প্রিন্ট সংস্করণ
০০:০০, ২৪ জুলাই, ২০২৫
বাংলাদেশের গর্ব ও প্রকৃতির অমূল্য সম্পদ রয়েল বেঙ্গল টাইগার আজ বিলুপ্তির প্রান্তে দাঁড়িয়ে। বিজ্ঞানীদের পূর্বাভাস অনুযায়ী, জলবায়ু পরিবর্তন ও মানবসৃষ্ট নানাবিধ কারণে ২০৭০ সালের মধ্যে সুন্দরবন থেকে এই প্রাণীটি সম্পূর্ণভাবে বিলুপ্ত হতে পারে। এটি কেবল একটি প্রজাতির বিলোপ নয়, বরং আমাদের বাস্তুতন্ত্র, সংস্কৃতি ও জাতীয় পরিচয়ের এক গভীর ক্ষতির ইঙ্গিতবাহী উষ্ণায়নের ফলে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি সুন্দরবনের অস্তিত্বকেই হুমকির মুখে ফেলেছে। গবেষণায় দেখা গেছে, সুন্দরবনের ৭০% এলাকা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে মাত্র কয়েক ফুট উঁচুতে অবস্থিত। ২০১০ সালের এক গবেষণা অনুসারে, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা ১১ ইঞ্চি বাড়লে সুন্দরবনের বাঘের সংখ্যা ৯৬% কমে যেতে পারে। শিল্পায়ন, অবৈধ শিকার, বন উজাড় ও নতুন রাস্তা নির্মাণ বাঘের আবাসস্থলকে সংকুচিত করছে। আন্তর্জাতিক বাজারে বাঘের চামড়ার চড়া মূল্য থাকায় চোরা শিকারিরা নির্বিচারে বাঘ হত্যা করছে। প্রতিটি বাঘের চামড়া ২৫-৩০ লাখ টাকায় বিক্রি হয় বলে জানা গেছে। বাঘ সংরক্ষণে সরকারি উদ্যোগের ঘাটতি ও প্রকল্প বাস্তবায়নে অনিয়মও একটি বড় সমস্যা। ২০০০ সালে প্রস্তাবিত ‘টাইগার প্রজেক্ট সুন্দরবন’ আজও আলোর মুখ দেখেনি। রয়েল বেঙ্গল টাইগার কেবল একটি প্রাণী নয়, এটি সুন্দরবন বাস্তুতন্ত্রের মূল স্তম্ভ। বাঘ না থাকলে হরিণের সংখ্যা বেড়ে গিয়ে গাছপালা নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে, যা পুরো বাস্তুতন্ত্রকে ধ্বংস করে দেবে। বাঘের অনুপস্থিতিতে সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য ধ্বংস হবে, যা বিশ্বের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিশ্ব ঐতিহ্যকে হারানোর শামিল।
তবে আশার কথা হলো, কিছু সংরক্ষণ প্রচেষ্টা ইতিবাচক ফল দিচ্ছে। বাংলাদেশ বন বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, ক্যামেরা ট্র্যাপিং পদ্ধতিতে ২০১৫ সালে ১০৬টি বাঘ শনাক্ত করা গেলেও পরবর্তীতে তা বেড়ে ১১৪টিতে দাঁড়িয়েছে। সরকার ঝড় প্রতিরোধক বাঁধ নির্মাণ, লবণাক্ততা সহিষ্ণু ফসল চাষ ও কিছু দ্বীপের উচ্চতা বৃদ্ধির ব্যবস্থা করেছে। তাই রয়েল বেঙ্গল টাইগার রক্ষায় সমন্বিত উদ্যোগ প্রয়োজন। সুন্দরবনের ইকোসিস্টেম সংরক্ষণ ও অবৈধ শিকার বন্ধ করতে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে। স্থানীয় জনগণকে সম্পৃক্ত করে বাঘের গুরুত্ব সম্পর্কে সচেতনতা তৈরি করতে হবে। সুন্দরবন-সংলগ্ন জনগোষ্ঠীর জন্য বিকল্প আয়ের উৎস সৃষ্টি করতে হবে যাতে তারা বনের উপর নির্ভরশীল না হয়। জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় বৈশ্বিক উদ্যোগে সক্রিয় অংশগ্রহণ করতে হবে। রয়েল বেঙ্গল টাইগার কেবল আমাদের জাতীয় প্রাণী নয়, এটি আমাদের প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষাকারী এক অপরিহার্য অংশ। এই প্রাণীটি রক্ষা করা আমাদের নৈতিক দায়িত্ব। বিজ্ঞানী অধ্যাপক বিল লরেন্সের ভাষায়, ‘সুন্দরবনের মতো এমন জায়গা বিশ্বের আর কোথাও নেই। তাই রয়েল বেঙ্গল টাইগারকে বাঁচাতে হলে সুন্দরবনের ইকোসিস্টেম সংরক্ষণ করতে হবে’। আমাদের সম্মিলিত প্রচেষ্টাই পারে এই মহামূল্যবান প্রজাতিকে বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষা করতে এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য সুন্দরবনের অমূল্য সম্পদ সংরক্ষণ করতে।
সহকারী শিক্ষক
নাদির হোসেন উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়