প্রিন্ট সংস্করণ
০০:০০, ০৭ ডিসেম্বর, ২০২৫
বাংলার গ্রামাঞ্চল শুধু সুন্দর নদী, মাঠ ও গাছপালার জন্যই পরিচিত নয়, এটি আমাদের সাংস্কৃতিক ও শিল্পিক ঐতিহ্যের এক বিশেষ কেন্দ্র। গ্রামীণ মানুষ শুধু নিজেদের দৈনন্দিন জীবনযাপনকে সুন্দর করতে নয়, বরং শিল্পকর্মের মাধ্যমে সমাজ ও সংস্কৃতির ধারাবাহিকতাও ধরে রাখে। গ্রাম বাংলার মাটির শিল্প সেই ঐতিহ্যের একটি উজ্জ্বল দিক।
মাটির শিল্প বলতে আমরা শুধু মাটির পাত্র, পাত্রের ঢাকনা বা মাটির পুতুলকেই বুঝি না। এটি একটি পূর্ণাঙ্গ সাংস্কৃতিক প্রকাশ। গ্রামের মানুষ প্রায়শই মাটিকে হাতে নিয়ে বিভিন্ন আকৃতি ও নকশা তৈরি করেন। শীতকালে মাটির পাত্রে খাবার রাখা হয়, যা খাবারের স্বাদ ও তাজা রাখার জন্য উপকারী। গ্রামের আচার-অনুষ্ঠান, উৎসব বা পূজার সময় মাটির তৈরি দেবী-দেবীর মূর্তি সাজানো হয়। এই মূর্তিগুলো শুধু শোভাময় নয়, বরং মানুষের বিশ্বাস ও ভক্তির প্রতিফলন।
মাটির শিল্পের জন্য গ্রামীণ মানুষের ধৈর্য, কল্পনা ও দক্ষতার প্রয়োজন। মাটি যেমন সহজ একটি পদার্থ, তেমনি এটি খুবই নমনীয়। সঠিক হাতের ছোঁয়ায় এটি জীবন্ত হয়ে ওঠে। ছোট্ট গ্রামাঞ্চলের ছেলে-মেয়েরাও ছোটবেলা থেকে মাটির খেলনা তৈরি শিখে। তারা মাটির ঘর, পাখি, মানুষ বা পশুর মূর্তি বানিয়ে খেলে, যা তাদের সৃজনশীলতাকে বাড়ায়।
গ্রামের মহিলা ও পুরুষরা বিভিন্ন রঙ ব্যবহার করে মাটির শিল্পকে আরও প্রাণবন্ত করে তোলেন। কখনও লাল, কখনও হলুদ, কখনও সবুজ রঙ দিয়ে পাত্র বা মূর্তির নকশা করা হয়। এই রঙ শুধু শোভা বাড়ায় না, বরং শিল্পকে একটি গল্প বলতে সাহায্য করে। যেমন, মাটির দেবী-দেবীর চোখ, হাসি, পোশাকের নকশা সবই গ্রামের মানুষের বিশ্বাস ও কল্পনার পরিচয় বহন করে। মাটির শিল্প শুধু গ্রামীণ মানুষের দৈনন্দিন জীবনের অংশ নয়, এটি আমাদের ইতিহাসেরও অংশ। বহু শতক ধরে এই শিল্প আমাদের সমাজে রয়ে গেছে। প্রাচীন সময়ে বাংলার গ্রামের মানুষ মাটির পাত্র ব্যবহার করতেন পানি, দুধ, দই ও অন্যান্য খাদ্যসামগ্রী সংরক্ষণের জন্য। মাটির পাত্রের বিশেষত্ব হলো এটি খাদ্যকে ঠান্ডা ও তাজা রাখে, যা এখনও গ্রামের মানুষের কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
বর্তমান সময়ে অনেক শিল্পী শহরেও মাটির শিল্পকে ধরে রাখার চেষ্টা করছেন। তারা গ্রাম থেকে অনুপ্রেরণা নিয়ে আধুনিক রঙ, ডিজাইন ও আকৃতি ব্যবহার করছেন। এতে গ্রামবাংলার ঐতিহ্য ও আধুনিকতার মিলন ঘটে। এছাড়াও বিভিন্ন প্রদর্শনী ও আর্ট ফেয়ারে মাটির শিল্প দেখানো হয়, যা দেশের মানুষের কাছে গ্রামীণ শিল্পকে পরিচিতি দেয়।
মাটির শিল্পের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো শিশুদের শিক্ষায় এর ভূমিকা। শিশুদের হাতে মাটি নিলে তাদের সৃজনশীলতা, মননশীলতা এবং ধৈর্য বৃদ্ধি পায়। তারা মাটি দিয়ে ঘর, পশু বা পুতুল তৈরি করতে করতে কল্পনার জগতে প্রবেশ করে। এটি শুধু খেলার অংশ নয়, বরং শেখারও একটি কার্যকর পদ্ধতি। গ্রাম বাংলার মাটির শিল্প আমাদের পরিবেশের সঙ্গে সম্পর্কও তৈরি করে। মাটি প্রাকৃতিক এবং পরিবেশবান্ধব, যা আমাদের প্রাকৃতিক সম্পদকে সংরক্ষণে সাহায্য করে। আধুনিক যুগে প্লাস্টিক ও কৃত্রিম জিনিসের ব্যবহার বেড়েছে, কিন্তু মাটির শিল্প আমাদের প্রাকৃতিক ও পরিবেশবান্ধব জীবনধারার সঙ্গে সংযুক্ত রাখে।
আরশী আক্তার সানী
গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
