ঢাকা বুধবার, ২৬ মার্চ ২০২৫, ১২ চৈত্র ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

নির্মল শৈশব কেড়ে নিল ধর্ষক!

মো. তাহমিদ রহমান
নির্মল শৈশব কেড়ে নিল ধর্ষক!

ক্ষমা ও অহিংসা পরম ধর্ম কিন্তু সব ক্ষেত্রে নয়। ঠিক তেমনি একটি ক্ষেত্র হলো ধর্ষণ। ধর্ষকের ক্ষেত্রে মানবিক সহানুভূতি কোনোভাবেই কাম্য নয়। পৃথিবীতে সবচাইতে অসামাজিক ও নিকৃষ্ট অপরাধ হল ধর্ষণ। যা সমাজে নারীদের নিরাপত্তা ও মর্যাদাকে হুমকিতে ফেলে দেয়। ধর্ষণের শিকার হওয়া নারী ও শিশু এই সমাজে যে মানসিক যন্ত্রণার শিকার হয় তা কল্পনাতীত। ধর্ষণের শিকার হওয়া নারী ও শিশু শুধু শারীরিক ক্ষতির সম্মুখীন হন না সেই সাথে মানসিকভাবে দীর্ঘমেয়াদি ট্রমা, বিষণ্ণতা, আত্মবিশ্বাসহীনতায় ভোগেন এবং কখনও কখনও আত্মহত্যা করতে বাধ্য হন। আইন ব্যবস্থার দুর্বলতা ও বিচারহীনতার কারণে ধর্ষণের শিকার হওয়া নারী ও শিশু ন্যায়বিচার পেতে ব্যর্থ হন, যা তাদের মানসিক অবস্থাকে আরও খারাপ করে। তাদের সাথে সমাজ ও প্রতিষ্ঠানগুলো এমন আচরণ করে যা ধর্ষণের যন্ত্রণা, গ্লানি ও অবসাদকে বহু গুণ বাড়িয়ে দেয়। ইদানীং পত্রিকার পাতা খুললে কিংবা টিভির সংবাদের দিকে দৃষ্টিপাত করলে প্রায়ই চোখে পড়ে ধর্ষণ ও ধর্ষণ-পরবর্তী হত্যাবিষয়ক খবরাখবর। এ সংক্রান্ত খবর পড়তে পড়তে মানুষের মন যেন আজ রীতিমতো বিষিয়ে উঠেছে। ঠিক এমন সময়ে গত বৃহস্পতিবার আপন বড় বোনের জামাই ও শ্বশুরের দ্বারা মাগুরা শহরতলীর নিজনান্দুয়ালী গ্রামে ৮ বছরের এক শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। এই ধর্ষণের খবর যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচারিত হবার পর ফুঁসে উঠেছে সারা দেশ। প্রতিবাদে পথে নেমেছেন নারীসমাজ ও শিক্ষক-শিক্ষার্থীসহ বিভিন্ন শ্রেণির মানুষ। পুলিশ এ ঘটনায় চার জনকে আটক করেছে। সাম্প্রতিক সময়ে শিশুর প্রতি যৌন নির্যাতন একটি নীরব মহামারি হয়ে দাঁড়িয়েছে, যা পরিবার-সমাজে সব সময় গোপনে ঘটছে।

