প্রিন্ট সংস্করণ
০০:০০, ২৮ ডিসেম্বর, ২০২৫
আরবি ‘আমানত’ শব্দের অর্থ গচ্ছিত রাখা, নিরাপদ রাখা, প্রশান্ত হওয়া। আমানতের বিপরীত অর্থ খেয়ানত করা। পরিভাষায়- কারও কাছে কোনো অর্থ-সম্পদ, বস্তুসামগ্রী গচ্ছিত রাখাকে আমানত বলা হয়। যিনি গচ্ছিত বস্তুকে বিশ্বস্ততার সঙ্গে সংরক্ষণ করেন, যথাযথভাবে হেফাজত করেন এবং মালিক চাওয়া মাত্রই কোনো টালবাহানা ছাড়া ফেরত দেন, তাকে আল-আমিন তথা বিশ্বস্ত সত্যবাদী বা আমানতদার বলা হয়। (আল-মুজামুল ওয়াসিত : ২৭-২৮)। আমানতের প্রচলন জীবনের সর্বক্ষেত্রেই দেখা যায়। ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, বাণিজ্যিক, প্রাতিষ্ঠানিক প্রতিটি স্তরে প্রতিটি বিষয়ে আমানত রক্ষা করা ইসলামের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। লেনদেনের আমানত, কথার আমানত- যেসব বিষয় প্রকাশিত হলে বা যেসব কথা বললে পারস্পরিক সম্পর্ক অবনতি ঘটবে, মনোমালিন্য ও সংঘাত সৃষ্টি হবে, এমন বিষয় প্রকাশ না করা এবং না বলাও আমানত। সর্বক্ষেত্রে আমানত রক্ষা করা একজন মোমিনের দায়িত্ব ও কর্তব্য।
আমানত রক্ষায় রাসুল (সা.) : পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি আমানত ও অঙ্গীকারের প্রতি যত্নবান ছিলেন আমাদের প্রিয় রাসুল মুহাম্মদ (সা.)। তার পবিত্র জীবনে এমন কোনো ঘটনা নেই, যেখানে তিনি আমানতের খেয়ানত বা অঙ্গীকার ভঙ্গ করেছেন। তিনি ছিলেন আমানত রক্ষাকারীদের সরদার। তার কাছে আরবের মুসলমান নয় শুধু, অন্যান্য ধর্মাবলম্বীর লোকেরাও তাদের মূল্যবান ধনসম্পদ আমানত রাখত। তার অনুসরণেই আমরা আল্লাহর ভালোবাসা পেতে পারি। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘(হে নবী! আপনি বলে দিন) তোমরা যদি আল্লাহকে ভালোবাস, তাহলে আমাকে অনুসরণ কর। আর আমাকে অনুসরণ করলে আল্লাহও তোমাদের ভালোবাসবেন এবং তিনি তোমাদের পাপ মোচন করবেন। আল্লাহতায়ালা অতি ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।’ (সুরা আলে ইমরান : ৩১)। আল্লাহর এ ওয়াদা কেবল রাসুল (সা.)-এর যুগের সঙ্গেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং চিরস্থায়ী। আল্লাহতায়ালার নৈকট্য লাভ করতে হলে তাই মহানবী (সা.)-এর অনুসরণ, অনুকরণ ছাড়া দ্বিতীয় কোনো মাধ্যম নেই।
আমানতদারিতা মোমিনের অন্যতম গুণ : ইসলামে আমানত রক্ষার বিষয়ে অত্যন্ত গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘প্রকৃত মোমিন তারাই, যারা নিজেদের আমানত ও অঙ্গীকারের প্রতি যত্নবান।’ (সুরা মোমিনুন : ৮)। অন্য আয়াতে এসেছে- ‘নিশ্চয় আল্লাহ আমানতসমূহ তার হকদারদের কাছে পৌঁছে দিতে তোমাদের আদেশ দিচ্ছেন।’ (সুরা নিসা : ৫৮)। রাসুল (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি তোমার কাছে আমানত রেখেছে, তার আমানত তাকে ফেরত দাও। আর যে ব্যক্তি তোমার আমানতের খেয়ানত করেছে, তুমি তার আমানত আত্মসাৎ বা খেয়ানত করো না।’ (সুনানে আবি দাউদ : ৩৫৩৫)।
আমানত রক্ষাকারীর বিশেষ মর্যাদা : আমানতের হেফাজত করা মোমিনের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। পরকালে সাফল্য লাভ করতে হলে আল্লাহর দেওয়া আমানতের হেফাজত করা চাই। যেমন- যৌবনের হেফাজত, চোখের হেফাজত, কানের হেফাজত, জবানের হেফাজত, হাত-পায়ের হেফাজত ইত্যাদি।
আল্লাহতায়ালা যে সম্পদ দিয়েছেন, দীনের পথে মানুষের কল্যাণে ব্যয় না করে অশ্লীল পথে ব্যয় করা আমানতের খেয়ানত। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘যারা তাদের আমানত ও প্রতিশ্রুতির হেফাজত করে, যারা নামাজের ব্যাপারে যত্নবান হয়, তারাই জান্নাতের অধিকারী। তারা সেখানে অনন্তকাল থাকবে।’ (সুরা মোমিনুন : ৮-১১)। এসব আমানত হেফাজতকারী ব্যক্তি হাশরের ময়দানে বিশেষ মর্যাদায় ভূষিত হবেন। হাশরের ময়দানে উপস্থিত অন্যান্য লোক দুনিয়ায় আমানত হেফাজতকারী ব্যক্তিদের দিকে তাকাতে থাকবে। একে অপরের কাছে আমানত রক্ষাকারীদের নিয়ে বলাবলি করতে থাকবে, ‘তারা কারা? তারা তো আমাদের সঙ্গেই ছিল। আজ তারা আমাদের চেয়ে ভিন্ন স্থানে ও ভিন্ন মর্যাদার অধিকারী!’ রাসুল (সা.) বলেন, ‘একজন সত্যবাদী ও আমানতদার ব্যবসায়ী পরকালে নবী-সিদ্দিক এবং শহিদদের সঙ্গে থাকবে।’ (সুনানে তিরমিজি : ১২০৯)।
যার আমানত নেই, তার ঈমান নেই : মোমিন কখনও আমানতের খেয়ানত বা আত্মসাৎ করতে পারে না। কেননা, আমানতদারিতা ঈমানের বড় অংশ। আনাস (রা.) সূত্রে বর্ণিত; তিনি বলেন, রাসুল (সা.) আমাদের এরূপ উপদেশ খুব কমই দিয়েছেন, যাতে এ কথা বলেননি, ‘যার আমানত নেই, তার ঈমান নেই এবং যার অঙ্গীকারের মূল্য নেই, তার দীন নেই।’ (মুসনাদে আহমদ : ১২৫৬৭; মিশকাতুল মাসাবিহ : ৩৫)।
আমানতের খেয়ানতকারী মোনাফেক : আমানতের খেয়ানত করা মোনাফেকের আলামত। রাসুল (সা.) বলেন, ‘চারটি স্বভাব যার মধ্যে থাকবে, সে পূর্ণাঙ্গ মোনাফেক এবং যার মধ্যে তার একটি থাকবে, সে তা পরিহার না করা পর্যন্ত তার মধ্যে মোনাফেকের একটি স্বভাব থাকবে। স্বভাব চারটি হলো- ১. যখন তার কাছে কিছু আমানত রাখা হয়, সে তাতে খেয়ানত করে; ২. যখন সে কথা বলে, মিথ্যা বলে; ৩. যখন ওয়াদা করে, তা ভঙ্গ করে এবং ৪. যখন কারো সঙ্গে ঝগড়া করে, তখন অশ্লীল ভাষা ব্যবহার করে।’ (সহিহ বোখারি : ৩৪; সহিহ মুসলিম : ১০৬)। আল্লাহ ও তাঁর রাসুল (সা.) মোনাফেকদের অপছন্দ করেন। কারণ, আমানত খেয়ানত করার মাধ্যমে ঈমান চলে যায়। এজন্য কোরআন-হাদিসে আমানতের খেয়ানত না করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘নিশ্চয় আমি আসমানসমূহ, জমিন ও পর্বতমালার প্রতি এ আমানত পেশ করেছি। এরপর তারা তা বহন করতে অস্বীকার করেছে এবং এতে ভীত হয়েছে। আর মানুষ তা বহন করেছে। নিশ্চয় তারা ছিল বড় দুর্বল, অতি অজ্ঞ।’ (সুরা আহজাব : ৭২)।
আমানতের খেয়ানতকারীর শাস্তি : আমানতের আত্মসাৎকারী মোনাফেক। মোনাফেকদের ব্যাপারে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘নিঃসন্দেহে মোনাফেকরা জাহান্নামের সর্বনিম্ন স্তরে থাকবে।’ (সুরা নিসা : ১৪৫)। তাই আমানতের খেয়ানত বা আত্মসাৎ করা মারাত্মক গোনাহ ও জঘন্য অপরাধ; যা আল্লাহতায়ালা ক্ষমা না করলে আদৌ মাফ হবে না। খেয়ানতকারীকে অবশ্যই জাহান্নামে যেতে হবে।
আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের সঙ্গে খেয়ানত করো না এবং জেনেশুনে পারস্পরিক আমানতের খেয়ানত করো না।’ (সুরা আনফাল : ২৭)। জায়েদ ইবনে খালিদ জুহানি (রা.) সূত্রে বর্ণিত; তিনি বলেন, খায়বার যুদ্ধে জনৈক ব্যক্তি কোনো দ্রব্য আত্মসাৎ করল। পরে সে মারা গেল। রাসুল (সা.) তার জানাজা পড়াননি। তিনি সাহাবিদের উদ্দেশে বললেন, ‘তোমাদের এ সঙ্গী আল্লাহর পথের সম্পদ আত্মসাৎ করেছে।’ বর্ণনাকারী বলেন, ‘আমরা তার জিনিসপত্র তল্লাশি করে তাতে একটি রেশমি কাপড় পেলাম, যার মূল্য ছিল দুই রৌপ্যমুদ্রা।’ (সুনানে তিরমিজি : ২৪২)।
লেখক : শিক্ষক, গবেষক ও প্রাবন্ধিক