ঢাকা রোববার, ২৮ ডিসেম্বর ২০২৫, ১৩ পৌষ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

পথশিশু সভ্যতার অস্বস্তিকর আয়না

নুশরাত জাহান অনন্যা
পথশিশু সভ্যতার অস্বস্তিকর আয়না

ইউনিসেফের বিভিন্ন রিপোর্ট ও নিবন্ধে একটি বক্তব্য বারবার উঠে এসেছে, তা হলো- Street children are not the problem; they are the result of problems society has failed to address। বাস্তবতাও তাই বলে। পথশিশুরা কোনো বিচ্ছিন্ন বা আকস্মিক সামাজিক সমস্যা নয়। বরং তারা রাষ্ট্র ও সমাজের দীর্ঘদিনের ব্যর্থতার জীবন্ত দলিল। ইতিহাসের দিকে তাকালেই এর স্পষ্ট প্রমাণ মেলে। ইউরোপের শিল্প বিপ্লবের সময় (১৮শ-১৯শ শতক) গ্রাম থেকে শহরে ব্যাপক অভিবাসনের ফলে অসংখ্য শিশু পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। জীবিকার সন্ধানে ছুটে আসা পরিবারগুলো শহরের নির্মম বাস্তবতায় টিকে থাকতে না পেরে ভেঙে পড়ে, আর তার সবচেয়ে বড় শিকার হয় শিশুরা। লন্ডন, প্যারিস কিংবা রোমের মতো শহরে তখন এসব শিশু পরিচিত ছিল ‘স্ট্রিট আরচিনস’ নামে শহরের উন্নয়নের ছায়ায় বেড়ে ওঠা এক অবহেলিত জনগোষ্ঠী। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ইউরোপে সৃষ্টি করে আরও ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয়। যুদ্ধশেষে অসংখ্য অনাথ ও ভবঘুরে শিশু গন্তব্যহীন হয়ে পড়ে। পরিবার, পরিচয় কিংবা নিরাপদ আশ্রয় সবকিছু থেকেই তারা বঞ্চিত হয়। পথ, ফুটপাত কিংবা পরিত্যক্ত ভবনই হয়ে ওঠে তাদের শেষ আশ্রয়। এই বাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিতেই আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো পথশিশু বিষয়টিকে গুরুত্ব দিতে শুরু করে। ১৯৮০-এর দশকে জাতিসংঘ ও ইউনিসেফ আনুষ্ঠানিকভাবে street children শব্দটির স্বীকৃতি দেয় এবং শিশু অধিকার সনদসহ একাধিক আন্তর্জাতিক চুক্তির মাধ্যমে তাদের সুরক্ষা, শিক্ষা ও মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করার প্রতিশ্রুতি দেয়। তবুও প্রশ্ন থেকে যায় এত সনদ, এত অঙ্গীকারের পরও কেনো আজও পথশিশুরা রাস্তায় বড় হয়? বাংলাদেশের সাম্প্রতিক (২০২৫) প্রতিবেদনে দেখা যায়, দেশে প্রায় ৩.৪ মিলিয়ন পথশিশু রয়েছে। শুধু ঢাকা শহরেই এই সংখ্যা প্রায় ১০ লক্ষ। জাতীয় জরিপ আরও জানায়, প্রায় ৯০ শতাংশ পথশিশুরই পিতা-মাতা জীবিত, এমনকি অনেকের নিজস্ব ঘরও রয়েছে। তবুও তারা রাস্তায় থাকে, ঝুঁকিপূর্ণ ও অনৈতিক কাজে জড়িয়ে পড়ে, এবং অপ্রাপ্তবয়স্ক অবস্থাতেই শ্রমে নিযুক্ত হয়। এই তথ্য আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দুটি গভীর সমস্যার কথা বলে। প্রথমত, পরিবার পরিকল্পনা সম্পর্কে পর্যাপ্ত জ্ঞানের অভাব। অনেক অভিভাবকের মধ্যেই এখনো ধারণা কাজ করে যে, যত সন্তান হবে, ততই আল্লাহ দেবেন। এই বিশ্বাস আপাতদৃষ্টিতে ধর্মীয় ও আশাবাদী মনে হলেও বাস্তবে এটি রাষ্ট্র ও সমাজের জন্য মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ। সন্তান জন্ম দেওয়াই যদি দায়িত্বের শেষ ধাপ হয়, তবে সেই সন্তানের জীবন, শিক্ষা ও নিরাপত্তার দায় কে নেবে? যেখানে নিজস্ব টিকে থাকার ব্যবস্থাই নেই, সেখানে একের পর এক সন্তান জন্ম দেওয়া কেবল ব্যক্তিগত নয় এটি একটি সামাজিক সংকট। রাষ্ট্র জন্ম দিতে দেয়, কিন্তু বাঁচার নিশ্চয়তা দিতে ব্যর্থ হয়। ফলে এই শিশুরা কেবল সংখ্যায় যুক্ত হয়, কিন্তু জাতীয় উন্নয়নের অংশ হতে পারে না। এই ব্যর্থতার দায় রাষ্ট্রকেই নিতে হবে। পরিবার পরিকল্পনা, সন্তান নেওয়ার প্রস্তুতি এবং বাস্তব জীবনের সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে জনগণকে সচেতন করা রাষ্ট্রের মৌলিক দায়িত্ব। পাড়ায়, পাড়ায় ওলিতে গলিতে প্রত্যেকের মাঝে বাস্তবতার জ্ঞান ও সচেতনতার বিস্তার করতে হবে। মেধাবীদেরকে এই কাজে নিযুক্ত করতে হবে। উদ্যোগ নিতে হবে যেন সকলে এই বিষয়ে অবগতি হবে। অতঃপর সেই হিসেবে সিদ্ধান্ত নেবে, সচেতন হবে। সর্বশেষ মূর্খতার পরিমাণ হ্রাস পাবে। দ্বিতীয়ত, অর্থনৈতিক বৈষম্য ও জীবনযাত্রার ব্যয় অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যাওয়া। পথশিশুদের জীবনের অন্যতম বড় সংকট হলো শিক্ষা থেকে ছিটকে পড়া। রাষ্ট্র বিনামূল্যে শিক্ষার কথা বললেও বই, খাতা, পোশাক ও যাতায়াত সব মিলিয়ে শিক্ষার খরচ এত বেশি যে এটি পথশিশুদের কাছে কেবল একটি দূরবর্তী স্বপ্ন। যে শিশুর প্রতিদিনের চিন্তা থাকে আজ খাবার জুটবে কি না, তার কাছে স্কুলে যাওয়া বিলাসিতা ছাড়া কিছু নয়। ফলে তারা অল্প বয়সে শ্রম বাজারে ঢুকে পড়ে। কিন্তু এখানেও বাস্তবতা নির্মম। সারাদিন কাজ করেও যা মিলে তা দিয়ে একবেলা খাবার জোটে, ভবিষ্যৎ নয়। অনেক শিশুর পিতা-মাতা নিজেদের শ্রম করার পাশাপাশি তাদের সন্তানদেরও চাপ দেয় শ্রম করতে। এই সমস্যাকে একটি বাক্যে বলতে গেলে বলা যায়, যত আয় তার চেয়ে বেশি ব্যায়, কারণ নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের লাগাম ছাড়া মূল্যবৃদ্ধি। চাল, ডাল, তেল ইত্যাদি বাজারের এই উর্ধ্ব গতির পেছনে বৈশ্বিক কারণের পাশাপাশি আছে দেশীয় অব্যবস্থাপনা, সিন্ডিকেট ও দুর্নীতি। রাষ্ট্র যখন বাজার নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয় তখন তারা দ্রব্যমূল্যের দাম বাড়িয়ে দেয়। যার সরাসরি প্রভাব ফুটপাতে থাকার শিশুগুলো ভোগে। সামাজিক নিরাপত্তা, কর্মসূচি প্রকল্প কিংবা দারিদ্র বিমোচনের উদ্যোগ সবকিছুই আছে নীতির খাতায় কিন্তু বাস্তবায়নে পথশিশুরা বারবার বাদ পড়ে। কারণ তারা ভোটব্যাংক নয়, তারা চাহিদা তুলতে পারে না, তারা পরিসংখ্যানের বাইরের মানুষ। সরকার প্রতিনিয়ত ব্যর্থ হয় এই সকল পথ শিশুগুলোকে জাতীয় উন্নতির খাতে দাঁড় করাতে। পথশিশু সমস্যার সমাধান এককালীন দান বা সহানুভূতিতে নয় বরং এর জন্য প্রয়োজন রাষ্ট্রকেন্দ্রিক, কাঠামোগত ও রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। বাস্তব অর্থে বিনামূল্যে শিক্ষা, নিরাপদ আশ্রয়, পারিবারিক পুনর্বাসন, অভিভাবকদের আয় বৃদ্ধির সুযোগ এবং শক্তিশালী সামাজিক সুরক্ষা ব্যবস্থা এসবই হতে হবে সমাধানের ভিত্তি। পথশিশুরা কোনো বিচ্যুতি নয়। তারা আমাদের সভ্যতার সবচেয়ে অস্বস্তিকর আয়না। এই আয়নায় চোখ রাখতে না পারলে, উন্নয়নের গল্প যত বড়ই হোক তা অসম্পূর্ণই থেকে যাবে।

নুশরাত জাহান অনন্যা

শিক্ষার্থী, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত