শুধু মধ্যপ্রাচ্য নয়, গোটা পৃথিবী স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের উদ্যোগে ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যকার যুদ্ধের আপাতত অবসান হয়েছে। গত মঙ্গলবার হঠাৎ করেই এই যুদ্ধবিরতির ঘোষণা দেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এবং বলেন, উভয় দেশই তা মেনে নিয়েছে। যত দূর জানা যায়, দুই দেশই মোটাদাগে যুদ্ধবিরতি মেনে চলছে। অবশ্য শুরুতে যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘনের কিছু পাল্টাপাল্টি অভিযোগ ছিল। তার পরও আন্তর্জাতিক বাণিজ্য, পরিবহন, পুঁজিবাজার, মুদ্রাবাজারসহ নানা ক্ষেত্রে তার ইতিবাচক প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। এক দিনেই জ্বালানি তেলের দাম ৪ শতাংশ কমে গেছে। ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে বহু প্রত্যাশিত এই যুদ্ধবিরতি চুক্তিকে স্বাগত জানিয়েছে ভারত, কাতার, মিসর, লেবানন, জর্দান, সৌদি আরব, রাশিয়া, চীন, ফ্রান্স, জার্মানিসহ আরও অনেক দেশ।
গত ১৩ জুন হঠাৎ করেই ইসরায়েল ইরানের ওপর বিমান ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলা শুরু করে। তাদের বেশ কয়েকজন সেনা কর্মকর্তা এবং পরমাণুবিজ্ঞানীকে হত্যা করা হয়। পারমাণবিক স্থাপনাগুলোতেও হামলা চালানো হয়। জবাবে পাল্টা ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালাচ্ছিল ইরান। এরই মধ্যে গত শনিবার রাতে ইরানের তিনটি পারমাণবিক স্থাপনায় বিমান হামলা চালায় যুক্তরাষ্ট্র। মার্কিন হামলায় ইরান কিছুটা হতভম্ব হলেও খুব দ্রুত নিজেদের সামলে নেয়। সোমবার মধ্যরাতে কাতার ও ইরাকে থাকা মার্কিন ঘাঁটিতে ইরান প্রতিশোধমূলক হামলা চালায়। সারা বিশ্ব যখন ভাবছিল, এবার যুদ্ধের আগুন আরও বড় পরিসরে ছড়িয়ে পড়বে মধ্যপ্রাচ্যে, তখনই ঘটল নাটকীয় পরিবর্তন। মার্কিন ঘাঁটিতে ইরানি হামলার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই ট্রাম্প ইসরায়েল-ইরানের মধ্যে যুদ্ধবিরতির ঘোষণা দিলেন।
পরমাণু শক্তির শান্তিপূর্ণ ব্যবহারের অধিকার পৃথিবীর প্রতিটি দেশেরই রয়েছে। ইরান বারবারই বলে আসছে, তাদের পারমাণবিক গবেষণা সম্পূর্ণরূপে শান্তিপূর্ণ ব্যবহারের উদ্দেশ্যেই চলছে। আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থার (আইএইএ) বিজ্ঞানীরা ইরানের পারমাণবিক স্থাপনাগুলো নিয়মিত পরিদর্শন করছে। ইরান পারমাণবিক অস্ত্র বিস্তার রোধ চুক্তিরও (এনপিটি) সদস্য রাষ্ট্র। সে কারণেও তাদের এসব কর্মসূচি সব সময়ই নজরদারির মধ্যে থাকে। ইরান যে পরমাণু অস্ত্র তৈরি করছে, তেমন কোনো প্রমাণও পাওয়া যায়নি। অন্যদিকে এনপিটিতে সই করেনি ইসরায়েল। মধ্যপ্রাচ্যে একমাত্র ইসরায়েলের কাছেই রয়েছে বহু পারমাণবিক যুদ্ধাস্ত্র। ইসরায়েল কখনোই আইএইএকে তাদের পারমাণবিক স্থাপনাগুলো পরিদর্শনের অনুমতি দেয়নি। তার পরও ইরান পরমাণু অস্ত্র তৈরির সক্ষমতা অর্জন করছে, এমন অভিযোগ তুলে ইরানে আক্রমণ কোনোভাবেই যুক্তিগ্রাহ্য বা গ্রহণযোগ্য নয়। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রের মতো পরাশক্তির সেই হামলায় যুক্ত হওয়া ছিল সম্পূর্ণ অনুচিত কাজ। তাই এটি করে যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বব্যাপী নিন্দাই কুড়িয়েছে। আর ইরান ছোট দেশ হলেও যে সাহসের পরিচয় দিয়েছে, তা বিশ্বব্যাপী প্রশংসিত হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, নিজের ভুল বুঝতে পেরে এবং মার্কিন স্বার্থের প্রতি বিরাট ঝুঁকির কথা বিবেচনা করেই ট্রাম্প তড়িঘড়ি যুদ্ধবিরতির উদ্যোগ নিয়েছেন। অনেক বিশ্লেষকই ইসরায়েলকে মধ্যপ্রাচ্যের ক্যান্সার হিসেবে উল্লেখ করেছেন।
গাজায় ইসরায়েলি বাহিনীর বর্বরতা থামছেই না। এ পর্যন্ত সেখানে ৫৬ হাজারের বেশি মানুষ নিহত হয়েছে, যার ৬৫ শতাংশই নারী ও শিশু। আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী বিশ্ববাসী একে গণহত্যা হিসেবেই দেখছে। আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছে। তার পরও ডোনাল্ড ট্রাম্প নেতানিয়াহুর সমর্থনে ইরানে বোমা হামলা করেছে। মানবাধিকারের বুলি আওড়ানো পাশ্চাত্যের কিছু দেশ ইসরায়েলকে অস্ত্র ও অন্যান্য সহযোগিতা দিয়ে যাচ্ছে, যা কোনোভাবেই কাম্য নয়। আমরা চাই, ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যকার যুদ্ধবিরতি স্থায়ী হোক। গাজায় পরিচালিত গণহত্যা থেকেও ইসরায়েলকে নিবৃত্ত করা হোক। মধ্যপ্রাচ্যে এবং পুরো পৃথিবীতে শান্তি আসুক।