প্রিন্ট সংস্করণ
০০:০০, ২৮ ডিসেম্বর, ২০২৫
সম্প্রতি ঢাকার রাজপথে একের পর এক ঘটে যাওয়া বিভীষিকাময় ঘটনা আমাদের জাতীয় বিবেককে ক্ষতবিক্ষত করে দিয়েছে। শরিফ ওসমান বিন হাদির মতো মেধাবী তরুণের নৃশংস হত্যাকাণ্ড, ককটেল বিস্ফোরণে পথচারী যুবক সিয়ামের অকাল মৃত্যু কিংবা ময়মনসিংহে দীপু চন্দ্র দাসের ওপর চালানো মধ্যযুগীয় বর্বরতা। এসব কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। এগুলো আমাদের পঙ্গু সমাজ ব্যবস্থা এবং রাষ্ট্রীয় বিচারহীনতার সংস্কৃতির এক একটি জীবন্ত দলিল।
প্রতিটি ঘটনার পর আমরা শোকার্ত হই। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রতিবাদের ঝড় তুলি। এরপর এক সময় সব স্তিমিত হয়ে যায় কিন্তু মূল প্রশ্নটি থেকেই যায়। কেন এই দেশে ইনসাফের ফয়সালা হয় না? হাদি, সিয়াম বা দীপুদের মতো সাধারণ মানুষের জীবনের কি তবে কোনো মূল্য নেই?
আমাদের রাজপথগুলো আজ মৃত্যুর উপত্যকায় পরিণত হয়েছে। সড়ক দুর্ঘটনার নামে যে নিরব গণহত্যা চলছে, তার ফিরিস্তি দীর্ঘ। পরিসংখ্যানে দেখা যায়, প্রতি বছর হাজার হাজার মানুষ প্রাণ হারাচ্ছে। কিন্তু দায়ীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির হার নগণ্য। আইন আছে ঠিকই, কিন্তু সাধারণ মানুষের জন্য তার প্রয়োগ যেন এক দুর্ভেদ্য পাহাড়। অন্যদিকে, রাজনৈতিক প্রতিহিংসা আর সহিংসতার বলি হচ্ছে সিয়ামের মতো সাধারণ মানুষ। তাদের রক্তের ওপর দাঁড়িয়ে রাজনীতির হিসাব-নিকাশ হলেও বিচারিক প্রক্রিয়ায় তারা থেকে যায় ব্রাত্য।
সবচেয়ে ভয়াবহ চিত্র ফুটে উঠেছে গণপিটুনি আর উগ্র উন্মত্ততার মধ্যে। ময়মনসিংহে দীপু চন্দ্র দাসের ওপর যে বর্বরতা চালানো হয়েছে, তা সভ্য সমাজের ললাটে এক কলঙ্কিত তিলক। মব জাস্টিস বা ‘উন্মত্ত জনতার বিচার’ যখন আইনের শাসনের জায়গা দখল করে নেয়, তখন বুঝতে হবে রাষ্ট্রের স্তম্ভগুলো ক্ষয়িষ্ণু হয়ে পড়েছে। অপরাধীদের রাজনৈতিক আশ্রয়-প্রশ্রয় আর বিচারহীনতার নিশ্চয়তা এই পরিস্থিতিকে আরও উস্কে দিচ্ছে।
কেন আমাদের দেশে বিচার পৌঁছাতে দেরি হয়? এর উত্তর লুকিয়ে আছে আমাদের ক্ষমতার কাঠামোর গভীরে। এখানে আইন চলে লাঠির জোরে। আর বিচার বিভাগ যেন দীর্ঘসূত্রতার গোলকধাঁধা। ক্ষমতাবানরা যেখানে ধরা ছোঁয়ার বাইরে, সেখানে সাধারণ মানুষের দীর্ঘশ্বাসই একমাত্র সম্বল। অধিকাংশ ক্ষেত্রে মামলাগুলো আপস-মীমাংসার নামে ধামাচাপা দেওয়া হয় অথবা বছরের পর বছর ঝুলে থাকে। ফলে অপরাধীরা আরও সাহসী হয়ে ওঠে আর ভুক্তভোগীরা হারায় শেষ ভরসা। এই বিচারহীনতা কি তবে আমাদের নিয়তি? এই দাসত্ব কি আমরা চিরকাল বয়ে বেড়াব? উত্তর হলো ‘না’। আমাদের এই নিশ্চলতা ভাঙতে হবে। শহিদ ওসমান হাদি যেমনটি বলেছিলেন-
‘দাসত্ব যে জমিনের নিশ্চল নিয়তি,
লড়াই সেখানে সর্বোত্তম ইবাদত।’
আজ সময় এসেছে এই লড়াইয়ের। এই লড়াই শুধু রাজপথের নয়। এই লড়াই হবে মনস্তাত্ত্বিক। বিচারহীনতার এই জগদ্দল পাথর সরাতে হলে আমাদের প্রত্যেককে ন্যায়ের পক্ষে সোচ্চার হতে হবে। অপরাধী যে-ই হোক, তার পরিচয় কেবল ‘অপরাধী’ হিসেবেই নিশ্চিত করতে হবে।
সরকারের ওপর দায় চাপিয়ে হাত গুটিয়ে বসে থাকার দিন শেষ। আমাদের সম্মিলিত কণ্ঠস্বর যখন ইনসাফ আর সুশাসনের দাবিতে প্রকম্পিত হবে, তখনই শুধু হাদি, সিয়াম আর দীপুদের আত্মার শান্তি মিলবে। আসুন, এই দাসত্বের শৃঙ্খল ছিন্ন করি। লড়াই করি এমন এক বাংলাদেশের জন্য, যেখানে আর কোনো মাকে তার সন্তানের রক্তমাখা জামা জড়িয়ে কাঁদতে হবে না। ইনসাফের জয় হোক, জয় হোক মানবতার।
রাকিবুল ইসলাম
শিক্ষার্থী, রসায়ন বিভাগ