ঢাকা বুধবার, ১৩ আগস্ট ২০২৫, ২৯ শ্রাবণ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

সিন্ডিকেট বন্ধ করুন

মিনহাজুল আরিফীন
সিন্ডিকেট বন্ধ করুন

সিন্ডিকেট ইংরেজি শব্দ।

অর্থ- গুদামজাত করা, মজুদ করে রাখা। সিন্ডিকেটের আরবি প্রতিশব্দ হচ্ছে ‘আল-ইহতিকার’। প্রথম আরবি অভিধান রচয়িতা খলিল ইবনে আহমদ আল-ফারাহিদি (রহ.) বলেন, ‘খাদ্যদ্রব্য বা খাদ্যজাত অন্যান্য জিনিস মজুদ করাকে ইহতিকার বলে। এর অর্থ- জমা করা। সুতরাং যে ব্যক্তি মূল্যবৃদ্ধির অপেক্ষায় খাদ্যদ্রব্য জমা করে রাখে, তাকে মজুদদার বলে।’ (আল-আইন : ৩/৬২)।

সিন্ডিকেট বা মজুদদারির পারিভাষিক অর্থ প্রসঙ্গে হাফেজ ইবনে হাজার আসকালানি (রহ.) বলেন, ‘নিজের প্রয়োজন মুক্ত থাকা ও জনগণের প্রয়োজন সত্ত্বেও মূল্যবৃদ্ধির অপেক্ষায় খাদ্যদ্রব্য বিক্রি করা থেকে বিরত থাকাকে সিন্ডিকেট বা মজুদদারি বলে।’ (ফাতহুল বারি ফি শরহিল বুখারি : ৪/৪৪০)। ইমাম আওজায়ি (রহ.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি পণ্য বাজারজাত করার পথে প্রতিবন্ধক হয়, সে-ই মজুদদার। অর্থাৎ বাজারে বাজারে ঘুরে মানুষের প্রয়োজনীয় খাদ্যদ্রব্য মজুতকরণের উদ্দেশে ক্রয় করার কাজে যে নিজেকে নিয়োজিত করে, তাকে মজুদদার বলে।’ (নাইলুল আওতার : ৩/৬০৫)।

সমকালীন বাজারের হালচিত্র : ইদানিং দেশে সিন্ডিকেটের ফলে নিম্ন ও মধ্যবিত্ত পরিবারগুলোর নাভিশ্বাস উঠে যাওয়ার উপক্রম। সঙ্কোচ ভুলে তারা টিসিবির লাইনে সিরিয়াল দিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে কম মূল্যে পণ্য কিনছেন। এর পেছনের কারণ হচ্ছে, এ অভিশপ্ত সিন্ডিকেট। সরকার প্রতিটি পণ্যের অল্প মূল্য নির্ধারণ করে দেয়। এ নির্ধারণকৃত মূল্যের সুযোগ নিয়ে কুচক্রী মহল পণ্য রপ্তানি করা বন্ধ করে। পরবর্তী সময়ে যখন বাজারে পণ্যের সঙ্কট দেখা দেয়, তখন পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি করে তারা বাজারজাত করে। ফলে পণ্যের মূল্য আকাশচুম্বী হয়। যা ক্রয় করা সাধারণ জনগণের সাধ্যের বাইরে চলে যায়। এতে সবচেয়ে বেশি ভোগান্তির শিকার হচ্ছে, নিম্ন ও মধ্যবিত্ত জনগণ। তারা না পারে চড়া দামে কিনে নিতে, না পারে কিনে জমা করে রাখতে।

ইসলামে সিন্ডিকেট হারাম : অতি মুনাফার উদ্দেশে খাদ্যসামগ্রী মজুত করাকে ইসলাম হারাম করেছে। এটি ইসলাম কর্তৃক খাদ্যদ্রব্য সুষম বণ্টনের একটি উজ্জ্বল দিক। যেহেতু মজুদদারির ক্ষেত্রে গুটিকয়েক মজুদদারের হাতে নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যসামগ্রী গচ্ছিত থাকে এবং তাদের ইচ্ছামতো মূল্য হ্রাস-বৃদ্ধি করা হয়, তাই এ কাজটি সম্পূর্ণ অমানবিক ও নৈতিকতা বিবর্জিত। এজন্য ইসলামে সিন্ডিকেটকে সম্পূর্ণ নাজায়েজ ও হারাম বলেছে। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘শুধু পাপী ব্যক্তিই মজুদদারি বা সিন্ডিকেট করে থাকে।’ (মুসলিম : ১৬০৫)। ফিকহের কিতাবে রয়েছে, বেশি মূল্যে খাদ্য বিক্রির মানসে খাদ্যদ্রব্যের বাজারমূল্য কম থাকাবস্থায় ক্রয় করে গুদামজাত করা এবং অত্যধিক প্রয়োজনের সময় উচ্চমূল্যে তা বিক্রয় করা- সব ইসলামি আইনজ্ঞের কাছে তা হারাম। (আল-ফিকহুল মুয়াসসার : ৬/৪৫)। এ ধরনের কর্মকাণ্ডে জনসাধারণ ক্ষতির সম্মুখীন হয়। এমন হীন কর্মে যারা যুক্ত, তারাই অবৈধ মজুতদারি। এমন মজুতদারি নিষিদ্ধের মাধ্যমে ইসলাম সাধারণ জনগণকে সার্বিক ক্ষতি থেকে হেফাজত করেছে।

যেসব পণ্য মজুত করা হারাম : সমাজের বণিক, ধনী, দুস্থ, অসহায় সব শ্রেণির মানুষের খাদ্যসামগ্রীর অবাধ প্রাপ্যতা নিশ্চিত করতে ইসলাম খাদ্যের অবৈধ মজুদ নিষিদ্ধ করেছে। মানুষের দৈনন্দিনের প্রয়োজনীয় খাদ্যসামগ্রী, খাদ্যসংশ্লিষ্ট গুরুত্বগূর্ণ উপাদান, উপকরণ, খাদ্যশস্য ইত্যাদি চড়াদামে বিক্রির ইচ্ছায় মজুত করা হারাম। (আল-জামে লি উলুমি ইমাম আহমদ : ৯/১৫৯)। ইমাম আবু দাউদ (রহ.) বলেন, ‘আমি ইমাম আহমদ বিন হাম্বল (রহ.)-কে জিজ্ঞেস করলাম, ‘কোন জিনিস গুদামজাত করা নিষেধ?’ তিনি বললেন, ‘মানুষের দৈনন্দিন প্রয়োজনীয় জিনিস। অর্থাৎ যেসব ক্ষেত্রে মানুষের জীবন ও জীবিকা (খাদ্য) রয়েছে, সেসব ক্ষেত্রে কোনো প্রকার বাধা সৃষ্টি করা হারাম।’

যেসব ক্ষেত্রে মজুতদারি হারাম : সব মজুতদারি হারাম নয়। এজন্য জানতে হবে, সমাজে প্রচলিত কোন ধরনের মজুতদারি হারাম। কিছু হারাম মজুতদারির ধরন তুলে ধরা হলো- ১. স্বল্পমূল্য চলাকালে খাদ্যদ্রব্য ক্রয় করে বেশি লাভের আশায় এমনভাবে গুদামজাত করা, যার ফলে বাজারে তার প্রতিক্রিয়া পড়ে। ২. কোনো দ্রব্য এমন পরিমাণে গুদামজাত করা, যে কারণে ক্রেতা সাধারণত সে পণ্যের চরম সঙ্কটের সম্মুখীন হয়। ৩. মানুষের খাদ্যদ্রব্য সঙ্কট অবস্থায় যেকোনো পরিমাণ খাদ্যদ্রব্য গুদামজাত করা। ৪. বাজারে কৃত্রিম খাদ্য সঙ্কট সৃষ্টির জন্য গুদামজাত করা। এসব অবস্থায় মাল গুদামজাত করা নিষিদ্ধ ও গোনাহের কাজ। ৫. এ ধরনের সিন্ডিকেট যে শুধু ব্যবসার ক্ষেত্রে হয়, তা কিন্তু নয়; বরং অন্যান্য ক্ষেত্রেও হয়ে থাকে। যেমন- গাড়ি, লঞ্চ বা ট্রেনের টিকেটের ক্ষেত্রে দেখা যায়। টিকেট থাকা সত্ত্বেও টিকেট নেই। এ রকম অজুহাত দেখিয়ে গাড়ির মালিকরা যাত্রীদের কাছ থেকে বাড়তি টাকা নেওয়ার জন্যও টিকেট সিন্ডিকেট করে। বর্তমানে এটা একধরনের মহামারি আকার ধারণ করেছে। আসলে এসব সিন্ডিকেটের দ্বারা মূলত লাভবান হয় পাইকারি, মধ্যস্থতাকারী, খুচরা ব্যবসায়ী ও মালিকপক্ষ। আর আর্থিক ও মানসিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় সাধারণ জনগণ। ইসলাম এ ধরনের বৈষম্য ও জুলুম চিরতরে হারাম ঘোষণা করেছে। কেননা, এতে সাধারণ গরিব-দুঃখী ও অসহায় মানুষ কষ্টে ভোগে। আল্লাহর কাছে তাদের ফরিয়াদ বয়ে আনতে পারে সমাজ ও রাষ্ট্রের দুর্ভিক্ষসহ নানা কঠিন আজাব। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘যেসব লোক বিনা দোষে মোমিন পুরুষ ও নারীকে কষ্ট দেয়, তারা অতি বড় একটা মিথ্যা অপবাদ ও সুস্পষ্ট গোনাহের বোঝা নিজেদের মাথায় তুলে নেয়।’ (সুরা আহজাব : ৫৮)।

মজুদদারদের ভয়াবহ শাস্তি : দুনিয়ার কেউই আল্লাহর বিরাগভাজন হতে চায় না। চায় না অভিশপ্ত হতে। কারণ, যার প্রতি আল্লাহর অভিশম্পাত, তার ধ্বংস অনস্বীকার্য। তারপরও মানুষ এমন কাজে নিজেকে জড়িয়ে ফেলে, ধ্বংসই যার সুনিশ্চিত পরিণাম। অবৈধ খাদ্যসামগ্রী মজুত করা তেমনি একটি কাজ, যা মানুষকে লানতপ্রাপ্ত বানায়। মজুতদারের প্রতি রাসুলুল্লাহ (সা.) অভিসম্পাত করেছেন। আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) বর্ণনা করেছেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘আমদানিকারক রিজিকপ্রাপ্ত আর মজুতদাররা লানতপ্রাপ্ত, অভিশপ্ত।’ (মুসনাদে দারেমি : ২৫৮৬)। রাসুলুল্লাহ (সা.) আরও বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি মুসলমানদের খাদ্যদ্রব্য মজুদ করে, আল্লাহ তাকে কুষ্ঠরোগে আক্রান্ত করবেন অথবা দেউলিয়া বানাবেন।’ (আল-মুন্তাখাবুল আদাবি : ১৭)। যারা মজুতদার, তারা রাসুলুল্লাহ (সা.) কর্তৃক চিহ্নিত পাপিষ্ঠ। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘পাপিষ্ঠ ছাড়া কেউ মজুদদার হতে পারে না।’ (মুসলিম : ১২২৮)।

লেখক : শিক্ষার্থী, আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয়, কায়রো, মিশর

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত