ঢাকা রোববার, ২৮ ডিসেম্বর ২০২৫, ১৩ পৌষ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

মানবিক সংকট : বৈষম্যের বেড়াজালে পিষ্ট মানবতা

ড. মো. আনোয়ার হোসেন
মানবিক সংকট : বৈষম্যের বেড়াজালে পিষ্ট মানবতা

একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্রের মূলভিত্তি হলো সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার। বাংলাদেশের সংবিধানে প্রতিটি নাগরিকের জীবনের সুরক্ষা এবং আইনের সমান আশ্রয় লাভের অধিকার নিশ্চিত করা হয়েছে। কিন্তু ৫৩ বছরের প্রেক্ষাপট বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, এখানে ‘মানবিকতা’ শব্দটির প্রয়োগ আজ অবধি ব্যক্তি, গোষ্ঠী এবং রাজনৈতিক পরিচয়ের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। যখন একই ধরনের ঘটনায় এক পক্ষ সহানুভূতি পায় এবং অন্য পক্ষ অবহেলা বা মামলার শিকার হয়, তখন রক্ত সবার লাল হলেও নাগরিকের লাশের ওপর যে রাজনৈতিক ও সাম্প্রদায়িক তকমা লাগিয়ে দেওয়া হচ্ছে, তা মূলত একটি গভীর মানবিক সংকটের বহিঃপ্রকাশ।

বাংলাদেশি সমাজ ও রাষ্ট্রীয় কাঠামোর গভীরে প্রোথিত বৈষম্যের ক্ষতগুলো কিছু ঘটনায় অত্যন্ত প্রকট হয়ে উঠেছে। মানবিকতা কোনো নির্দিষ্ট গোষ্ঠী, ধর্ম বা রাজনৈতিক আদর্শের পৈতৃক সম্পত্তি নয়। একটি গণতান্ত্রিক ও স্বাধীন রাষ্ট্রে প্রতিটি প্রাণের মূল্য সমান হওয়ার কথা থাকলেও, সমকালীন বাংলাদেশে আমরা এক অদ্ভুত ‘মানবিক বিভাজন’ প্রত্যক্ষ করছি। কোথাও লাশের ওপর হামলা হচ্ছে, কোথাও লাশের পাশে দাঁড়াচ্ছে। কোথাও ঘাতকের শাস্তির বদলে সান্ত¡না দেওয়া হচ্ছে, আবার কোথাও নিভৃতে ঝরে যাওয়া প্রাণের খবর নেওয়ার কেউ নেই। এই দ্বিমুখী আচরণ শুধু বৈষম্য নয়, বরং এটি রাষ্ট্রের মৌলিক স্তম্ভণ্ডবিচারের সমতার ওপর এক চরম আঘাত। যখন রক্তের রং লাল হওয়া সত্ত্বেও বিবেকের রং রাজনৈতিক বা ধর্মীয় চশমায় নির্ধারিত হয়, তখন বুঝতে হবে সমাজে মানবিকতার দুর্ভিক্ষ চলছে।

মাইলস্টোন স্কুলের শিক্ষার্থীদের বিমান দুর্ঘটনায় মৃত্যুর পর রাষ্ট্রের যে সংবেদনশীলতা ও দায়িত্বশীলতা দেখা গেছে, তা প্রশংসনীয় হলেও অপরাপর ঘটনার সঙ্গে এর তুলনা করলে এক বিশাল ব্যবধান ফুটে ওঠে। এই বৈষম্য প্রমাণ করে যে, সমাজ নাগরিকের মৃত্যুকেও তার ‘রাজনৈতিক আনুগত্য’ বা ‘দুর্ঘটনার ধরন’ দিয়ে পরিমাপ করছে।

সম্প্রতি শরিফুল ওসমান হাদির হত্যাকাণ্ড এবং ‘প্রথম আলো’ ও ‘দ্য ডেইলি স্টার’ কার্যালয়ে হামলার পর সরকারের পক্ষ থেকে যে দ্রুত আশ্বাস ও নিরাপত্তার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে, তা নাগরিক নিরাপত্তা নিশ্চিতের সাধারণ দায়িত্ব। কিন্তু প্রশ্ন জাগে যখন একই গুরুত্ব অন্য ক্ষেত্রে অনুপস্থিত থাকে। ক্ষমতাধর বা প্রভাবশালীদের সুরক্ষায় যে তৎপরতা, তা সাধারণের বেলায় কেন স্থবির? ময়মনসিংহের দীপু চন্দ্র দাস একজন নিরিহ মানুষ হওয়া সত্ত্বেও উগ্রবাদীদের হাতে নিহত হওয়ার পর নীরবতা এক বেদনাদায়ক বাস্তবতাকে তুলে ধরে। তিনি কোনো রাজনৈতিক দলের বড় পদধারী ছিলেন না বা কোনো প্রভাবশালী গণমাধ্যমের প্রতিনিধি ছিলেন না। হয়তো এ কারণেই তার রক্তের মূল্য তুচ্ছ। এটি পরিষ্কারভাবে প্রমাণ করে যে, ‘ধর্মীয়’ বা ‘সামাজিক’ অবস্থানের ভিত্তিতে এখানে মানবিকতার পাল্লা ওঠানামা করে।

আমার মনে হচ্ছে, দীপু চন্দ্র দাসের বিধবা স্ত্রী মানবিক বৈষম্যে আজ ‘রংহীন রক্ত’। দীপু চন্দ্র দাসের বিধবা স্ত্রী আজ হয়তো শ্মশানের ছাইয়ের পাশে বসে কাঁদছেন। পাশের বাড়িতে শরিফুল ওসমানের মৃত্যুর খবরে বড় বড় নেতারা আসছেন, মিডিয়ার ভিড় জমছে। দীপুর অপরাধ ছিল সে অতি সাধারণ, তার কোনো রাজনৈতিক ব্যানার ছিল না। অথচ সন্তান হারানো দুই মায়ের আঁচলই আজ শূন্য। দুই মায়ের চোখের জলই নোনা। শুধু প্রভাবশালীদের রক্তই লাল ? সাধারণ মানুষের কি কোনো পরিচয় নেই? এই বৈষম্যের হাহাকার বাংলার আকাশ-বাতাসকে ভারী করে তুলছে।

বাংলাদেশে সচরাচর মানবিক বৈষম্যের আরও কিছু দৃষ্টান্ত নিচে উল্লেখ করা হলো-

১। বিরোধী দলীয় কর্মীদের ওপর হামলা বা নিহতের ঘটনায় মামলা নিতে অনীহা, কিন্তু‘ ক্ষমতাসীন বা প্রভাবশালী মহলের ক্ষেত্রে তাৎক্ষণিক রাষ্ট্রীয় পদক্ষেপ।

২। প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতাদের জামিন প্রক্রিয়া ও সাধারণ কয়েদিদের দীর্ঘসূত্রিতা।

৩। নির্দিষ্ট পেশাজীবী বা প্রভাবশালী গোষ্ঠীর মৃত্যুর পর পরিবারের জন্য বড় অংকের অনুদান, অন্যদিকে সাধারণ শ্রমিক বা কৃষকের মৃত্যুর পর সামান্য ‘অনুদান’ হিসেবে দায়মুক্তি। পোশাক কারখানায় আগুনে পুড়ে মরলে ক্ষতিপূরণ পেতে যে সংগ্রাম করতে হয়, তা অন্য ভিআইপি দুর্ঘটনার তুলনায় নগণ্য।

৪। নির্দিষ্ট এলাকায় কথিত বন্দুকযুদ্ধের নামে বিচারহীনতা, অথচ অন্যত্র আইনি প্রক্রিয়ার কঠোর অনুসরণ। যেমন- পাহাড়ি অঞ্চলে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনায় রাষ্ট্রের বিচারহীনতার সংস্কৃতি।

৫। বাসের চাপায় ছাত্র মরলে আন্দোলন হয়, কিন্তু মফস্বলের কৃষক মরলে কোনো উচ্চবাচ্য হয় না। নামি-দামি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মৃত্যুর ঘটনায় গভীর সম্পৃক্ততা, কিন্তু গ্রামের সাধারণ মাদরাসা বা স্কুলের দুর্ঘটনায় চরম উপেক্ষা।

৬। সাধারণ মানুষ যখন হাসপাতালের বারান্দায় মারা যায়, তখন ভিআইপিদের তুচ্ছ কারণেও জন্য বিশেষায়িত সেবা।

৭। দুর্যোগের সময় রাজনৈতিক আনুগত্য দেখে সহায়তার তালিকা তৈরি করা হয়।

৮। প্রভাবশালীদের সঙ্গে কথা কাটাকাটি বা সমালোচনা করলেও দ্রুত গ্রেপ্তার, কিন্তু সাধারণ নারী বা নিপীড়িতদের অপমানে প্রশাসনের দীর্ঘসূত্রতা বা নিষ্ক্রিয়তা।

৯। সরকারি দলের মিছিলে নিরাপত্তা, কিন্তু বিরোধী মতের সমাবেশে বাধা।

১০। উচ্চপদস্থ আমলাদের সুযোগ-সুবিধা অফুরন্ত এবং নিম্ন গ্রেডের কর্মচারীদের জন্য সীমাবদ্ধ।

এ পর্যায়ে ‘রক্তের কোনো দল নেই’ শিরোনামের একটি গল্প যোগ করছি : শহরের এক মোড়ে দুটি অ্যাম্বুলেন্স আটকে আছে। একটিতে এক প্রভাবশালী নেতার দেহরক্ষী, অন্যটিতে এক বৃদ্ধ দিনমজুরের লাশ। পুলিশের বাঁশি বাজল, নেতার দেহরক্ষীর গাড়ি ভিআইপি প্রটোকলে উড়ে চলল। পেছনে পড়ে রইল দিনমজুরের সাদা কাফন ঢাকা শরীরটি, যার ওপর ধুলোবালি উড়ছে। কবরের কাছে গিয়ে দেখা গেল, একজনের জন্য রাষ্ট্রীয় গার্ড অব অনার, অন্যজনের জন্য ইমাম ছাড়া জানাজা পড়ার লোকও নেই। অথচ দুজনেই গত রাতে একই মিছিলে প্রতিপক্ষের গুলিতে প্রাণ হারিয়েছিলেন। একজনের রক্ত নিয়ে রাজপথে রাজনীতি হলো, পদণ্ডপদবি ঘোষিত হলো। অন্যজনের স্ত্রী থানায় গিয়ে মামলার আবেদন করলে পুলিশ বলল, ‘ওপরের নির্দেশ নেই।’ কবরের মাটি কি জানে কার শরীরের দাম কত? না, মাটি সবাইকে সমানভাবেই গ্রহণ করে। কিন্তু মাটির ওপরের পৃথিবীটা বড়ই নিষ্ঠুর, এখানে রক্তের রঙের চেয়ে পতাকার রং বেশি জরুরি হয়ে পড়েছে। দিনমজুরের শিশু সন্তানটি শুধু একটি প্রশ্নই করল, ‘মা, বাবা কি অপরাধী ছিল বলে তাকে কেউ দেখতে এলো না?’ মায়ের কান্নার কোনো ভাষা ছিল না, কারণ এই রাষ্ট্রে কান্নারও কোনো সেন্সরশিপ নেই, কিন্তু কান্নার কারণের ওপর নিষেধাজ্ঞা আছে।

বাংলাদেশের ফরতে ফরতে যেন বৈষম্যের চাষাবাদ হচ্ছে। বৈষম্যের যাতনা লিখতে যেন হাপিয়ে উঠেছি, এইজন্য এ ধাপে অতি সংক্ষেপে

‘মানবিকতার প্যাকেজ’ শিরোনামে একটি রম্য গল্প শেয়ার করছি : এক লোক স্বর্গে গিয়ে দেখল তিন ধরনের লাইনের ব্যবস্থা। এক লাইনে ভিআইপিরা সোফায় বসে এসি খাচ্ছে, অন্য লাইনে সাধারণ মানুষ রোদে দাঁড়িয়ে আছে। লোকটা যমরাজকে জিজ্ঞেস করল, ‘এখানেও বৈষম্য?’ যমরাজ হাসিমুখে উত্তর দিল, ‘এটা বৈষম্য না বাপু, এটা হলো ‘বাংলাদেশি প্রিমিয়াম সাবস্ক্রিপশন’। যারা দুনিয়ায় প্রভাবশালী ছিল, তাদের জন্য স্পেশাল প্যাকেজ।’ লোকটা বলল, ‘তা আমার জন্য কী আছে?’ যমরাজ বলল, ‘তোমার আমলনামা বলছে তুমি গঞ্জের ওই মিছিলে ছিলে, তোমার জন্য আলাদা ‘মামলা প্যাকেজ’ আছে। কবরে যাওয়ার পর তোমার নামে আরও তিনটে চার্জশিট জমা হয়েছে!’ লোকটা কপালে হাত দিয়ে বলল, ‘মরেও শান্তি নেই, এখন কি নরকেও উকিল ধরতে হবে?’ যমরাজ টিপ্পনী কেটে বলল, ‘না, এখানে উকিল নেই, তবে তোমার মানবিকতা চেক করার জন্য একটি দল গঠন করা হয়েছে, যারা তোমার রাজনৈতিক পরিচয় না পেলে ফাইল নড়াবে না!’

এ পর্যায়ে আমরা না হয় সম্মিলিতভাবে বৈষম্য লাগাম টেনে ধরতে অগ্রসর হই-

প্রথমত, সব ধরনের বৈষম্য দূর করতে হলে, বাংলাদেশ সরকারকে হতে হবে দল-মতের ঊর্ধ্বে। অপরাধীর পরিচয় শুধু ‘অপরাধী’ হিসেবেই দেখতে হবে। প্রতিটি হত্যাকাণ্ডের নিরপেক্ষ তদন্ত এবং ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোকে সমপরিমাণ রাষ্ট্রীয় সহায়তা নিশ্চিত করতে হবে।

দ্বিতীয়ত, জনগণকেও বৈষম্যের দলীয় রঙ্গিন চশমা খুলে নিজেদের স্বার্থে ‘মানুষ’ হিসেবে মানুষের পাশে দাঁড়াতে হবে। যখন একজনের অধিকার খর্ব হয়, তখন অন্য সবাইকে সোচ্চার হতে হবে, নতুবা কাল নিজের ওপর বিপদ এলে কাউকে পাশে পাওয়া যাবে না।

তৃতীয়ত, মানবাধিকার সংস্থাগুলোকে সরকারি অনুদান বা চাপের মুখে নত না হয়ে বৈষম্যের প্রকৃত চিত্র তুলে ধরতে হবে। প্রতিটি লাশের হিসাব রাখা এবং বৈষম্যের চিত্রগুলো সাহসের সাথে তুলে ধরা তাদের নৈতিক দায়িত্ব।

আমাদের সবার মনে রাখতে হবে, বৈষম্য হলো একটি ঘুণপোকা যা রাষ্ট্রের ভিত্তিকে ভেতর থেকে খেয়ে ফেলে। কারণ, সবার জীবনের মূলে ছিল একেকটি স্বপ্ন। হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান বা মুসলিমণ্ডসৃষ্টিকর্তা কাউকে বিশেষ সুবিধা দিয়ে পাঠাননি। রক্ত সবারই লাল, শোক সবারই বেদনার। একটি সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়তে হলে আমাদের এই ‘মানবিক বিভাজন’ থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। আজ যারা বৈষম্যের শিকার, কাল তারাই হয়তো পরিবর্তনের কারিগর হবে। আসুন, রক্তের দাগ মুছে আমরা মানুষের পরিচয়ে পরিচিত হই।

যেখানে অধিকার হবে সবার জন্য সমান, আর মানবিকতা হবে একমাত্র ধর্ম এবং কর্ম।

পরিশেষে বলতে চাই, একটি রাষ্ট্রের যখন নাগরিকের জীবনের মূল্য তার রাজনৈতিক পরিচয় বা ধর্মীয় বিশ্বাসের ভিত্তিতে নির্ধারিত হয়, তখন সেই রাষ্ট্রের ভিত্তি নড়বড়ে হয়ে পড়ে। ওসমান হাদি থেকে দিপু, মাইলস্টোন স্কুল থেকে ডেইলিস্টার-রক্তের কোনো বিভেদ নেই। বিভেদ আমাদের দৃষ্টিভঙ্গিতে। মানবিকতার আকাল দূর করতে হলে রাষ্ট্রকে তার ‘পিতা’ সুলভ আচরণে ফিরতে হবে, যেখানে বড় ছেলে আর ছোট ছেলের মধ্যে কোনো বৈষম্য থাকবে না। আইনের চোখে সবাই সমান, এই প্রবাদটি যেন শুধু পাঠ্যবইয়ে সীমাবদ্ধ না থাকে। যদি আমরা আজ ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে না পারি, তবে আগামীর ইতিহাস আমাদের ক্ষমা করবে না। বৈষম্যহীন বাংলাদেশ গড়তে হলে আমাদের প্রয়োজন একটি সংবেদনশীল রাষ্ট্র ব্যবস্থা এবং জাগ্রত জনবিবেক। যেখানে প্রতিটি মানুষ বুক ফুলিয়ে বলতে পারবে, আমি এ দেশের সমান অধিকার সম্পন্ন নাগরিক।

ড. মো. আনোয়ার হোসেন

প্রাবন্ধিক ও কথা সাহিত্যিক

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত