শিক্ষা একটি সামাজিক প্রপঞ্চ সেইসঙ্গে মানুষের ব্যাক্তিক আচরণের সমাজ কর্তৃক কাঙ্ক্ষিত ও অপেক্ষাকৃত স্থায়ী পরিবর্তনের স্বরূপ। শিক্ষার সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত বেশ কিছু প্রত্যয়ের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো সাক্ষরতা, জীবনদক্ষতা, মৌলিক শিক্ষা, প্রাথমিক শিক্ষা, সর্বজনীন প্রাথমিক শিক্ষা ইত্যাদি।
সাক্ষরতা (Literacy) : সাক্ষরতা বলতে কোনো ব্যক্তির সাধারণভাবে কোনো একটি ভাষায় পড়তে পারা, লিখতে পারা ও গণনা (সাধারণ হিসাব নিকাশ) করতে পারার দক্ষতা অর্জন।
জীবনদক্ষতা (Life Skill) : এমন একটি প্রক্রিয়া যা একজন মানুষকে তার জীবন পরিচালনার জন্য প্রয়োজনীয় বিভিন্ন ক্ষমতা অর্জন করতে সহায়তা করে। এটি নিজের আবেগ নিয়ন্ত্রণ, সম্পর্ক তৈরি এবং জীবনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার জন্য অপরিহার্য।
শিক্ষার্থীদের জীবন যাপনের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ জীবনদক্ষতা আয়ত্ত করা অর্থাৎ এরূপ জ্ঞান, দক্ষতা, মূল্যবোধ, দৃষ্টিভঙ্গি অর্জন যা শিক্ষার্থীর দৈনন্দিন জীবনযাপন এবং পারিবারিক, সামাজিক ও বৈষয়িক ক্ষেত্রের সমস্যা মোকাবিলায় (Problem Solving) সহায়ক।
মৌলিক শিক্ষা (Basic Education) : মৌলিক শিক্ষা হলো সাক্ষরতা (৪টি ভাষা দক্ষতা ও গুনতে পারা) ও জীবনদক্ষতার সম্মিলিত রূপ।
প্রাথমিক শিক্ষা (Primary Education) : প্রাথমিক শিক্ষা হলো মৌলিক শিক্ষা (৪টি ভাষা দক্ষতা [শোনা, বলা, পড়া, লেখা] গুনতে পারা + জীবনদক্ষতা) ও পরবর্তী শিক্ষাস্তরে যাওয়ার প্রস্তুতি।
সর্বজনীন প্রাথমিক শিক্ষা (Universal Primary Education) : নির্দিষ্ট বয়স ক্রমের সবার জন্য প্রাথমিক শিক্ষা অর্থাৎ নিশ্চিত করা।
এতকিছু বলার উদ্দেশ্য হলো, আজকের দিনে আমরা আধুনিক শিক্ষার পেছনে দৌড়াচ্ছি, অনেক ব্যক্তিগত দক্ষতা, সার্টিফিকেট অর্জন করছি, পাবলিক পরীক্ষায় জিপিএ-৫ সহ অনেক কিছু অর্জন করছি ঠিকই কিন্তু জীবনে চলার জন্য অত্যন্ত জরুরি জীবনদক্ষতা কয়জন অর্জন করছি?
অভিভাবকরা সন্তানদের স্কুলের পড়ার পাশাপাশি নাচ, গান, আবৃত্তি, ড্রইং শেখালেও সাঁতার বা প্রাথমিক প্রতিবিধান কয়জন শেখাচ্ছি? তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ, ব্যবহারিক কর্মপ্রক্রিয়া, চাপ মোকাবিলা এবং আত্মবিশ্বাস বাড়ানোর সঙ্গে অর্থাৎ যেসব বিষয়গুলো জীবনদক্ষতার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট তার কতটা অর্জন করছি?
জীবনদক্ষতা মানুষের ব্যক্তিগত এবং সামাজিক দায়িত্ব পালনে সহায়ক। এটি একজন ব্যক্তিকে সচেতন করে তোলে, সঠিক সময়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা বাড়ায়, তাৎক্ষণিকভাবে সমস্যা সমাধানে সক্ষম করে, জটিল পরিস্থিতি সহজে মোকাবিলা করতে শেখায়, সামাজিক জীবনে অবদান রাখে, দক্ষতা মানুষকে সমাজে সক্রিয় অংশগ্রহণকারী হিসেবে গড়ে তোলে।
জীবনদক্ষতা হচ্ছে সেইসব দক্ষতা যা সুস্থ, সুখী, নিরাপদ জীবনের জন্য অপরিহার্য। মানসিক দৃঢ়তা, ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি ও আচরণের মাধ্যমে মানুষ প্রতিদিন বিভিন্ন পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে পারে। যদিও বা জীবিকা অর্জন দক্ষতা আর জীবনদক্ষতা এক নয়। জীবিকা অর্জন দক্ষতা হচ্ছে জীবিকা অর্জনের সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত দক্ষতা।
আর্থিক আয় সংক্রান্ত সক্ষমতা, ব্যক্তিগত ও পরিবারের অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য প্রয়োজনীয় দক্ষতাগুলো জীবিকা অর্জন দক্ষতা আর জীবনদক্ষতা হচ্ছে মনোসামাজিক দক্ষতা এগুলো জীবিকা অর্জনের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে সম্পর্কিত নয় কিন্তু এ দক্ষতাগুলো শিক্ষার্থীর অন্তর্নিহিত সব সম্ভাবনার বিকাশ ঘটিয়ে জীবনের সব ক্ষেত্রে সফল হওয়ারভিত্তি তৈরি করে দেয়।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাও জীবনদক্ষতার অর্জনের জন্য কিছু সূচক নির্ধারণ করে দিয়েছে যার মধ্যে রয়েছে শিক্ষার্থীরা বিপদজনক পরিস্থিতি চিহ্নিত করতে ও এড়াতে পারবে; আত্মউন্নয়ন ঘটাতে পারবে; অন্যের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকবে; অন্যের দুঃখ-কষ্ট-বিপদে সহমর্মিতা প্রকাশ করবে; নিজের মনোসামাজিক সমস্যার সমাধান করতে পারবে; নিজ শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষা করতে পারবে; নিজে নিরাপদ থাকতে সক্ষম হবে, অন্যের নিরাপত্তা বিধানে সহায়তা করবে; অন্যের ক্ষতি না করে নিজের স্বার্থ রক্ষা করতে পারবে; নিজেকে বিভিন্ন পরিবেশে খাপ খাওয়াতে পারবে; সবসময় ইতিবাচক আচরণ করতে সমর্থ হবে; ব্যক্তিক ও সামষ্টিক উন্নয়নে অবদান রাখতে পারবে।
জীবনদক্ষতা স্থান, কাল, পাত্র ভেদে ভিন্ন রকম হতে পারে। সবার জন্য জীবনদক্ষতা একই রকম না কিন্তু কিছু সাধারণ জীবনদক্ষতা সবার জন্যই প্রয়োজন যেমন সাঁতার জানা, প্রাথমিক প্রতিবিধান জানা, বাইসাইকেল চালানো ইত্যাদি। এছাড়া অঞ্চলভেদে আবার বাস্তবতা ও প্রয়োজনীয়তা অনুসারে জীবনদক্ষতা ভিন্ন ভিন্ন হতে পারে কিন্তু একেবারে সর্বজনীন গুরুত্বপূর্ণ এবং অত্যাবশ্যকীয় যেসব দক্ষতাসমূহ রয়েছে সাঁতার জানা, প্রাথমিক প্রতিবিধান জানা অত্যন্ত জরুরি। যেমন, ঢাকা শহরের জন্য ভূমিকম্প থেকে সুরক্ষা, অগ্নি দুর্ঘটনা থেকে সুরক্ষা। উপকূলীয় অঞ্চলের জন্য সাইক্লোন থেকে সুরক্ষা। গ্রামাঞ্চলে সাপে কাটা থেকে সুরক্ষা ইত্যাদি জানা এবং শেখা জরুরি।
২১ জুলাই ২০২৫ রাজধানী ঢাকার উত্তরায় অবস্থিত মাইলস্টোন স্কুলে সংঘটিত হয় এক মর্মবিদারক দুর্ঘটনা যেখানে দেখা যায় একটি বিমান বিধ্বস্ত হয়ে বিদ্যালয়ের জুনিয়র সেকশন ভবনে আছড়ে পড়ে এবং ঘটনা স্থলে অনেক শিশু আগুনে পুড়ে গিয়ে নিহতসহ অনেকে গুরুতর আহত হয়ে হাসপাতালের বিছানায় কাতরাচ্ছে।
ঘটনার দিন বিভিন্ন ভিডিও ফুটেজ বিশ্লেষণ করে দেখা যায় অনেক কোমলমতি শিক্ষার্থী শরীরে আগুন নিয়ে ভয়ে ছোটাছুটি করছে বাইরে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করছে। অনেকে আবার বাইরে দাঁড়িয়ে সে দৃশ্য মোবাইলফোনে ভিডিও ধারণ করছে।
আবার অন্যদিকে দেখা যাচ্ছে উদ্ধারকাজে সেনাবাহিনী, ফায়ারসার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের মতো প্রশিক্ষিত বাহিনীর পাশাপাশি তাদের সহযোগিতার জন্য এগিয়ে এসেছে স্কাউট, রোভার স্কাউট, যুব রেড ক্রিসেন্টের সদস্যারা যারা বিভিন্ন স্কুল ও কলেজের শিক্ষার্থী কিন্তু তারা প্রাথমিক প্রতিবিধান ও জরুরি উদ্ধারকাজে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত অর্থাৎ প্রয়োজনীয় জীবনদক্ষতা অর্জনকারী।
আজকে যদি আমাদের কোমলমতি শিশুরাও কিছুটা জীবনদক্ষতা অর্জন করে থাকতো তাহলে হয়তোবা এতটা মর্মবিদারক দৃশ্য নাও দেখা লাগতো। আমরা বলছি না জীবনদক্ষতামূলক শিক্ষা নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা করবে কিন্তু মৃত্যুহার হ্রাস করতে পারে।
হয়তোবা অনেক মায়ের বুক হয়তোবা খালি হতো না, আমরা সম্ভাবনাময় ফুলের মতো এতো শিশুদের হারাতাম না। আজকে যে শিশুটি পোড়া পোশাকে দৌড়ে যাচ্ছিল সে যদি না দৌড়ে মাটিতে গড়াগড়ি খেত বা আশেপাশের লোকেরা তাকে এই কথা বলতো বা সাহায্য করতো তাহলে হয়তোবা তার শরীরে পোড়ার হার অনেক কম হতো এমনকি সে বেঁচেও যেতে পারতো।
বিদ্যালয়ের অভ্যন্তরে যে অগ্নি নির্বাপক ব্যবস্থা রয়েছে এগুলো সবাই চালাতে ও ব্যবহার করতে জানা জরুরি। বাইরে অনেক উৎসুক জনতা নির্বিকারভাবে দেখছিলেন তাদের মধ্যেও যদি জীবনদক্ষতার শিক্ষা থাকতো তাহলে এতটা ক্ষতি আমাদের হতো না, জীবনদক্ষতা শুধু যে প্রাথমিক চিকিৎসা আর উদ্ধার তৎপরতায় অংশ নেওয়া শুধু তা নয় বরং সঠিক সময়ে সঠিক কাজের জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত থাকা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা।
আমাদের এখনই শুধুমাত্র কাগজে কলমে না রেখে প্রয়োজন ব্যবহারিকভাবে জীবনদক্ষতামূলক শিক্ষার নিশ্চিত বাস্তবায়ন। অভিভাবকদের উচিত নিজেদের প্রয়োজনেই সন্তানদের আবশ্যিক জীবনদক্ষতা অর্জন নিশ্চিত করা। বইয়ে পড়ার পাশাপাশি সন্তানদের সাঁতার, প্রাথমিক প্রতিবিধান শেখানো। বিদ্যালয় পর্যায় থেকে নিশ্চিতভাবে জীবনদক্ষতা শিক্ষার প্রতিটি সূচক অর্জন নিশ্চিতকল্পে পদক্ষেপ নেওয়া। শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের যথাযথ প্রশিক্ষণ নিশ্চিত করা। স্কাউট ও যুব রেডক্রিসেন্ট কার্যক্রমের যথাযথ গুরুত্বসহ বিকাশ করা।
জীবনদক্ষতাভিত্তিক শিক্ষা প্রত্যেক শিক্ষার্থীকে নিজস্ব সব সম্ভাবনার সম্পূর্ণ বিকাশ সাধনে সক্ষমতা দেয় এবং সে নিজের, পরিবারের, গোষ্ঠীর এবং সমাজের উন্নয়নে ইতিবাচক অবদান রাখতে সক্ষম হয়। বাস্তব জীবনে বিভিন্ন প্রতিকূল পরিস্থিতি মোকাবিলা করার জন্য সর্বস্তরের শিক্ষার্থীদের জন্য জীবনদক্ষতা শিক্ষা বাধ্যতামূলক করা প্রয়োজন বলে মনে করছি।
লেখক : সহকারী অধ্যাপক, শিক্ষা বিভাগ, নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়