বর্তমান সভ্যতায় প্লাস্টিক নামক বস্তুটির সঙ্গে মানুষের পরিচয় আছে, ‘সখ্যতা’ আছে। মোট কথা মানুষের কাছে এটি অতিমাত্রায় গ্রহণযোগ্য। ঠিক যতটা আমরা পলিথিন ব্যবহার করতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করি! প্লাস্টিকের অতিক্ষুদ্র কণা যা বিভিন্নভাবে বিশেষত খাদ্যের মাধ্যমে আমাদের শরীরে প্রবেশ করছে এবং শরীরের ক্ষতিসাধন করছে। আমরা বাজার থেকে যে ফেসওয়াশ, টুথপেস্ট, প্লাস্টিকের ব্যাগ, স্ট্র, ছোট বোতল, ফেসিয়াল স্ক্রাব বা এ ধরনের ছোট ছোট পণ্য ব্যবহার করছি এসব পণ্যই পরিবেশকে হুমকির মুখে ফেলছে। সকালে ঘুম থেকে উঠে যে টুথপেস্ট ব্যবহার করছি আবার রাতে ঘুমানোর আগেও তা ব্যবহার করছি, সেসব শেষ হলে তো তা ফেলে দেই যেখানে সেখানে। আর প্লাস্টিক থেকে সৃষ্ট মাইক্রোপ্লাস্টিক এখন দুশ্চিন্তার অন্যতম কারণ। যুক্তরাষ্ট্রের বিজ্ঞানীরা প্রথমবারের মতো মানুষের মস্তিষ্কে মাইক্রোপ্লাস্টিক খুঁজে পেয়েছেন। যদিও অন্য বিজ্ঞানীরা এখনও এই গবেষণা ভালোভাবে যাচাই করেননি, তবে গণমাধ্যমে এটিকে উদ্বেগজনক বলে দাবি করা হচ্ছে।
বিজ্ঞানীদের ধারণা, মস্তিষ্কে রক্তপ্রবাহ বেশি বলে রক্তের মাধ্যমে মস্তিষ্কে মাইক্রোপ্লাস্টিকের কণা পৌঁছাতে পারে। পাশাপাশি লিভার ও কিডনি হয়তো এসব ক্ষতিকর কণা দেহের বাইরে বর্জ্য হিসেবে বের করে দিতে পারে; কিন্তু মস্তিষ্ক পারে না। গবেষণায় দেখা গেছে, ২০১৬ থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে মস্তিষ্কের নমুনায় প্লাস্টিকের পরিমাণ বেড়েছে প্রায় ৫০ শতাংশ। পরিবেশে প্লাস্টিক যত বাড়ছে, আমাদের শরীরেও তত বেশি ঢুকছে। গবেষণায় পাওয়া মাইক্রোপ্লাস্টিকের বেশিরভাগ পলিথিন দিয়ে তৈরি। ২০২৩ সালের আগস্টে নেদারল্যান্ডসের সায়েন্স অব দ্য টোটাল এনভায়রনমেন্ট সাময়িকীতে প্রকাশিত গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ ও ভারতের গঙ্গা অববাহিকা অঞ্চলের পানি, পলি এবং বাতাসে মাইক্রোপ্লাস্টিকের আশঙ্কাজনক উপস্থিতি দেখা গেছে। গঙ্গা অববাহিকার নদীর প্রতি ২০ লিটার পানিতে অন্তত একটি মাইক্রোপ্লাস্টিকের কণা পাওয়া গেছে। প্রতি কিলোগ্রাম পলিতে মিলেছে ৫৭টি কণা। আর বাতাসে প্রতি বর্গমিটারে মাইক্রোপ্লাস্টিকের কণার সংখ্যা ছিল ৪১।
গবেষণায় অনুমান করা হয়েছে, গঙ্গানদী এবং এর উপনদীগুলোর মাধ্যমে প্রতিদিন ১০০ থেকে ৩০০ কোটি মাইক্রোপ্লাস্টিকের কণা বঙ্গোপসাগরে যাচ্ছে। মাইক্রোপ্লাস্টিকের উপাদানের মধ্যে সবচেয়ে বেশি পাওয়া গেছে রেয়ন। ২০২৩ সালের জুনে প্রকাশিত এক গবেষণায় দেখা গেছে, গত কয়েক বছরে দেশে উৎপাদিত সামুদ্রিক লবণে ক্ষতিকর মাইক্রোপ্লাস্টিকের পরিমাণ বেড়েছে। নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (নোবিপ্রবি) গবেষকরা কক্সবাজার ও চট্টগ্রামের ১২টি লবণ উৎপাদনকারী স্থান থেকে সংগ্রহ করা কাঁচা লবণের প্রতি কেজিতে ৫৬০ থেকে ১ হাজার ২৫৩টি প্লাস্টিক কণা শনাক্ত করেছেন। এর আগে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ ও বিজ্ঞান বিভাগের এক গবেষণায় ১৫ প্রজাতির দেশি মাছে প্লাস্টিকের ক্ষুদ্র কণার সন্ধান পাওয়া গেছে। ‘অ্যাবান্ড্যান্স, ক্যারেক্টিরিস্টিকস অ্যান্ড ভেরিয়েশন অব মাইক্রোপ্লাস্টিক ইন ডিফারেন্ট ফ্রেশ ওয়াটার ফিশ স্পিস ফ্রম বাংলাদেশ’ শিরোনামে পরিবেশবিষয়ক আন্তর্জাতিক জার্নাল ‘সায়েন্স অব দ্য টোটাল ইনভায়রমেন্ট’ প্রকাশিত গবেষণায় এ তথ্য জানা যায়। যে মাছগুলোতে এ কণা পাওয়া গেছে সেগুলো হলো- তেলাপিয়া, কালিবাউশ, টেংরা, কই, বাটা, রুই, বেলে, কমন কার্প, পাবদা, পুুঁটি, রায়না, শিলং, বাইন, টাটকিনি ও বাছা মাছে। এর আগে দেশে সুস্বাদু পানির কোনো মাছে প্লাস্টিক কণার উপস্থিতি পাওয়া যায়নি। এ ছাড়া সামুদ্রিক মাছের পরিপাকতন্ত্রে প্লাস্টিক কণার উপস্থিতি পাওয়া গিয়েছিল। আবার প্লাস্টিক বর্জ্যরে ওপর ২৪টি গবেষণা প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে গত বছর মার্চে সায়েন্স অব দ্য টোটাল এনভায়রমেন্ট জার্নালে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়, প্লাস্টিকের অতিক্ষুদ্র কণা মাছসহ নানা প্রাণীর দেহে প্রবেশ করছে।
খাদ্যচক্রের মাধ্যমে তা মানুষের শরীরে প্রবেশ করছে। এর সঙ্গে বাংলাদেশে উৎপাদিন লবণেও মানব শরীরের জন্য ক্ষতিকারক মাইক্রোপ্লাস্টিকের অস্তিত্ত্ব পাওয়া গেছে। ‘প্রোলিফারেশন অব মাইক্রোপ্লাস্টিক ইন কমার্শিয়াল সি সল্টস ফ্রম দি ওয়ার্ল্ডস লংগেস সি বিচ অব বাংলাদেশ’ শীর্ষক এক গবেষণায় দেখা যায় যে, এ লবণের প্রতি কেজিতে গড়ে প্রায় ২ হাজার ৬৭৬টি মাইক্রোপ্লাস্টিক রয়েছে। সেখানে বলা হয়, দেশের মানুষ যে হারে লবণ গ্রহণ করে তাতে প্রতি বছর একজন মানুষ গড়ে প্রায় ১৩ হাজার ৮৮টি মাইক্রোপ্লাস্টিক গ্রহণ করে।
২০১৫ সালে দ্বিতীয় জাতিসংঘ পরিবেশ সম্মেলনে পরিবেশ দূষণ ও পরিবেশ বিজ্ঞান গবেষণার ক্ষেত্রে দ্বিতীয় বৃহত্তর বৈজ্ঞানিক সমস্যা হিসেবে উল্লেখ করা হয় মাইক্রোপ্লাস্টিককে। এর চেয়েও মাইক্রোপ্লাস্টিক নিয়ে ভয়াবহ তথ্য সামনে এসেছে। প্রথমবারের মতো মানুষের রক্তে মাইক্রোপ্লাস্টিক খুঁজে পেয়েছেন গবেষকরা। গবেষকরা জানায়, পরীক্ষায় প্রায় ৮০ শতাংশ মানুষের রক্তে এই প্লাস্টিক ক্ষুদ্র কণার উপস্থিতি খুঁজে পাওয়া গেছে। গত ২৪ মার্চ গার্ডিয়ান জানায়, বিজ্ঞানীরা গবেষণায় দেখেছেন যে, কণাগুলো মানুষের শরীরে চলাচল করতে পারে এবং বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে জায়গা করে নিতে পারে। মাইক্রোপ্লাস্টিকের কারণে নানা ধরনের শারীরিক সমস্যা হতে পারে মানুষের শরীরে। নতুন এক গবেষণায় স্ট্রোক বা মিনিস্ট্রোকে আক্রান্ত ব্যক্তিদের ঘাড়ের রক্তনালিতে প্লাস্টিক কণার পরিমাণ বেশি পাওয়া গেছে।