বিংশ শতাব্দীর শেষ পর্যন্ত পাঠক মহলে কাগজে ছাপানো সংবাদপত্রের ব্যাপক কদর দেখা গেছে। দেশের সর্বত্র সংবাদপত্রের প্রচুর চাহিদা ছিল। বাসা-বাড়ি, অফিস-আদালত, বাস, লঞ্চ, বিমান, ট্রেন, হোটেল-রেস্তোরাঁ, বাসস্ট্যান্ড, লাইব্রেরিসহ সবখানেই সংবাদপত্রের অগণিত পাঠক দেখা যেতো। ১৯৭৬ সালে আমি যখন দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়ি তখন থেকেই আমার সংবাদপত্র পড়ার অভ্যাস গড়ে ওঠে। আমাদের পাশের বাসা মানে আতিকদের বাসায় ইত্তেফাক রাখা হতো। দৈনিক ইত্তেফাক ছিল, সে সময় খুবই জনপ্রিয় ও বহুল প্রচারিত একটি দৈনিক পত্রিকা। জনপ্রিয়তা ও প্রচারে এর সমকক্ষ কোনো দৈনিক তখন ছিল না। মনে পড়ে স্কুল থেকে ফিরেই বেলা ১১টার দিকে আতিকদের বাসায় ঢুকেই পত্রিকাটি পড়া শুরু করতাম। প্রথমেই চোখ বোলাতাম খেলার খবরের পাতায়। ইত্তেফাকের শেষ পাতা মানে অষ্টম পৃষ্ঠার বাম দিকে প্রথম দুই কলামজুড়ে খেলার খবর প্রকাশিত হতো। তখন ফুটবল ছিল খুবই জনপ্রিয় একটি খেলা। ঢাকা স্টেডিয়ামে প্রথম বিভাগ ফুটবল খেলা নিয়মিত হতো। মোহামেডান, আবাহনী, ওয়ান্ডারাস, বিজেআইসি, ওয়ারী, ব্রাদার্স ইউনিয়ন ইত্যাদি ক্লাব দলগুলো প্রথম বিভাগে ফুটবল খেলতো। অধিকংশ সমর্থকই আবাহনী ও মোহামেডান দুই শিবিরে বিভক্ত ছিল। আবাহনীর হয়ে খেলতেন কাজী সালাউদ্দিন, চুন্নু, নান্নু, টুটুল, আনোয়ার, হেলাল, অমলেশ, মোতালেব প্রমুখ, পক্ষান্তরে মোহামডানে খেলতেন মেজর হাফিজ, এনায়েত, বাটু, মঞ্জু, সান্টু প্রমুখ।
তাই খেলায় কে হারলো আর কে জিতলো তা জানার জন্য এতোটাই উদগ্রীব থাকতাম যে ইত্তেফাক হাতে নিয়ে প্রথমেই চলে যেতাম অষ্টম পাতায়। ইত্তেফাকের দ্বিতীয় পাতা ছিল সম্পাদকীয় পাতা। পাঠকদের চিঠিপত্রও একই পাতায় ডান দিকে ছাপা হতো। ৬ষ্ঠ পাতায় থাকত ছোট ছোট বিজ্ঞাপন যেমন- পাত্র পাত্রী, পড়াইতে চাই, সন্ধান চাই, ক্রয়-বিক্রয় ইত্যাদি। সপ্তম পাতা মানে শেষ পাতার আগের পাতায় স্থান পেতো সিনেমার বিজ্ঞাপন। ইত্তেফাক পত্রিকাটি প্রথম পর্যায়ে ১৯৪৯ সালে মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী এবং ইয়ার মোহাম্মদ খানের হাতে চালু হয়। তখন ইত্তেফাক ছিল একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা। পরবর্তীকালে মওলানা ভাসানী তোফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়াকে সম্পাদকের দ্বায়িত্ব প্রদান করেন। ১৯৫৩ সালের ২৪ ডিসেম্বর তোফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়ার সম্পদনায় ইত্তেফাক দৈনিক পত্রিকায় রূপান্তরিত হয়। ইত্তেফাক পত্রিকাটি পাকিস্তান আমলে সকল গণতান্ত্রিক আন্দোলনে জনমত গঠন করে বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে মূখ্য ভূমিকা রাখে। ভাষা আন্দোলন, ১৯৫৪ সালের সাধারণ নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের জয়লাভে গুরত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। সামরিক শাসক আইয়ুব খান ও ইয়াহিয়া খানের শাসন আমলের তীব্র বিরোধিতা করে। ১৯৬৯ সালে মানিক মিয়ার মৃত্যুর পর তার দুই পুত্র ব্যরিস্টার মইনুল হোসেন ও আনোয়ার হোসেন মনজুর পরিচালনায় পত্রিকাটি প্রকাশিত হয়। বর্তমানে দৈনিক ইত্তেফাকের সম্পাদক তাসমিমা হোসেন। ইত্তেফাক বাংলাদেশের সবচেয়ে প্রাচীন দৈনিক হিসাবে আজ ২০২৫ সালেও সুনামের সাথে টিকে আছে। নীচতলার খালাম্মা (লোনো ভাই, নাঈমের আম্মা) ছিলেন সাপ্তাহিক বেগম পত্রিকার নিয়মিত পাঠক। বেগম পত্রিকাটি বাংলা ভাষায় প্রকাশিত প্রথম নারী সাপ্তাহিক। ১৯৪৭ সালের ২০ জুলাই মোহাম্মদ নাসির উদ্দীনের সওগাত প্রেস থেকে পত্রিকাটি প্রথম আত্মপ্রকাশ করে। এর প্রথম সম্পাদিকা বেগম সুফিয়া কামাল। দীর্ঘদিন বেগম পত্রিকার সম্পাদকের দায়িত্বে ছিলেন বেগম নূরজাহান। সাপ্তহিক বেগম বর্তমানে মাসিক পত্রিকা হিসাবে কোনমতে টিকে আছে।
সহপাঠি বন্ধু মুশফিক বাবুদের বাসায় রাখা হতো দৈনিক বাংলা। দৈনিক বাংলায় রনবী’র টোকাই নামে ধারবাহিক কার্টুন চিত্র ছাপা হতো। টোকাই ছিল শিল্পী রফিকুন নবীর এক অসাধারণ সৃষ্টি। টোকাই কার্টুন দেখার জন্য প্রতিদিন অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতাম। তাই এক ফাঁকে বাবুদের বাসায় ঢুঁ মারতাম। রনবী’র আঁকা টোকাই কার্টুনগুলো ছিল খুবই হাস্যরসাত্মক পূর্ণ। শিল্পী রফিকুন নবী ওরফে রনবী’র টোকাই ছিল একজন কিশোর, তার বসবাস ছিল ফুটপাতে, পরনে থাকতো পুরোনো ছেড়া, ময়লা, ঢোলা ও হাঁটুর নিচ পর্যন্ত লম্বা একটি জামা। সে ডাস্টবিনের আবর্জনা থেকে ফেলে দেয়া বাতিল জিনিস টোকাত। তাই রনবী তার নাম দিয়েছিলেন টোকাই। ফুটপাতের এই কিশোর টোকাই-এর মুখ দিয়ে শিল্পী রফিকুন নবী সমাজের অসংগতিগুলো পাঠকের মাঝে তুলে ধরতেন। টোকাই কার্টুন পড়ে পাঠকরা নির্মল আনন্দ পেতেন। সে সময়কার কয়েকটি কার্টুনের কথা এখনো মনে পড়ে। এখন যেমন সড়কগুলো বিভিন্ন কারণে বার বার খোঁড়া হয়, ঠিক তেমনি ৪০ থেকে ৫০ বছর আগেও কম বেশি একইভাবে সড়কগুলো প্রায়ই খোঁড়া হতো। এ কারণে রনবী একটি কার্টুন চিত্র আঁকেন। কার্টুন চিত্রে দেখা যায় একটি গুরুত্বপূর্ণ সড়ক খোঁড়া হচ্ছে যেখানে সাইনবোর্ডে লেখা ‘টিঅ্যান্ডটি লাইন স্থাপনের কাজ চলিতেছে’। টোকাইর বন্ধু এ অবস্থা দেখে টোকাই কে জিজ্ঞাসা করলো- ‘এই রাস্তাডা তো মাত্র কয়েক মাস আগে পাকা করল, এখন আবার দেখতাছি টিঅ্যান্ডটি লাইন বসানোর কথা কইয়া নতুন রাস্তাডারে আবার খোঁড়তাছে, এক বারেইতো কামডা করতে পারতো বার বার না খুইড়া’। বন্ধুর কথা শুনে টোকাই উত্তর দেয় ‘আরে বোকা, হেরা কি কম বুঝে, একবারে যদি ওয়াসা, বিদ্যুৎ, টেলিফোনসহ সব কাজ কইরা ফালায় তাইলে কি আর হেগো কামাই হইবো? যতবার খুঁড়বো ততবার কামাইতে পারবো, তাই হেরা একবারে কাম শেষ করে না, বার বার করে আর বার বার খোঁড়াখুঁড়ি করে’। দৈনিক বাংলায় প্রকাশিত রনবী’র আরেকটি কার্টুনের কথা মনে পড়ে। কর্টুনটি ছিল খেলা নিয়ে। আশি দশকের শেষ দিকে এশিয়ান কাপ হকিতে বাংলাদেশ পাকিস্তানের কাছে ১৭-০ গোলে শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়। তখন রনবী’র চিত্রিত টোকাই কার্টুনটি ছিল নিম্নরূপ-
খবর : এশিয়া কাপে পাকিস্তানের কাছে বাংলাদেশ ১৭-০ গোলে পরাজিত। খবরটি দেখে টোকাই মন্তব্য করছে ‘বহির্বিশ্বে দেশকে পরিচিত করার এর চেয়ে আর সহজ পথ কোথায়।’ দৈনিক বাংলা ১৯৬৪ সালের ৬ নভেম্বর আত্মপ্রকাশ করে। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত দৈনিক বাংলার নাম ছিল দৈনিক পাকিস্তান। ১৯৭৫ সালে দৈনিকটি জাতীয়করণ করা হয়েছিল। ১৯৯৭ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে দৈনিক বাংলার প্রকাশনা বন্ধ করে দেওয়া হয়। পঁচিশ বছর পর ২০২২ সালে একই নামে ভিন্ন একটি পত্রিকা বের করা হলেও তা পাঠক মহলে মোটেও সাড়া ফেলতে পারেনি।
সত্তর দশকে আরো কয়েকটি বাংলা দৈনিক দেখা যেতো, তাদের মধ্যে- সংবাদ, সংগ্রাম, আজাদ, বাংলার বাণী ছিল উল্লেখযোগ্য। ইংরেজি দৈনিক ছিল- দ্য বাংলাদেশ অবজারভার, বাংলাদেশ টাইমস, নিউ নেশন ইত্যাদি সাপ্তাহিক পত্রিকা হিসেবে পাঠকপ্রিয়তা পেয়েছিল বিচিত্রা, রোববার, চিত্রালীর মতো ম্যাগাজিনগুলো। তখন শিশু-কিশোরদের জন্যও পত্রিকা প্রকাশিত হতো। সাপ্তাহিক কিশোর বাংলা ছিল- শিশু-কিশোরদের জন্য দারুণ এক জনপ্রিয় পত্রিকা। শিশু একাডেমি থেকে প্রকাশিত হতো মাসিক শিশু। বাংলা একাডেমি থেকে বের হতো ত্রৈমাসিক ধান শালিকের দেশ। কিশোর বাংলা, শিশু ও ধান শালিকের দেশে লিখে পরবর্তীতে দেশের নাম করা লেখক, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, ছড়াকার হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন অনেকেই। শিশু সাহিত্যিক আলী ইমাম, আবু সালেহ, ছড়াকার লুৎফর রহমান রিটন, সুকুমার বড়ুয়া, আহমাদ উল্লাহ, আমীরুল ইসলাম, আনজীর লিটন, ওয়াসিফ-এ-খোদা, সাংবাদিক ও ছড়াকার ওবায়দুল গনি চন্দন প্রমুখ তাদের অন্যতম।