প্রিন্ট সংস্করণ
০০:০০, ২৮ ডিসেম্বর, ২০২৫
সততাই পরম ধর্ম এই বাক্যটি আমরা প্রায়ই উচ্চারণ করি। অথচ বাস্তব জীবনে এই সত্যের ধর্মকে অস্বীকার করতেই যেন আমাদের দ্বিধা নেই। কারণ, মিথ্যার প্রতি এক গভীর অথচ অস্বীকার্য আকর্ষণ আমরা প্রত্যেকেই কমবেশি অনুভব করি। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় মিথ্যাগুলোর একটি উচ্চারিত হয় ধর্মগ্রন্থ স্পর্শ করে আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে। অস্তিত্বের ভয়ে, নিরাপত্তার তাগিদে কিংবা স্বার্থের প্রয়োজনে মিথ্যার আশ্রয় নেওয়াকে আমরা মানবীয় দুর্বলতা বলে মেনে নিই।
অথচ সত্য তেলের মতো- যতই তার ওপর জল ঢালা হোক না কেন, সে ভেসে উঠবেই।
মিথ্যার সমাজে সত্যকে গ্রহণ করা সহজ নয়। কারণ, সত্যকে এমনভাবে বিকৃত করে উপস্থাপন করা হয় যে, সমাজ মিথ্যাকেই সত্য হিসেবে মেনে নিতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। বর্তমান পৃথিবীতে মানুষের আবেগ, কথা ও বিশ্বাস- সবই যেন কৃত্রিমতায় মোড়া।
এক বিশাল জনসংখ্যা নিজের অজান্তেই বহন করছে মিথ্যার মুখোশ। রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, পারিবারিক, প্রাতিষ্ঠানিক ও প্রশাসনিক প্রায় সব ক্ষেত্রেই মিথ্যা পুরস্কৃত হয়। মিথ্যা মামলা, মিথ্যা অপবাদ, মিথ্যা সাক্ষ্য ও মিথ্যা বিবরণী ধ্বংস করে দেয় একের পর এক নিষ্পাপ ও নির্দোষ জীবন।
সমাজের চিরায়ত প্রথা অনুযায়ী মানুষ যা শোনে, তাই বিশ্বাস করে।
আবেগমাখা কথাগুলো অজান্তেই আমাদের বিশ্বাসযোগ্য মনে হয়। কারণ, ঘটে যাওয়া প্রতিটি ঘটনার সাক্ষী হওয়ার সুযোগ সবার হয় না। অল্প কয়েকটি সত্যের উচ্চারণে তাই গণমানুষের আস্থা তৈরি হয় না। যেখানে মিথ্যাকে প্রতিষ্ঠিত করা হয়, সেখানে সত্য প্রকাশ করা যেন বৈপরীত্য কিংবা শত্রুতা ঘোষণার নামান্তর। তাই তো প্রচলিত একটি কথা রয়েছে ‘অপ্রিয় সত্য কেউ শুনতে চায় না।’
মানুষ সামাজিক জীব; মন্তব্য, সমালোচনা ও মতামত প্রকাশ তার স্বভাবের অংশ। কিন্তু সমালোচনার মুখোমুখি হওয়ার ভয়ে অধিকাংশ মানুষ সত্য প্রকাশে পিছিয়ে যায়। ‘লোকে কী বলবে’ এই আশঙ্কা সত্যের পথে মানসিক প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে।
কিন্তু সত্যকে কি চিরকাল চেপে রাখা যায়? মিথ্যার এই জাল ভেদ করে কি সত্য কখনো উঁকি দেয় না? ইতিহাস বলে প্রতিটি সমাজেই কিছু কিংবদন্তি মানুষ জন্ম নেয়, যারা সত্যের নামে লড়াই করে।
মিথ্যা কখনো কখনো সাময়িকভাবে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি থেকে রক্ষা করলেও সত্য যে চিরন্তন- এ বিশ্বাস করা কঠিন নয়। সত্য কখনো চিরনিদ্রায় থাকে না; সময় হলে সে নিজেই আত্মপ্রকাশ করে। মিথ্যার যত শক্ত আবরণই তৈরি করা হোক না কেন, সত্য সবার ঊর্ধ্বে অবস্থান করে। সত্যই নির্দোষকে বাঁচার প্রেরণা দেয়, সত্যই নিখুঁতের প্রতীক। সত্য খোলা আকাশের মতো যেখানে কেবল বাস্তবতারই ঠাঁই।
১৬-১৭ বছরের স্বৈরশাসনের বাস্তবতা ও সত্যতা প্রকাশ পেয়েছে ২০২৪-এর জুলাই আন্দোলনে। সত্য কখনো চাপা থাকে না; সময়ের আড়াল ভেঙে জনসমক্ষে আসে। মিথ্যার চাদরে মোড়া সামাজিক ও রাজনৈতিক বাস্তবতা সময়ের প্রবাহে একসময় তীরে এসে ধরা দেয়।
দাম্পত্য জীবনের ক্ষেত্রেও সত্যের শক্তি অনস্বীকার্য। একটি ছোট মিথ্যাই ভেঙে দিতে পারে হাজারো স্মৃতিতে জড়ানো সম্পর্ক। স্বামী কিংবা স্ত্রী যেকোনো পক্ষের বলা মিথ্যা বা সাজানো নাটক যখন সত্যের মুখোমুখি হয়, তখন ভালোবাসা আর ‘বিশ্বাস’ নামক অদৃশ্য বন্ধনটিকে আঁকড়ে রাখতে পারে না। মানবমন কঠিন; সেখানে বিশ্বাস স্থাপন করা কষ্টসাধ্য। বহু কষ্টে অর্জিত সেই বিশ্বাস একটি সামান্য মিথ্যার কাছেই পরাজিত হয় আর তখনই সত্যের শক্তি উপলব্ধি হয়। সত্য কখনো ধোঁকা দেয় না; ধোঁকার জন্ম দেয় মিথ্যাই।
মিথ্যা ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর স্বার্থ রক্ষায় কাজ করে। লোভ, স্বার্থপরতা ও হিংসা থেকেই মিথ্যার জন্ম। হাজারো মিথ্যার ভিড়ে তাই সত্য হয়ে ওঠে নির্মম বাস্তবতা। যেখানে শিক্ষা ব্যবস্থাই মিথ্যার আশ্রয় নেয়, সেখানে সত্যের মূল্য উপলব্ধি করা কঠিন। প্রশ্নপত্র ফাঁস, ঘুষের বিনিময়ে নিয়োগ, মেধার অবমূল্যায়ন এসবের ভিড়ে সত্যের জন্য লড়াই কিছু মানুষের কাছে বিশ্বযুদ্ধের মতো কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। হুমকি ও চাপের মুখে যোগ্য মানুষ নীরব হয়ে যায়; সত্য ঢেকে পড়ে বাস্তবতার ভারে।
রাষ্ট্রীয় অনুদান আত্মসাৎ, উন্নয়ন প্রকল্পে ভুয়া ব্যয় দেখানো এসব মিথ্যার মাঝেই গরিব মানুষ তার কঠিন বাস্তবতাকে সহজভাবে মেনে নেয়। ব্রিজের নিচে থাকা পথশিশুদের স্বপ্নে শিক্ষা বা চিকিৎসার ঠাঁই নেই। সমাজের মিথ্যার বিস্তার সেখানে ভয়াবহ রূপ নেয়।
দান ও অনুদানও আজ অনেকাংশে লোকদেখানো। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রদর্শনীর জন্য দান করা হয়, মানবিকতার জন্য নয়।
সবচেয়ে বড় মিথ্যার মঞ্চ হয়ে উঠেছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম। এখানে কৃত্রিম সত্তা তৈরি করে প্রতিনিয়ত ধোঁকা দেওয়া হয় কোটি মানুষের। সম্পর্ক, অর্থ, স্বপ্ন সবকিছুই এখানে অনিশ্চিত। কেউ পাচারের শিকার হয়, কেউ সন্ত্রাসীদের হাতে পড়ে, কেউ জীবন-মৃত্যুর খেলায় জড়িয়ে যায়। তবুও মানুষ আশায় বুক বাঁধে কারণ কখনো কখনো সত্য হাত বাড়ায়, ফিরে আসে আপনজন, বেঁচে যায় একটি পরিবার।
আইন থাকা সত্ত্বেও মিথ্যার বিস্তার আইন ব্যবস্থাকেও গ্রাস করেছে। মিথ্যা মামলা ও সাক্ষ্যে নির্দোষ মানুষ বছরের পর বছর কারাগারে কাটায়। চার দেয়ালের ভেতর নিঃশেষ হয় হাজারো স্বপ্ন।
তবুও সত্য আসে হয়তো দেরিতে, হয়তো ক্ষতির পর। মিথ্যার কারণে ভেঙে যায় পরিবার, আর সত্য সমাজের কালো মেঘ সরিয়ে আলো জ্বালে। ধর্মীয় বিশ্বাসেও তাই সত্যকে সর্বোচ্চ মর্যাদা দেওয়া হয়েছে। মিথ্যাকে জয়ী হতে না দেওয়ার সংকল্প প্রতিটি মানুষের হৃদয়ে ধারণ করতে হবে।
মিথ্যার সমাজে সত্যের পক্ষে দাঁড়ানো মানেই অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো। ভয়, সামাজিক চাপ ও ঝুঁকির কারণে অনেকে পিছিয়ে যায়। তবুও প্রতিটি সমাজেই কিছু মানুষ থাকে, যারা সত্যের জন্য লড়াই করে। হয়তো দেরিতে, কিন্তু একদিন সত্যের দেখা মেলে আর মিথ্যা ফিরে যায় তার কফিনে।
হাফছা বিনতে আমিন
শিক্ষার্থী, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