আমার শিরোনাম দেখে অনেকে আঁতকে উঠতে পারেন। মনে মনে ভাবতে পারেন কতবড় নেমকহারাম সন্তান, যে নিজের মাকে বলছে আমার শ্রমিক মা। হ্যাঁ আমি স্বজ্ঞানে সুস্থ মস্তিষ্কে আবারও বলছি আমার শ্রমিক মা। জন্মের পর যখন থেকে বুঝতে শিখেছি তখন থেকেই আমার মাকে দেখছি সকাল থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত কাজ করে চলছেন। রাস্তার ট্রাকের তেলের ট্যাঙ্কে যখন লেখা দেখি জন্ম থেকেই জ্বলছি, তখন ভাবি আমার মায়ের কথা, তিনি তো জন্ম থেকেই শ্রমিক হয়ে কাজ করে চলছেন। বিয়ের আগে নিশ্চয়ই নানির রান্নার কাজ থেকে শুরু করে বাড়ির সব কাজে সহযোগিতা করতেন, বিয়ের পর নিজের সংসারে। এ যেন বিয়ের আগে রাজমিস্ত্রির জোগালে এবং বিয়ের পর সরাসরি হেড মিস্ত্রির দায়িত্বে, তবে এখানে তিনি কোনো জোগালে বা সহযোগী পাননি। বড় গৃহস্ত ঘরের বউ হিসেবে সারাবছর গৃহস্থালি কাজের পাশাপাশি শিক্ষক স্বামীর জোগাল গোছালের সঙ্গে সঙ্গে চার বাচ্চার দেখা শোনা, পড়াশোনা করাতে গিয়ে শ্রমিকই থেকে গেলেন জীবনভর। সরকারি বেতনভুক্ত শ্রমিক হলে ঊনষাট বছরে মিলত মুক্তি। বেসরকারি কিম্বা গার্মেন্টস শ্রমিক হলে বয়সের কারণে অনেক আগেই বাদ পড়তেন কাজের অযোগ্য শ্রমিক হিসেবে। কিন্তু গৃহস্থ ঘরের বউ হয়ে শ্রমিক হিসেবে জীবন চলার পথে প্রায় সত্তর বছরের কাছাকাছি হলেও নেই কোনো অবসর বা মুক্তি। নববধূ হয়ে কাজ করেছেন শ্বশুর-শাশুড়ির মনকে খুশি রাখতে, সন্তানদের মা হবার পর মনযোগ দিয়েছেন নিজের সংসার সাজাতে, অক্লান্ত পরিশ্রম করে গেছেন সন্তানদের ভালোভাবে মানুষ করে গড়ে তুলতে। মুয়াজ্জিনের আজানের সঙ্গে সঙ্গে ঘুম থকে উঠে ফজরের নামাজ পড়ে দিন শুরু হলেও এশার নামাজের সঙ্গে সঙ্গে শেষ হয় না দিনের। মধ্যরাতে যখন চারিদিকে সুনসান নিরবতা, মাঝে মধ্যে পাখি ডেকে ওঠে আপন মনে তখনও মা আমার থাকে কল পাড়ে সারা দিনের ব্যবহৃত থালাবাসন ধোয়া নিয়ে। মা হয়তো তখন আপন মনে ভাবতে থাকে জীবন যাচ্ছে চলে জীবনের নিয়মে। মধ্যবিত্ত গৃহস্ত পরিবারের কর্তী হিসেবে মাঠ ঘাট, ফল ফসল আর গাছপালার দেখাশুনা করতে করতে সময় চলে যায় আপন গতিতে। শ্রমিকের নির্ধারিত কর্মঘণ্টা সাপ্তাহে চল্লিশ ঘণ্টা থাকলেও আমার মা সেটা করেন মাত্র দুই থেকে আড়াই দিনে। আমার মা শ্রমিক হিসেবে হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে আমাদের করেছেন অফিসার। আমরা যখন শীতাতপ নিয়ন্ত্রক অফিসে বসে ফাইল দেখি আর ভাবতে থাকি বড্ড পরিশ্রম হয়ে যাচ্ছে, আমার মা তখন হয়তো তপ্ত রোদে কাঁচা পাট শুকাচ্ছেন, না হলে ধান শুকাচ্ছেন বাড়ির উঠানে। আমার মা এতো এতো কাজের মধ্যে আমাদের জন্য আমের আচার, তেঁতুলের আচার, মুড়ি চিড়া, আম জাম, কলা কাঁঠাল যত্ন করে ঢাকায় পাঠান। বাবা-মা গরু কিম্বা মুরগির গোশত খেতে গিয়ে কলিজাটুকু আলাদা করে রেখে দেন কলিজার সন্তানদের কথা মনে করে। কলিজার সন্তানরা বাড়ি গিয়ে তার সামনে কলিজা খেলে তার নিজের কলিজা ঠান্ডা হবে এই আশায়। আমরা ঢাকা থেকে মাত্র আড়াই বা তিন ঘণ্টার জার্নি করে বাড়িতে গিয়ে এত ক্লান্ত হয়ে যাই যে কয়েকদিন লাগে সেই ক্লান্ত কাটিয়ে উঠতে, অথচ আমার মা পচাত্তর সাল থেকে মানে কাঁটায় কাঁটায় পঞ্চাশ বছর এই সংসারে খেটে চলেছেন শ্রমিকের মতো, তার কোনো ক্লান্তি নেই, অবসর নেই, নেই বিশ্রামের অযুহাত খোঁজার পাঁয়তারা। তিনি শুধু জানেন ছুটতে হবে, খাটতে হবে, প্রিয় সন্তানদের ভালো রাখতে হবে। তিনি আমৃত্যু আজীবন খেটে যাচ্ছেন প্রিয় স্বামী সন্তান আর সংসারের জন্য। দীর্ঘ এগার বছর যাবত অসুস্থ শয্যাশায়ী স্বামীকে সেবা দিয়ে যাচ্ছেন নার্সের মতো, সমাজের মানুষের পাশে দাঁড়ান মাদার তেরেসার মতো, ইস্পাত কঠিন সততা আর পরিশ্রম করে যাচ্ছেন আগামীর বংশধরদের জন্য। শ্রমিক মায়ের সন্তান হিসেবে আমরা কর্মক্ষেত্রের কারণে সবাই ঢাকায় অবস্থান করার ফলে ( বড় বোন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক, আমি জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ডেপুটি রেজিস্ট্রার, ছোট বোন গৃহিণী এবং ছোট ভাই জনতা ব্যাংক কর্মকর্তা) হয়তো সবসময় সেবা যত্ন, খোঁজ-খবর নিতে পারি না, তবে এই যান্ত্রিক শহরে বসবাস করলেও মনটা পড়ে থাকে শ্রমিক মায়ের আঁচল তলে, যে আঁচলের ছায়ায় নির্বিঘ্নে জীবনের বৃহৎ সময় পার করে দিলাম, মা তুমি আছো বলে আজো নিশ্চিন্ত মন ঘুমায় আর ঘুরে বেড়ায়, জানি তুমি আমাদের বটবৃক্ষ, আমাদের ছায়া দিবে, বাঁচার অক্সিজেন দিবে, বিপদে নিজের কোলে আশ্রয় দিবে। তোমাকে কখনও সামনা-সামনি বলা হয়নি মা তোমাকে অনেক ভালোবাসি। তোমার স্বামী সন্তান নাতি পুতি সবাই তোমাকে বড্ড বেশি ভালোবাসে। ডিজিটাল যুগ আর ব্যস্ততার কারণে হয়তো তোমাকে বেশি সময় দেওয়া হয় না, তবে তোমার জন্য মন অনেক কাঁদে। আল্লাহর কাছে দোয়া করি আল্লাহপাক তোমাকে অনেক অনেক বছর বাঁচিয়ে রাখুক স্বামী-সন্তানসহ। চাকরি থেকে অবসর নিয়ে এসে তোমার সব কাজের দায়িত্ব নিয়ে তোমাকে অবসর দিব। তখন আমরা হবো শ্রমিক আর তুমি হবে অফিসার। পায়ের উপর পা তুলে বসে থাকবে বাবাকে পাশে নিয়ে, আমরা তোমাদের মুখে খাবার তুলে দিব, যেভাবে ছোটবেলা থেকে এখনও আমাদের মুখে খাবার তুলে দিচ্ছ। আমার মায়ের মতো পৃথিবীর সব শ্রমিক মায়েরা হাজার বছর বেঁচে থাকুক। এই প্রত্যাশা রইল বিশ্ব শ্রমিক দিবসে।
লেখক : ডেপুটি রেজিস্ট্রার, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়