অভিভাবকরা এই যৌন নিপীড়নের ঘটনা সব ক্ষেত্রে যে জানেন না বা বুঝতে পারেন না, তা নয়। অনেক সময় জানলেও পারিবারিক ও সামাজিক লজ্জার কারণে চুপ করে থাকেন। শিশুরা বাইরের মানুষের দ্বারা নয়, বরং পরিবারের খুব কাছের মানুষের দ্বারা যৌন নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। পরিসংখ্যান বলছে, ৭ থেকে ১৩ বছরের শিশুরা সবচেয়ে বেশি যৌন হয়রানির শিকার হয়। যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল সেন্টার ফর মিসিং অ্যান্ড এক্সপ্লয়টেড চিলড্রেনে (এনসিএমইসি) সংস্থার মতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে শিশুদের যৌন হয়রানি সম্পর্কে যত প্রতিবেদন পাঠানো হয়েছে, তার মধ্যে বাংলাদেশ শীর্ষে। বিভিন্ন দেশ থেকে গত বছর মোট ৩ কোটি ২০ লাখ প্রতিবেদন এনসিএমইসিতে গেছে যেখানে শিশু যৌন হয়রানির তালিকায় বাংলাদেশের পরের অবস্থানে আছে যথাক্রমে যুক্তরাষ্ট্র, থাইল্যান্ড, নাইজেরিয়া, ফ্রান্স ও ডমিনিকান রিপাবলিক। মনোরোগ বিশেষজ্ঞদের মতে পেডোফিলিয়া একটি মানসিক বা যৌন আচরণগত সমস্যা যা মূলত শিশুদের প্রতি যৌন আগ্রহের প্রতি মনোযোগ আকর্ষণ করে। এটি একটি গুরুতর এবং সামাজিকভাবে অগ্রহণযোগ্য আচরণ হিসেবে বিবেচিত হয়। পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় ২০২৫ সালে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে ২৯৫টি নারী ও শিশু নির্যাতনের ঘটনা সংঘটিত হয়েছে, যা গত মাসের তুলনায় ২৪টি বেশি। ফেব্রুয়ারি মাসে ধর্ষণের শিকার হয়েছে ৫৭টি, সংঘবদ্ধ ধর্ষণ ১৭টি, ধর্ষণ ও হত্যার ঘটনা ঘটেছে দুটি এর মধ্যে প্রতিবন্ধিতা বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন শিশু, কিশোরীও রয়েছে। ধর্ষণের শিকার ৫৭ জনের মধ্যে ১৬ জন শিশু, ১৭ জন কিশোরী, অপরদিকে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ৩ জন কিশোরী ও ১৪ জন নারী এবং ধর্ষণ ও হত্যার শিকার হয়েছেন ২ জন নারী। এ ছাড়া ধর্ষণের চেষ্টা ১৯টি, যৌন হয়রানি ২৬টি, শারীরিক নির্যাতনের ৩৬টি ঘটনা ঘটেছে। ফেব্রুয়ারি মাসে ২ জন শিশু, ১২ জন কিশোরী ও ৩৪ জন নারীসহ মোট ৪৮ জন আত্মহত্যা করেছেন। গতমাসে অপহরণের শিকার হয়েছেন ৩ জন শিশু, ২ জন কিশোরী ও ৫ জন নারী, অপরদিকে ২ জন শিশু, ৩ জন কিশোরী ও ৩ জন নারী নিখোঁজ রয়েছেন। এ ছাড়া গতমাসে ১ জন শিশু, ২ জন কিশোরী ও ৬ জন নারীর অস্বাভাবিক মৃত্যুসহ মোট ৬৫ জন শিশু, কিশোরী ও নারী হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন। যার মধ্যে ২৬ জন শিশু ও কিশোরী রয়েছেন। মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) সর্বশেষ (৩১ ডিসেম্বর, ২০২৪) পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২৪ সালে সারা দেশে ধর্ষণ ও দলবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয়েছে মোট ৪০১ জন নারী। এর মধ্যে ধর্ষণ পরবর্তী হত্যার শিকার হয়েছেন ৩৪ জন এবং ধর্ষণের পর আত্মহত্যা করেছেন ৭ জন। ধর্ষণের চেষ্টার শিকার হয়েছেন ১০৯ জন। এর মধ্যে ধর্ষণের চেষ্টার পর হত্যা করা হয় ১ জনকে। আসক-এর তথ্যানুযায়ী, ২০২০ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২৪ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত সময়ে ৪ হাজার ৭৮৭টি ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। ২০২০ সালে এ পরিসংখ্যান ছিল ১ হাজার ৬২৭ জন। পরিসংখ্যান অনুযায়ী দেখা যাচ্ছে, ধর্ষণের পরিমাণ দিন দিন তুমুল বেগে বেড়েই চলছে। বাংলাদেশে গড়ে প্রতি ৯ ঘণ্টায় একটি করে ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। বিভিন্ন সময়ে গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন বিশ্লেষণে দেখা যায়, গত চার বছরে বাংলাদেশে প্রতিদিন অন্তত দুজন নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। সামাজিক অবক্ষয়, মাদকের বিস্তার, কর্মহীনতা, আকাশ সংস্কৃতির নেতিবাচক প্রভাব, আইনের সঠিক প্রয়োগ না থাকা, পর্নোগ্রাফির অবাধ প্রসার; সর্বোপরি নারীর প্রতি পুরুষের হীন দৃষ্টিভঙ্গির কারণে দিন দিন আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে নারী ও শিশু ধর্ষণের ঘটনা। কয়েকমাস আগে ব্যস্ততম নগরী ঢাকার ব্যস্ততম ফুটপাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রী ধর্ষিত হন, এর ঠিক এক সপ্তাহ পরেই এক গার্মেন্টস কর্মীকে গণধর্ষণ করা হয়। সিলেটে স্বামীর সঙ্গে ঘুরতে বেরিয়ে গণধর্ষণের শিকার হন এক তরুণী। নোয়াখালীর বেগমগঞ্জে নিজগৃহে মধ্যযুগীয় কায়দায় এক গৃহবধূকে ধর্ষণ ও বিবস্ত্র করে মর্মান্তিকভাবে নির্যাতন করা হয় এবং সেটার ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়া হয়। ২০১৬ সালে দিনাজপুরে যৌনাঙ্গ ব্লেড দিয়ে কেটে পাঁচ বছরের এক শিশুকে ধর্ষণ করেন প্রতিবেশী সাইফুল ইসলাম। অপরাধ প্রমাণিত হওয়ায় সাইফুলের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়।

পরবর্তীতে আদালত থেকে জামিন নিয়ে দিনাজপুর জেলা কারাগার থেকে মুক্ত হয়েছে সেই নররাক্ষস। একই বছরের ৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবসের দিনে গাজীপুরের শ্রীপুরে আরেকটি শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছিল। বনের ভেতর নির্জন স্থানে আরমান মিয়া নামের এক ব্যক্তি শিশুটিকে ধর্ষণ করে সে দৃশ্য মুঠোফোনে ধারণ করেছিল। পরবর্তীতে সেই আরমানকে গণপিটুনি দিয়ে এলাকাবাসী পুলিশের জিম্মায় দেন। একটার পর একটা ধর্ষণের খবরের সমান্তরালে যদি একটার পর একটা ধর্ষকেরও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির খবর শোনা যেত তাহলে দেশে ধর্ষণের পরিমাণ শূন্যের কোঠায় নেমে আসত। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, কোনো আমলেই একটিও ধর্ষণ ঘটনার দৃষ্টান্তমূলক বিচার হয়নি। যে কোনো রাজনৈতিক, সামাজিক, প্রাকৃতিক অস্থিরতার সময় নারী ও শিশুর প্রতি যৌন সন্ত্রাস বাড়ে। এখন আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নাজুক। ৫ আগস্টের পর অনেক কয়েদি পালিয়েছেন। এখন নারীবিদ্বেষী প্রচারও বাড়ছে। আর বিচার না হওয়ার দীর্ঘদিনের সংস্কৃতি তো এ দেশে রয়েছেই। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন-২০০০ (সংশোধিত ২০২০) অনুযায়ী, আমাদের দেশে ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি ‘মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ড।’ এমন কঠোর আইন থাকা সত্ত্বেও রীতিমতো একের পর এক ধর্ষণের ঘটনা ঘটেই চলছে। দিন দিন ধর্ষণের পরিমাণ বেড়ে যাওয়ার অন্যতম কারণ হলো, আইনের সঠিক বাস্তবায়ন না হওয়া। ধর্ষণের আইনে (সর্বশেষ সংশোধিত) মামলার বিচারকার্য শেষ করতে সর্বোচ্চ ১৮০ দিন বা ছয় মাসের বাধ্যবাধকতা থাকলেও তা কখনো কার্যকর হয়নি। শিশু আছিয়া ধর্ষণের শিকার হলে সারা দেশ যখন ধর্ষকের শাস্তির দাবিতে উত্তাল হয়ে উঠে তখন আইন উপদেষ্টা অধ্যাপক আসিফ নজরুল সাংবাদিকদের বলেছেন, ধর্ষণ ও নারী নির্যাতনের মামলার ক্ষেত্রে বিদ্যমান আইন পরিবর্তন করে তদন্তের সময় ৩০ থেকে কমিয়ে ১৫ দিন করা হচ্ছে। আর ধর্ষণের মামলার বিচার ১৮০ দিনের পরিবর্তে ৯০ দিনের মধ্যে শেষ করা হবে। ধর্ষণের মামলায় ডিএনএ সনদ প্রয়োজন হয়। অংশীজনদের সঙ্গে আলাপ করে এ বিষয়ে সংশোধনী আনা হবে। উপযুক্ত ক্ষেত্রে বিচারক যদি মনে করেন, শুধু চিকিৎসা সনদের ভিত্তিতে এ মামলার তদন্ত ও বিচারকাজ পরিচালনা সম্ভব, তাহলে তিনি সে রকম ব্যবস্থা নিতে পারবেন। মানুষের আইন মানার প্রধান কারণ হলো শাস্তির ভয়। আর এর ফলে মানুষ নিজেকে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়াতে ভয় পায়। কিন্তু মানুষ যখন দেখে সে অপরাধ করেও পার পেয়ে যাচ্ছে, তাকে কোনো বিচার বা শাস্তির সম্মুখীন হতে হচ্ছে না, তখন সে আর কোনো আইনকে তোয়াক্কা করে না, তার মাঝে কোনো শাস্তির ভয় থাকে না। আর তখনই অপরাধ দুর্বার বেগে বেড়ে চলে।এখন দেখার পালা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের এই আমলে আদালত নরপিশাচ ধর্ষকদের জন্য কি শাস্তির ব্যবস্থা করে। প্রতিটি ধর্ষক সমাজ ও রাষ্ট্রের জঞ্জাল।

তাদের সর্বোচ্চ শাস্তি দেশের প্রতিটি শান্তিকামী মানুষের কাম্য। সমাজ ও রাষ্ট্র যদি ধর্ষকদের সর্বোচ্চ শাস্তি সুনিশ্চিত করতে পারে তাহলে সমাজ এবং রাষ্ট্রে ধর্ষণ উল্লেখযোগ্যহারে কমবে।

যে কোনো দুর্যোগে জাতির পরিত্রাণের একমাত্র উপায় ঐক্য- ধর্ম-বর্ণ-দল-মত নির্বিশেষে সব শ্রেণি-পেশার মানুষের ঐক্য।বর্তমানে রাষ্ট্রের ঘাড়ে অনেক বড় দূর্যোগ হয়ে দেখা দিয়েছে ধর্ষণ তাই আমাদের সকলের অগ্রাধিকার ভিত্তিতে সর্বনিম্ন সময়ে ধর্ষকের সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করা জরুরি কর্তব্য হয়ে দাড়িয়েছে। ধর্ষণ তথা যৌন নির্যাতন হ্রাসের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় ভূমিকা পালন করতে হবে রাষ্ট্রকে। রাষ্ট্রে যখন আইনের শাসন থাকে, ন্যায়বিচার থাকে, মানুষের মনে শান্তি থাকে, তখন অপরাধের মাত্রা থাকে খুব কম। ধর্ষণের মতো জঘন্য অপরাধের জন্য ধর্ষকের ফাঁসি বা মৃত্যুদন্ডের মতো ভয়াবহ ও চরম শাস্তি দরকার। এ ব্যাপারে বিকল্প কিছু ভাবার বিন্দুমাত্র অবকাশ নেই।

প্রভাষক (তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগ), নূরুল আমিন মজুমদার ডিগ্রি কলেজ, লাকসাম, কুমিল্লা।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত