আর্থিক সংকটে পড়া পাঁচটি শরিয়াভিত্তিক বেসরকারি ব্যাংক একীভূত করে গঠন করা হচ্ছে একটি নতুন বৃহৎ ইসলামি ব্যাংক। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে এ প্রক্রিয়া শুরু হচ্ছে। নতুন এ ব্যাংকের অনুমোদন দেবে বাংলাদেশ ব্যাংক। প্রাথমিক পর্যায়ে মূলধন সরবরাহ করবে সরকার।
একীভূত হতে যাওয়া ব্যাংক : ১. ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, ২. গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক, ৩. ইউনিয়ন ব্যাংক, ৪. সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক, ৫. এক্সিম ব্যাংক। এর মধ্যে এক্সিম ব্যাংকের মালিকানা আওয়ামী লীগ ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ী নজরুল ইসলাম মজুমদারের। অন্য চারটি ব্যাংক এস আলম গ্রুপের নিয়ন্ত্রণে; যারা বিগত সরকারের ঘনিষ্ঠ ছিল।
একীভূতকরণ প্রক্রিয়ার রূপরেখা : বাংলাদেশ ব্যাংক ৪ জুন ২০২৫ তারিখের এক বৈঠকে পাঁচ ব্যাংকের চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালকদের নতুন ব্যাংক গঠনের প্রাথমিক সিদ্ধান্ত জানায়। বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর ও ডেপুটি গভর্নর কবির আহম্মদ।
প্রক্রিয়াটির যত ধাপ : ১. সম্পদ ও দায় নিরীক্ষা : বিদেশি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে পাঁচ ব্যাংকের সম্পদের মান নিরীক্ষা এরই মধ্যে সম্পন্ন হয়েছে। কেউ চাইলে আপত্তি জানাতে পারবে। নিজেকে সবল প্রমাণ করলে তালিকা থেকে বাদ পড়ার সুযোগও থাকবে। ২. সম্পদ হস্তান্তর : খেলাপি ঋণগুলো সম্পদ ব্যবস্থাপনা কোম্পানির কাছে হস্তান্তর করা হবে; যাতে নতুন ব্যাংকটির খেলাপি ঋণ ১০ শতাংশের নিচে থাকে। ৩. নতুন ব্যাংকের লাইসেন্স : এরপর নতুন ব্যাংকের লাইসেন্স অনুমোদন দেবে বাংলাদেশ ব্যাংক। এর মূলধন যোগাবে সরকার এবং উন্নয়ন সহযোগীরা। পরবর্তীতে শেয়ার ছেড়ে বেসরকারি উদ্যোক্তাদের সম্পৃক্ত করা হবে।
ব্যাংকগুলোর আর্থিক চিত্র : বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, পাঁচ ব্যাংকের সম্মিলিত গ্রাহক সংখ্যা ৯২ লাখ। আমানত ১ লাখ ৪৫ হাজার কোটি টাকা। ঋণ ২ লাখ ১৫ হাজার কোটি টাকা। শাখা ৭৭৯টি। জনবল ১৫ হাজারের বেশি। তবে উদ্বেগের বিষয় হলো, এস আলম গ্রুপ একাই চার ব্যাংকের অধিকাংশ ঋণ নিয়েছে। যেমন- ইউনিয়ন ও গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকের প্রায় ৯০ শতাংশ এবং ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের ৭০ শতাংশ ঋণ এস আলম সংশ্লিষ্ট। এক্সিম ব্যাংকের ১০ শতাংশ ঋণ সাবেক চেয়ারম্যানের সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানে দেওয়া হয়েছে।
পরিকল্পনার সম্ভাবনা ও চ্যালেঞ্জ : নতুন ব্যাংকের প্রাথমিক কাজ হবে ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তা খাতে অর্থায়ন নিশ্চিত করা। ব্যাংকটি ধাপে ধাপে একীভূত হবে। পুরনো ব্যাংকের গ্রাহকেরা স্বয়ংক্রিয়ভাবে নতুন ব্যাংকের গ্রাহক হিসেবে বিবেচিত হবেন। যদিও বাংলাদেশ ব্যাংক আশ্বস্ত করছে, গ্রাহকের লেনদেনে কোনো ব্যাঘাত ঘটবে না এবং অধিকাংশ কর্মকর্তা চাকরিতে বহাল থাকবেন, তবে একীভূতকরণ শেষে জনবল ছাঁটাইও হতে পারে।
একীভূতকরণে প্রতিবন্ধকতা : প্রতিটি ব্যাংক লিমিটেড কোম্পানি। তাই এ ব্যাংকগুলোকে একীভূত করার ক্ষেত্রে কিছু সমস্যা তো হবেই। একই বিল্ডিংয়ে একাধিক ব্যাংকের শাখা রয়েছে। তবে প্রাথমিকভাবে সবগুলো ব্যাংকই সরকারি মালিকানায় চলে যাবে। ঘোষণা করা হবে, এগুলো সরকারি ব্যাংক। সরকার থেকেই ব্যাংকগুলো পরিচালনার সিদ্ধান্ত আসবে। আপাতত এ ব্যাংকগুলো ভিন্ন ভিন্নভাবে ট্রায়াল অ্যান্ড অর্ডারের মাধ্যমে চলবে। অর্থাৎ সিদ্ধান্ত আসবে এক জায়গা থেকে বা কেন্দ্রীয় কমান্ডের মাধ্যমে ব্যাংকগুলো পরিচালিত হবে। প্রতিটি ব্যাংকে আলাদা এমডি, চেয়ারম্যানসহ অনেক কর্মকর্তা-কর্মচারী আছেন। একীভূত করা হলে এ ক্ষেত্রে কী করা হবে, এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংক জানিয়েছে, প্রাথমিকভাবে কোনো কর্মকর্তা-কর্মচারীকে চাকরিচ্যুত করা হবে না, বেতনও কমবে না। তবে ব্যাংকগুলোতে প্রশাসক নিয়োগ হতে পারে। একটি ব্যাংক হলে একটি বোর্ড হতে পারে। সেখানে একজন প্রশাসক থাকতে পারে। প্রতিটি ব্যাংক আলাদা আলাদাভাবে কাজ করে যাবে।
অর্থনীতিবিদদের সংশয় প্রকাশ : ব্যাংক খাত সংস্কারের অংশ হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংকের একীভূতকরণ প্রক্রিয়া নিয়ে সংশয় প্রকাশ করছেন অর্থনীতিবিদরা। তারা বলছেন, সমস্যার মূলে না গিয়ে পাঁচটি বা ১০টি ব্যাংক একীভূত করা হলে মূল সমস্যার সমাধান হবে না। এ ছাড়া এ ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক মানদ- মানা হচ্ছে না বলেও মনে করছেন খাতসংশ্লিষ্ট অনেকে। এ প্রক্রিয়া দিয়ে ব্যাংকিং খাতের মূল সমস্যা সমাধান করা যাবে না; বরং আরও নতুন সমস্যার সৃষ্টি হবে। চাপিয়ে দেওয়ার মাধ্যমে ব্যাংকগুলোকে একীভূত করলেই হবে না। সামগ্রিকভাবে ব্যাংকগুলোতে সুশাসন নিশ্চিত করতে হবে। ফরেনসিক অডিট সঠিকভাবে হয়েছে কি না, সে বিষয়েও প্রশ্ন রয়েছে। যাচাই-বাছাই ছাড়া চাপিয়ে দিয়ে একীভূত করলেই ব্যাংকিং খাতের স্বাস্থ্যের উন্নতি হবে, এমন ভাবার কারণ নেই। বরং যে ব্যাংকগুলো খারাপ হয়েছে, সেখানে সমস্যা সমাধানে কার্যকরী উদ্যোগ গ্রহণ না করে একীভূত করলে ভালো ব্যাংকগুলো হুমকির মুখে পড়ার শঙ্কা থাকে। বাংলাদেশ ব্যাংক যে নীতিমালা করেছে, তাতে বলা হয়েছে, খারাপ ব্যাংকের পরিচালকরা ব্যাংক একীভূত হওয়ার পাঁচ বছর পর্যন্ত পরিচালনা পর্ষদের সদস্য হতে পারবেন না। এ ছাড়া কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ছাঁটাই করার আশঙ্কাসহ নানা অনিশ্চয়তা থাকায় এ প্রক্রিয়া কতটা ফলপ্রসূ হবে, তা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন আর্থিক খাতসংশ্লিষ্টরা।
কিছু আশা কিছু ধোঁয়াশা : দুর্বল যে ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান একীভূত হবে, সেটির পরিচালকেরা পাঁচ বছর পর আবার একীভূত হওয়া ব্যাংকের পর্ষদে ফিরতে পারবেন। যদিও এ ক্ষেত্রে তাদের কিছু শর্ত মানতে হবে। কিন্তু ব্যাংক খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, এ বিধানের মাধ্যমে সেসব পরিচালককে একধরনের দায়মুক্তি দেওয়া হয়েছে। যাদের কারণে ব্যাংক খারাপ হয়েছে, তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা না নিয়ে পাঁচ বছর বিরতির পর তাদের আবার পর্ষদে ফেরার বন্দোবস্ত রাখা হলো। নীতিমালায় বলা হয়েছে, একীভূত হওয়া ব্যাংকের কর্মীদের তিন বছর পর্যন্ত ছাঁটাই করা যাবে না। এমনকি একীভূত হওয়ার আগে কর্মকর্তা-কর্মচারীরা যে বেতন ও শর্তে কর্মরত ছিলেন, সেই একই বেতন ও শর্তে তাদের বহাল রাখতে হবে। ব্যাংকাররা বলছেন, এ বিধানের ফলে ব্যাংকের কর্মীদের মধ্যে একধরনের বৈষম্য তৈরি হতে পারে। এ বৈষম্যের কারণ ব্যাখ্যা করে তারা বলেন, সাধারণত ব্যাংকে প্রতিবছর কর্মীর কার্যমূল্যায়ন করা হয়। এরভিত্তিতে তাদের পদোন্নতি ও অন্যান্য বিষয় নির্ধারিত হয়ে থাকে। নীতিমালায় খারাপ ব্যাংকের কর্মীদের তিন বছরের জন্য চাকরি ও আর্থিক সুবিধার নিশ্চয়তা দেওয়া হয়েছে। অথচ ভালো ব্যাংকের কর্মীরা প্রতিবছর তাদের কাজেরভিত্তিতে মূল্যায়িত হবেন।
আশায় বাঁধা বুক : ব্যাংক একীভূত করার নীতিমালার কিছু বিধান নিয়ে খাতসংশ্লিষ্ট ও বিশেষজ্ঞদের মধ্যে উদ্বেগ থাকলেও সবাই বলছেন, ব্যাংক একীভূতকরণের বিষয়ে সুনির্দিষ্ট একটি নীতিমালার দরকার ছিল; সেটি অন্তত হয়েছে। এখন দরকার সব পক্ষের মতামতেরভিত্তিতে এটিকে আরও কার্যকর ও বাস্তবসম্মত করা। প্রয়োজনে এ বিষয়ে বিদেশি প্রতিষ্ঠানের সহায়তা নেওয়া। বিশ্বব্যাংক বলছে, ব্যাংক একীভূত করার ক্ষেত্রে আরও সতর্ক হওয়া প্রয়োজন। আন্তর্জাতিক রীতিনীতি মেনে এ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা দরকার। সম্পদের মান ও সুনির্দিষ্ট নীতিমালার ভিত্তিতে ব্যাংক একীভূত করা উচিত বলে মনে করে সংস্থাটি। এমনকি ব্যাংক খাতে সংস্কারে বাংলাদেশকে সহায়তা দিতে প্রস্তুত আছে বলেও জানিয়েছে বিশ্বব্যাংক। এখন পর্যন্ত যেসব ব্যাংককে একীভূত করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, সেগুলো কোনো নীতিতে পড়বে, সেটি নিয়ে একধরনের ধোঁয়াশা তৈরি করে এ নীতিমালা। আবার এক বছর সময় দিয়ে বাধ্যতামূলক একীভূত করার যে নীতিমালা করা হয়েছে, সেটিতে পুরো প্রক্রিয়া একটি দীর্ঘসূত্রতায় পড়বে। এ ছাড়া নীতিমালার আরও কিছু বিষয়ে উদ্বেগের কথাও জানিয়েছেন বিশ্লেষকেরা।
বিশ্লেষকদের দৃষ্টিভঙ্গি : বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ মোস্তফাকে মুজেরী সতর্ক করেছেন, ‘শুধু একীভূত করলেই ব্যাংকিং খাতের দুর্বলতা কাটবে না। জবাবদিহি এবং সুশাসন নিশ্চিত না হলে এ উদ্যোগও ব্যর্থ হবে।’ তিনি বলেন, ‘সুশাসন প্রতিষ্ঠা ও রাজনৈতিক হস্তক্ষেপমুক্ত পরিচালনাই এখন দরকার।’
লেখক : বিশ্লেষক, গবেষক, প্রাবন্ধিক ও গণমাধ্যমকর্মী