ঢাকা বুধবার, ০৯ জুলাই ২০২৫, ২৫ আষাঢ় ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

নতুন ব্যাংকনোট এবং উপেক্ষিত জাতীয় কবি

রফিক সুলায়মান
নতুন ব্যাংকনোট এবং উপেক্ষিত জাতীয় কবি

ব্যাংকনোট আসলে কী? ব্যাংকনোট একটি জাতির পরিচয় এবং সংস্কৃতির দৃশ্যমান প্রতীকগুলোর মধ্যে অন্যতম। ব্যাংকনোট একটি জাতির ইতিহাস, মূল্যবোধ এবং আকাঙ্ক্ষার বাস্তব প্রতিনিধিত্বকারী স্মারক। তাই, শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে জাতীয় পরিচয়, শিকড় এবং সংস্কৃতি প্রচারের জন্য ব্যবহৃত হয়ে আসছে ব্যাংকনোট। ইতিহাস বলে, ব্যাংকনোট একটি জাতির গর্ব, দেশপ্রেম এবং আনুগত্যের বার্তা বহন করার জন্য ব্যবহৃত হয়ে আসছে। উদাহরণস্বরূপ, ১৬৯৪ সালে ব্যাংক অব ইংল্যান্ড কর্তৃক জারি করা প্রথম ব্যাংক নোটের সামনের দিকে গ্রেট ব্রিটেনের নারী রূপ ব্রিটানিয়ার একটি খোদাই করা প্রতিকৃতি শোভিত ছিল। ব্রিটানিয়াকে ত্রিশূল এবং ঢাল ধারণ করে চিত্রিত করা হয়েছিল, যা ব্রিটিশ নৌশক্তি এবং প্রতিরক্ষার প্রতীক।

বাংলাদেশে নতুন মুদ্রা বাজারে ছেড়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক কিছুদিন আগেই। জুলাই বিপ্লবের মাধ্যমে অর্জিত দ্বিতীয় স্বাধীনতার প্রায় ১০ মাস পর এই নোট বাজারে এলো। নোটে বিভিন্ন গ্রাফিতি এবং ইমেজ থাকলেও অনুপস্থিত আমাদের প্রাণের কবি নজরুল। যাকে অন্তর্বর্তী সরকার জাতীয় কবি হিসেবে গ্যাজেটভুক্ত করেছে। জাতীয় কবিকে কীভাবে সম্মাননা জানাতে হয়, সেটি কিউবার জাতীয় কবি হোসে মার্তির সমাধি কমপ্লেক্সের দিকে তাকালে অনুভব করা যায়। ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি ড. এপিজে আবদুল কালাম ২০০৯ সালে ঢাকায় এসেছিলেন এরাবিয়ান হর্স ঢেউ টিনের মালিক সুফী মীজানুর রহমান প্রতিষ্ঠিত একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের কনভোকেশনে। তিনি তার বক্তৃতায় নজরুলের ‘ঊষার দুয়ারে হানি আঘাত’ অংশটুকু বাংলায় পাঠ করেছিলেন।

কয়েক বছর আগে বলিউড ভাইজান সালমান খান ঢাকায় ‘কবি কাজী নজরুল ইসলামের’ নাম উচ্চারণ করে গভীর শ্রদ্ধা জানিয়েছিলেন পিতা লেখক সেলিম খানের নির্দেশে। [সেলিম খানের বন্ধু জাভেদ আখতারের মামা কবি সাইবা আখতার রাঁচীতে নজরুলের সঙ্গে একই এসাইলামে ছিলেন।] তারা কবিকে চিনলেও আমাদের ট্রেজারি বিভাগ কবিকে চিনতে পারলেন না! ফিরে তাকাই জুলাই বিপ্লবের বিভিন্ন গ্রাফিতিতে : বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-আন্দোলনে একদম সম্মুখ সারিতে ছিলেন নজরুল। তার অসংখ্য পঙক্তি ও গান এই আন্দোলনে প্রাণ সঞ্চার করেছে- এ নিয়ে কারোরই দ্বিমত নেই। বিক্ষোভে, বিপ্লবে এবং দ্রোহকালে নজরুল এক হোমশিখা। ২০২৪ এ সেটি আবার প্রমাণিত হয়েছে। তিনি উপস্থিত থাকলেন অবিনাশী সব চরণ নিয়ে। দেশজুড়ে বিবিধ গ্রাফিতিতে নজরুলের যেসব চরণ আজো শোভা পাচ্ছে- ভয়ে কাঁপে কাপুরুষ লড়ে যায় বীর, গাহি সাম্যের গান, ঐ নূতনের কেতন ওড়ে কালবৈশাখির ঝড়, চির উন্নত মম শির, কারার ঐ লৌহ কপাট, মোরা একই বৃন্তে দুটি কুসুম হিন্দু মুসলমান, মোরা ঝঞ্ঝার মতো উদ্দাম, নমঃ নমঃ নমঃ বাংলাদেশ মম, বল বীর, বল উন্নত মম শির, গাজনের বাজনা বাজা! কে মালিক? কে সে রাজা? কে দেয় সাজা/মুক্ত স্বাধীন সত্যকে রে?, গাহি সাম্যের গান- ইত্যাদি।

দুঃশাসনের বিরুদ্ধে বজ্রকঠিন উচ্চারণের নাম নজরুল। নিপীড়িত জনগোষ্ঠীকে মুক্তি এনে দেওয়ার নাম নজরুল। অজাচারের বিরুদ্ধে নজরুল নিজেই এক প্রতিরোধ। কবি উচ্চারণ করেছেন- ‘আসিতেছে শুভদিন-দিনে দিনে বহু বাড়িয়াছে দেনা শুধিতে হইবে ঋণ।’ তাইতো নজরুলের রচনা সকল যুগের, সকল কালের, সব মানুষের।

শুরুর আলাপে ফিরে যাই। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের মুদ্রায় জাতীয় কবি-লেখকদের প্রতিকৃতি এবং রচনার অংশ শোভা পায়। ইসরায়েল, অস্ট্রেলিয়া, আইসল্যান্ড, ইউক্রেন, স্কটল্যান্ড, চিলি, আমেরিকা এবং ইংল্যান্ডের মুদ্রায় যথাক্রমে লিয়া গোল্ডবার্গ, ব্যাঞ্জো প্যাটারসন, জোনাস হ্যালগ্রিমসন, লেসিয়া ইউক্রেইঙ্কা, ন্যান শেফার্ড, পাবলো নেরুদা-গ্যাব্রিয়েলা মিস্ত্রাল, মায়া এঞ্জেলো এবং জেন অস্টিন-উইলিয়াম শেক্সপিয়ারের প্রতিকৃতি ও উদ্ধৃতি শোভা পাচ্ছে। এ ছাড়া জাপান, তুরস্ক, মালাবি, আলবেনিয়া [ইতিহাসবিদণ্ডকবি নায়ীম ফ্রাশেরি], কিরঘিজস্থান [কবি সায়কাবিয়া কারলায়িভা], কানাডা প্রভৃতি দেশেও কবি-সাহিত্যিকদের সম্মানে নিয়মিত ও স্মারক মুদ্রা চালু আছে।

যখন থেকে নতুন নোট বাজারে আসবে বলে আমরা শুনছিলাম তখন থেকে আশায় বুক বেঁধে ছিলাম, যে জুলাই অভ্যুত্থানের সম্মুখ সারির মহানায়ক কবি নজরুলকে বাংলাদেশ ব্যাংক অথবা অর্থ মন্ত্রণালয় মূল্যায়ন করবে। কিন্তু দিন শেষে নিরাশ হলাম। অন্যভাবে জুলাই আন্দোলনের অগ্রসৈনিক নজরুলের যেকোনো উপস্থিতি নতুন ব্যাংকনোটে থাকলে জাতি হিসেবে আমরা গর্বিত হতাম। বিষয়টি সংশ্লিষ্টরা হয়তো ভুলেই গেছেন। আগামীতে আরও ব্যাংক নোট আসবে। সেসবে স্থান পেতে পারেন বিদ্রোহী নজরুল। ভেবে যেন দেখেন সংশ্লিষ্টরা।

লেখক ও শিল্প সমালোচক।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত