ঢাকা মঙ্গলবার, ২৯ জুলাই ২০২৫, ১৪ শ্রাবণ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

প্রবীণের অভিজ্ঞতা এবং নবীনের শক্তি

হাসান আলী
প্রবীণের অভিজ্ঞতা এবং নবীনের শক্তি

সমাজ ও সভ্যতার অগ্রগতির মূল চাবিকাঠি হলো প্রজন্মের ধারাবাহিকতা। এই ধারাবাহিকতায় প্রবীণ ও নবীন- দুই প্রজন্মেরই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। প্রবীণরা তাদের জীবনভর অর্জিত জ্ঞান, অভিজ্ঞতা ও দূরদর্শিতা দিয়ে সমাজকে পথ দেখান, আর নবীনরা তাদের শক্তি, উদ্যম ও সৃজনশীলতা দিয়ে সেই পথে হাঁটেন, সমাজকে এগিয়ে নিয়ে যান নতুন সম্ভাবনার দিকে। এই দুই শক্তির সম্মিলনেই একটি জাতি হয়ে উঠতে পারে সুশৃঙ্খল, সচল এবং সমৃদ্ধ। তাই বলা চলে- প্রবীণের অভিজ্ঞতা এবং নবীনের শক্তি একে অপরের পরিপূরক।

প্রবীণের অভিজ্ঞতা, সময়ের সাক্ষ্যবহনকারী : প্রবীণ বলতে বোঝানো হয়, সেই সব মানুষকে, যারা বয়সের একটি পরিপক্ব স্তরে পৌঁছেছেন এবং দীর্ঘ জীবনের অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন। এই অভিজ্ঞতা কোনো পাঠ্যপুস্তক কিংবা ইন্টারনেট থেকে পাওয়া যায় না। এটি সময়ের সঙ্গে সংগ্রহ করা এক অমূল্য সম্পদ, যা মানুষকে করে তোলে পরিপক্ব ও বিচক্ষণ। প্রবীণরা জীবনের ঘাত-প্রতিঘাত, সফলতাণ্ডব্যর্থতা, সুখ-দুঃখের মধ্য দিয়ে শেখেন ধৈর্য, সহনশীলতা এবং বাস্তবতাবোধ। তাদের এই শিক্ষা এবং জ্ঞান সমাজে দিকনির্দেশনার ভূমিকা পালন করে। বিশেষ করে পরিবারে দাদা-দাদি, নানা-নানিদের গল্প, উপদেশ, জীবনদর্শন শিশুর মানস গঠনে বিরাট ভূমিকা রাখে। কর্মজীবনে প্রবীণদের অভিজ্ঞতা তরুণদের প্রশিক্ষণে ও পরিচালনায় অত্যন্ত কার্যকরী হয়। অতীতের অভিজ্ঞতা ভবিষ্যতের ভুল-ত্রুটি এড়াতে সাহায্য করে। একজন প্রবীণ ব্যক্তি জানেন, কোন পথে গেলে বিপদ, কোন সিদ্ধান্তে লাভ। তাই সমাজে প্রবীণদের অবমূল্যায়ন নয়; বরং তাদের সম্মান ও মতামতকে গুরুত্ব দেওয়াই হওয়া উচিত আমাদের দায়িত্ব।

নবীনের শক্তি, আগামীর সম্ভাবনা : নবীন বলতে বোঝায় তরুণ, কিশোর কিংবা যুবকদের, যারা শারীরিকভাবে সক্ষম, মানসিকভাবে উদ্যমী এবং ভবিষ্যতের স্বপ্নে বিভোর। তাদের আছে সাহস, কর্মস্পৃহা ও পরিবর্তনের আগ্রহ। তাদের দৃষ্টিভঙ্গি নতুন, চিন্তাধারা আধুনিক এবং প্রযুক্তিনির্ভর। নবীনরাই একটি দেশের ভবিষ্যৎ। তারা যদি সঠিক দিকনির্দেশনা ও সুযোগ পায়, তাহলে অসাধ্যকে সাধন করা সম্ভব। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম, ভাষা আন্দোলন কিংবা গণতান্ত্রিক আন্দোলনে তরুণদের ভূমিকা ছিল অপরিসীম। আজকের ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার ক্ষেত্রেও তরুণ প্রজন্ম প্রযুক্তিনির্ভর উদ্ভাবন ও উদ্যোগের মাধ্যমে অসামান্য অবদান রাখছে। নবীনদের শক্তি শুধু শারীরিক নয়, বুদ্ধিবৃত্তিক দিক থেকেও তারা অনেক বেশি সক্ষম। তারা দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে পারে, নতুন ভাবনা নিয়ে কাজ করতে চায় এবং ঝুঁকি নিতে ভয় পায় না। তারা পুরোনো ধ্যানধারণা ভেঙে নতুন কিছু করতে চায়। এই সাহসিকতা এবং উদ্ভাবনী শক্তিই একটি সমাজকে নিয়ে যেতে পারে উন্নয়নের সর্বোচ্চ শিখরে।

প্রবীণ ও নবীনের সম্মিলন, এক অপরিহার্য সেতুবন্ধন : যদি প্রবীণদের অভিজ্ঞতা আর নবীনদের শক্তি আলাদা আলাদাভাবে কার্যকর হয়, তাহলে তা আংশিক সফলতা এনে দিতে পারে। কিন্তু এই দুই শক্তি যদি একত্রে কাজ করে, তাহলে সমাজে সর্বোচ্চ উন্নতি সম্ভব। প্রবীণরা পথ দেখাবেন, আর নবীনরা হাঁটবেন সেই পথে। উদাহরণ হিসেবে ধরা যাক- একজন প্রবীণ শিক্ষক তার অভিজ্ঞতা দিয়ে একজন শিক্ষার্থীকে শুধু ভালো ফলাফল করানো নয়, একজন ভালো মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে পারেন। আবার সেই শিক্ষার্থী ভবিষ্যতে শিক্ষার নতুন পদ্ধতি, প্রযুক্তি বা গবেষণা চালিয়ে সমাজে আরও বড় পরিবর্তন আনতে পারেন। ব্যবসা-বাণিজ্যেও এই সম্পর্ক গুরুত্বপূর্ণ। অভিজ্ঞ উদ্যোক্তা ব্যবসায়িক দৃষ্টিভঙ্গি ও কৌশল শিখিয়ে দিতে পারেন, আর তরুণরা ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম, মার্কেটিং বা প্রযুক্তি ব্যবহার করে সেই ব্যবসাকে বিশ্ববাজারে পৌঁছে দিতে পারেন।

সমাজে প্রজন্মগত ব্যবধান, একটি চ্যালেঞ্জ : বর্তমান সময়ে প্রবীণ ও নবীনের মধ্যে প্রজন্মগত ব্যবধান একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রবীণরা অনেক সময় নবীনদের অতিরিক্ত স্বাধীনতা ও প্রযুক্তিনির্ভরতা বুঝতে পারেন না। আবার নবীনরাও প্রবীণদের পরামর্শকে পুরোনো চিন্তা বা ‘আউটডেটেড’ বলে মনে করেন। এর ফলে দুই প্রজন্মের মাঝে তৈরি হয় দূরত্ব, বিভাজন এবং কখনও কখনও বিরোধ। এই সমস্যার সমাধান একমাত্র পারস্পরিক শ্রদ্ধা, বোঝাপড়া এবং মূল্যবোধের মাধ্যমে সম্ভব। প্রবীণরা যেন নবীনদের প্রতি সহনশীল হন, তাদের চিন্তা ও স্বাধীনতাকে সম্মান করেন। একইভাবে, নবীনরাও যেন প্রবীণদের অভিজ্ঞতার মূল্য বুঝে তাদের সঙ্গে পরামর্শ করে কাজ করেন।

প্রযুক্তি ও মূল্যবোধ, একসঙ্গে পথচলা : নবীনদের মধ্যে প্রযুক্তির ব্যবহার দ্রুত বাড়ছে। তারা মোবাইল, ইন্টারনেট, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এবং অটোমেশন ব্যবহার করে নিজেদের কর্মদক্ষতা বাড়াচ্ছে। অন্যদিকে প্রবীণরা প্রযুক্তির সঙ্গে অনেক সময় তাল মেলাতে পারেন না। এখানে নবীনদের উচিত প্রবীণদের সাহায্য করা, প্রযুক্তি শেখানো, যাতে তারা যুগের সঙ্গে তাল মেলাতে পারেন। একইসঙ্গে, প্রবীণদের কাছ থেকে মানবিকতা, সংস্কৃতি, পারিবারিক বন্ধন এবং নৈতিক মূল্যবোধ শেখা যায়, যা শুধু প্রযুক্তির মাধ্যমে শেখা সম্ভব নয়। অর্থাৎ, প্রযুক্তি ও মূল্যবোধ- দুটোই জরুরি। নবীনরা যেন প্রযুক্তির মাধ্যমে যান্ত্রিক না হয়ে যায়, সে জন্য প্রবীণের শিক্ষা অপরিহার্য।

জাতীয় উন্নয়নে দুই প্রজন্মের সমন্বয় : একটি দেশের উন্নয়নে প্রবীণ ও নবীনদের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্রবীণ রাজনীতিবিদ, শিক্ষাবিদ, গবেষক বা প্রশাসকরা তাদের অভিজ্ঞতা দিয়ে নীতি নির্ধারণ করবেন, আর নবীনরা সেই নীতি বাস্তবায়নে সক্রিয় ভূমিকা রাখবেন। সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতে দুই প্রজন্মের সমন্বয়ে কাজ করার সুযোগ সৃষ্টি করা উচিত। যেমন- একটি কোম্পানির বোর্ডে অভিজ্ঞ প্রবীণরা কৌশল নির্ধারণ করবেন, আর নবীন কর্মীরা সেই কৌশলকে বাস্তবে রূপ দেবেন। বিশ্ববিদ্যালয়, গবেষণা প্রতিষ্ঠান এবং ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রেও এই মডেল কার্যকরভাবে বাস্তবায়ন করা সম্ভব।

পরিশেষে, প্রবীণের অভিজ্ঞতা এবং নবীনের শক্তি- এই দুইয়ের সম্মিলন ছাড়া একটি সমাজ কখনোই পূর্ণতা পায় না। প্রবীণরা হলেন- অভিভাবক, দিশারী; আর নবীনরা হলেন বাহক, নির্মাতা। তাদের মধ্যে সমঝোতা, শ্রদ্ধা ও সহযোগিতা থাকলে সমাজ হবে মানবিক, প্রযুক্তিনির্ভর এবং ভবিষ্যতবান্ধব। আমরা যেন প্রবীণদের জ্ঞানকে অবহেলা না করি এবং নবীনদের শক্তিকে দমন না করি। বরং দুই প্রজন্মের মধ্যে এক গভীর সেতুবন্ধন তৈরি করি, যার মাধ্যমে গড়ে উঠবে এক সুশৃঙ্খল, সমৃদ্ধ ও সাম্যভিত্তিক জাতি।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত