযায়ী তিন দশক আগে ঢাকার মোট আয়তনের ২০ শতাংশের বেশি এলাকায় জলাভূমি ছিল। এখন এর পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৩ শতাংশের নিচে। গত তিন দশকে রাজধানীর জলাভূমি ১৭ শতাংশ কমেছে। অন্যদিকে, কোনো শহরের বাসযোগ্যতা নিশ্চিতে সেই শহরের মোট ভূমির ১৫ শতাংশ সবুজ আচ্ছাদিত রাখা জরুরি। কিন্তু রাজধানীতে এখন সেটিও আছে মাত্র ৯ শতাংশ। নগর পরিকল্পনাবিদদের মতে, একটি শহরের ১০ থেকে ১৫ শতাংশ এলাকা জলাশয় থাকা প্রয়োজন। কিন্তু রাজধানী ঢাকার জলাশয়ের পরিমাণ মাত্র ৪ দশমিক ৩৮ শতাংশ তাও ভয়াবহ হুমকির সম্মুখীন। প্রাকৃতিক জলাধার সংরক্ষণ আইন-২০০০ অনুযায়ী কোনো পুকুর, জলাশয়, নদী, খাল ভরাট করা বেআইনি। এই বিধান লঙ্ঘন করলে আইনের ৮ ও ১২ ধারা অনুযায়ী ৫ বছরের কারাদণ্ড বা অনধিক ৫০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হতে পারে। কিন্তু আইন লঙ্ঘন করেই চলছে জলাশয় ভরাট। স্বাধীনতার দীর্ঘ ৫৪ বছর পেরিয়ে গেলেও এখনো আমরা জলাভূমির প্রতি যথাযথ দরদ ও দায়িত্ব দেখাতে পারিনি। দেশজুড়ে জলাভূমির অবস্থান, চরিত্র, স্বভাব ও জীবনপ্রণালী ভিন্ন ভিন্ন। পাহাড়ি অঞ্চলের ঝিরি, ঝরনা, হ্রদ, কুন্ড থেকে শুরু করে বিল, বাঁওড়, খাল, খাড়ি, বাইদ, হাওর সমতলের পুকুর, দিঘি থেকে শুরু করে নদীপ্রণালী কি সমুদ্র এই সবগুলো ভিন্ন ভিন্ন জলাভূমি জীবনে অভ্যস্ত জনজীবনের কাছে ব্যঞ্জনা ও সম্পর্কগুলো ভিন্ন ভিন্ন। জলাভূমিগুলো আমাদের এই বৃহৎ বদ্বীপের প্রাণবৈচিত্র্যের আঁতুড়ঘর। কিন্তু আমরা জলাভূমিগুলো সংরক্ষণ না করে উন্নয়নের নামে উল্টো ধ্বংস করে চলছি অনবরত। বাস্তুতাত্তিক ভারসাম্য বজায় রাখার জন্য দেশের জলাভূমিগুলো সংরক্ষণ করা প্রয়োজন। গত দুই দশকের বেশি সময় ধরে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা), পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন (পবা) এবং অন্যান্য পরিবেশবাদী সংগঠন পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় দেশের জলাভূমিগুলো সংরক্ষণ করতে বিচিত্র কর্মসূচি পালন করছে। দেশের আপামর জনসাধারণের প্রত্যাশা অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দেশের জলাভূমিগুলো সংরক্ষণে ‘জলাধার রক্ষা আইনের’ বাস্তব প্রয়োগ ঘটাবে।

প্রভাষক (তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি) নূরুল আমিন মজুমদার ডিগ্রি কলেজ, লাকসাম, কুমিল্লা

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত