ঢাকা বৃহস্পতিবার, ১৪ আগস্ট ২০২৫, ৩০ শ্রাবণ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

প্রকাশ্যে হত্যা : দুর্বল বিচার ব্যবস্থা ও বন্ধে করণীয়

মাহমুদুল হাসান শোভন
প্রকাশ্যে হত্যা : দুর্বল বিচার ব্যবস্থা ও বন্ধে করণীয়

প্রকাশ্যে হত্যা, বিশেষ করে যখন তা জনসমক্ষে ঘটে এবং ভিডিও বা প্রত্যক্ষদর্শীর মাধ্যমে স্পষ্ট প্রমাণ থাকে, তখন জনমনে স্বাভাবিকভাবেই একটি প্রশ্ন জাগে ‘তাহলে বিচার এত দেরিতে কেন?’ বাংলাদেশসহ অনেক উন্নয়নশীল দেশে এই প্রশ্নটি খুবই প্রাসঙ্গিক। যদিও দেশে আইনের শাসন রয়েছে, তারপরেও বিচার প্রক্রিয়ার দীর্ঘসূত্রতা জনমনে হতাশা এবং আইনব্যবস্থার ওপর আস্থাহীনতা তৈরি করে। বিচার প্রক্রিয়ায় দেরির পেছনে একাধিক কারণ রয়েছে, যা আইনি, প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক তিন দিক থেকেই ব্যাখ্যা করা যায়। প্রথমত, আইনি কাঠামোর জটিলতা ও ধীরগতির বিচার ব্যবস্থা অন্যতম কারণ। কোনো অপরাধ সংঘটনের পর তদন্ত, অভিযোগ গঠন, সাক্ষ্যগ্রহণ, যুক্তিতর্ক এবং রায় ঘোষণার মতো একাধিক ধাপ রয়েছে। প্রতিটি ধাপে সময় লাগে এবং অনেক ক্ষেত্রে আসামিপক্ষ নানান ছলচাতুরীর মাধ্যমে বিচারকে দীর্ঘায়িত করে। যেমন, আসামিপক্ষের আইনজীবীরা বারবার সময় চেয়ে তারিখ পরিবর্তন করে থাকেন। এতে বছরের পর বছর লেগে যায় একটি মামলার নিষ্পত্তিতে।

দ্বিতীয়ত, প্রশাসনিক দুর্বলতা ও মামলার বোঝা অন্যতম বড় সমস্যা। বিচারালয়ে বিচারক ও সহায়ক কর্মচারীর ঘাটতি এবং মামলা নিষ্পত্তির অনুপাতে মামলার সংখ্যা এত বেশি যে, একটি মামলার শুনানির জন্য কয়েক মাস বা বছর অপেক্ষা করতে হয়। একটি জেলা জজ কোর্টে হাজার হাজার মামলা বিচারাধীন থাকে, যার ফলে নতুন মামলাগুলো সময়মতো নিষ্পত্তি হয় না। তৃতীয়ত, প্রভাবশালী মহলের হস্তক্ষেপ ও রাজনৈতিক চাপ বিচার প্রক্রিয়াকে প্রভাবিত করে। অনেক সময় খুনিদের রাজনৈতিক পরিচয় বা অর্থনৈতিক প্রভাব বিচারপ্রাপ্তির পথে বড় বাধা হয়ে দাঁড়ায়। ক্ষমতাধরদের প্রভাবের কারণে পুলিশ তদন্তে গাফিলতি করে বা ইচ্ছাকৃতভাবে দুর্বল চার্জশিট দেয়। এতে বিচারপ্রার্থী পরিবার ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হয়।

চতুর্থত, প্রযুক্তির ব্যবহার ও আধুনিকতার অভাব বিচার প্রক্রিয়া দীর্ঘ হওয়ার আরেকটি কারণ। ডিজিটাল প্রমাণ যাচাই, ফরেনসিক রিপোর্ট, ভিডিও ফুটেজ বিশ্লেষণ ইত্যাদিতে আমাদের বিচার বিভাগে এখনও কাঙ্ক্ষিত দক্ষতা এবং যন্ত্রপাতির ঘাটতি রয়েছে। ফলে প্রমাণ উপস্থাপন এবং যাচাইয়ে সময় বেশি লাগে।

পঞ্চমত, সাক্ষীদের নিরাপত্তা ও অনুপস্থিতি অনেক সময় মামলার ফলাফলের ওপর প্রভাব ফেলে। হত্যাকাণ্ড প্রকাশ্যে হলেও অধিকাংশ সময় সাক্ষীরা নিরাপত্তার অভাবে সাক্ষ্য দিতে চান না। এতে বিচার দুর্বল হয় এবং মামলার নিষ্পত্তি দীর্ঘায়িত হয়।

সুশাসনের অভাব ও রাজনৈতিক সদিচ্ছার ঘাটতি থাকলে কোনো বিচার ব্যবস্থাই কার্যকর হতে পারে না। যেখানে অপরাধী শাস্তির ভয় পায় না, সেখানে অপরাধ থেমে থাকে না। তাই প্রকাশ্যে হত্যার পরও বিচার বিলম্বিত হওয়া মূলত আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় দুর্বলতার প্রতিচ্ছবি। প্রকাশ্যে হত্যা একটি ভয়াবহ সামাজিক ব্যাধি, যা একটি রাষ্ট্রের আইনশৃঙ্খলা, মানবাধিকার ও নৈতিকতা সবকিছুকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। এমন ঘটনা শুধু একজন ব্যক্তির জীবনের অবসান ঘটায় না, বরং গোটা সমাজের নিরাপত্তাবোধকে চূর্ণ-বিচূর্ণ করে। যখন জনসমক্ষে কোনো ব্যক্তি নির্মমভাবে খুন হয়, তখন তা অন্যদের মাঝেও আতঙ্ক, ক্ষোভ ও হতাশার সৃষ্টি করে। এই সমস্যা সমাধানে কেবল আইন প্রয়োগকারী সংস্থার তৎপরতা যথেষ্ট নয়, বরং সরকার, প্রশাসন, সমাজ ও ব্যক্তি সবাইকে একযোগে কাজ করতে হবে। প্রকাশ্যে হত্যার বিচার দ্রুততম সময়ে সম্পন্ন করে অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়া জরুরি। বিচার প্রক্রিয়া যদি দীর্ঘায়িত হয়, তবে অপরাধীরা সাহস পায় এবং সমাজে ভীতি ছড়ায়। বিশেষ ট্রাইব্যুনাল বা ফাস্ট ট্র্যাক কোর্টের মাধ্যমে এ ধরনের মামলার নিষ্পত্তি ত্বরান্বিত করা উচিত। আইন থাকলেই হবে না, তার প্রয়োগ সঠিকভাবে না হলে অপরাধ বন্ধ হবে না। অনেক সময় অপরাধীরা প্রভাবশালী হওয়ায় শাস্তি এড়িয়ে যায়। প্রশাসনের উচিত কারও প্রভাব বা পরিচয় না দেখে আইনের কঠোর প্রয়োগ নিশ্চিত করা। জণসমাগমপূর্ণ এলাকা, রাস্তা, মার্কেট ও গুরত্বপূর্ণ স্থানে সিসিটিভি ক্যামেরা স্থাপন করে নজরদারি বাড়াতে হবে। প্রযুক্তির মাধ্যমে অপরাধীর পরিচয় শনাক্ত ও আটক সহজ হয়। এ ছাড়া ভিডিও ফুটেজ তদন্তে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। পুলিশ, র‍্যাব, ও প্রশাসনের দ্রুত সাড়া দেওয়া ও পেশাদারিত্বের ওপর অনেক কিছু নির্ভর করে। অপরাধ সংঘটনের পর তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা না নিলে অপরাধী পালিয়ে যেতে পারে। তাই প্রশাসনকে আরও দ্রুত, দক্ষ ও দায়িত্বশীল হতে হবে। প্রকাশ্যে হত্যা বন্ধে সামাজিক সচেতনতা একটি বড় ভূমিকা রাখে। পরিবার, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও গণমাধ্যমের মাধ্যমে মানবিক মূল্যবোধ, সহনশীলতা, আইনের প্রতি শ্রদ্ধা ইত্যাদি শেখানো জরুরি। ছোট বয়স থেকে নৈতিক শিক্ষার অভাব থাকলে একজন মানুষ সহিংস প্রবণ হয়ে উঠতে পারে। অনেক সময় সাক্ষীরা ভয় বা হুমকির কারণে আদালতে সঠিক সাক্ষ্য দেয় না। প্রশাসনের উচিত সাক্ষীদের সুরক্ষা নিশ্চিত করা, যাতে তারা নির্ভয়ে সত্য বলতে পারে। অপরাধীরা যদি রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা পায়, তবে আইনের প্রয়োগ দুর্বল হয়। সৎ ও নিরপেক্ষ প্রশাসন গঠনের মাধ্যমে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ রোধ করতে হবে। গণমাধ্যমের উচিত সত্য ঘটনা তুলে ধরা এবং অপরাধীদের প্রকাশ্যে সমালোচনার মাধ্যমে সামাজিক চাপ সৃষ্টি করা। তবে তা যেন বিচার প্রক্রিয়াকে প্রভাবিত না করে, সে বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে।

প্রকাশ্যে হত্যার মতো জঘন্য অপরাধ বন্ধে প্রয়োজন অতি দ্রুত বিচার প্রক্রিয়া শেষ করা। একটি কার্যকর, দ্রুত ও নিরপেক্ষ বিচার ব্যবস্থা গড়ে তুলা যেখানে অপরাধী যেই হোক না কেন, শাস্তি যেন অনিবার্য হয়। আইন, প্রশাসন এবং জনগণের সম্মিলিত উদ্যোগ ছাড়া এ দুরবস্থা থেকে পরিত্রাণ সম্ভব নয়। সবাই একসঙ্গে কাজ করলেই নিরাপদ ও মানবিক সমাজ গড়ে তোলা সম্ভব।

শিক্ষার্থী : ঢাকা কলেজ

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত