প্রিন্ট সংস্করণ
০০:০০, ২৮ ডিসেম্বর, ২০২৫
সামাজিক জীব হিসেবে মানবতার অনিবার্য দাবি হলো, দুঃসময়ে একে অন্যকে বিনা স্বার্থে আর্থিক সহযোগিতা ও ঋণ প্রদান করা। এতে যেমন মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি, মানুষের হৃদয় নিংড়ানো দোয়া ও অবারিত নেকি লাভ করা যায়, তেমনি এর দ্বারা সমাজ হয় দয়া, ভালোবাসা ও হৃদ্যতায় সিক্ত; পরস্পরের কল্যাণকামিতায় সুশোভিত। এ কর্জ প্রথা মুসলিম উম্মাহর হারানো ঐতিহ্য। ঋণদান কোনো ব্যবসা নয়, পুণ্যময় মানবিক সহযোগিতা। ইসলামে ঋণের উদ্দেশ আর্থিক প্রবৃদ্ধি নয়, আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভে মানুষকে সাহায্য-সহযোগিতা করা এবং বিপদগ্রস্তের প্রতি দয়া ও সহানুভূতি প্রদর্শন করাই এর অভিষ্ঠ লক্ষ্য। কিন্তু এ সহযোগিতার আড়ালে ব্যবসায়িক বা অন্য কোনো সুবিধা অর্জনের হীন স্বার্থ-চরিতার্থ করার সুযোগ নেই। তাই ঋণগ্রহীতা ঋণ ফেরত দেওয়ার সময় যা নিয়েছে, তা কিংবা তার অনুরূপ ফেরত দিতে আদিষ্ট; এর অতিরিক্ত নয়। ঋণদাতা তার প্রদত্ত অর্থ থেকে সামান্য বেশি নিলেও তা সুদ হিসেবে গণ্য হবে। তবে পূর্বশর্ত ছাড়া ঋণগ্রহীতা যদি পাওনা আদায়ের সময় ঋণদাতাকে অপ্রত্যাশিতভাবে খুশি মনে কিছু বাড়িয়ে দেয়, তাহলে তা বৈধ। জারির ইবনে আবদুল্লাহ (রা.) সূত্রে বর্ণিত; তিনি বলেন, আমি রাসুল (সা.)-এর কাছে এলাম। তখন তিনি মসজিদে ছিলেন। তিনি বললেন, ‘দুই রাকাত সালাত আদায় কর।’ তার কাছে আমার কিছু ঋণ প্রাপ্য ছিল। তিনি আমার ঋণ আদায় করলেন। পাওনার চেয়েও বেশি দিলেন। (বোখারি : ২৩৯৪)।
ঋণ দিয়ে সুবিধা ভোগ করা যাবে না : কাউকে ধার দিয়ে বিনিময়ে কোনো প্রকার সুবিধা ভোগ করা, উপঢৌকন গ্রহণ করা কিংবা সুদণ্ডঘুষ নেওয়া সম্পূর্ণ হারাম। আবু বুরদাহ (রহ.) বলেন, একবার আমি মদিনায় এসে আবদুল্লাহ বিন সালাম (রা.)-এর সঙ্গে সাক্ষাৎ করলাম। তিনি আমাকে বললেন, ‘তুমি কি আমাদের এখানে আসবে না? তোমাকে আমি খেজুর ও ছাতু খেতে দেব। একটি ঘরে থাকতে দেব। তুমি এমন স্থানে (ইরাকে) বসবাস করছ, যেখানে সুদের প্রচলন খুব ব্যাপক। অতএব, কারও কাছে যদি তোমার কোনো পাওনা থাকে, আর সে যদি তোমাকে হাদিয়া বা উপহার হিসেবে এক বোঝা খড় বা এক বোঝা যব কিংবা এক আঁটি ঘাসও দেয়, তুমি তা গ্রহণ করবে না। কেননা, তা সুদের অন্তর্ভুক্ত।’ (বোখারি : ৩৮১৪)। তবে উভয়ের মধ্যে যদি আগে থেকেই হাদিয়া আদান-প্রদানের প্রচলন থাকে, তাহলে সেই উপহার প্রদান বা গ্রহণ করতে অসুবিধা নেই। রাসুল (সা.) বলেন, ‘তোমাদের কেউ যদি কোনো ব্যক্তিকে ঋণ দেয়, অতঃপর ঋণগ্রহীতা যদি দাতাকে কোনো হাদিয়া বা উপহার দেয়, তবে তা গ্রহণ করবে না অথবা যদি ঋণগ্রহীতা তার যানবাহনের ওপর ঋণদাতাকে বসাতে চায়, তবে এর ওপর বসবে না। অবশ্য যদি ঋণ নেওয়ার আগে থেকে তাদের মধ্যে ওইরূপ ব্যবহার প্রচলিত থাকে, তবে তা ভিন্ন কথা।’ (সুনানে ইবনে মাজাহ : ২৪৩২)।
ঋণ দিয়ে সুদ গ্রহণ করা জঘন্য অপরাধ : বর্তমানে অধিকাংশ ধনকুবেররা সুদ ছাড়া ঋণ দিতে চায় না। অথচ সুদ কতোটা ঘৃণ্য কদাকার কুৎসিত ও জঘন্য অপরাধ, তা বহু হাদিস থেকে অনুমেয়। রাসুল (সা.) বলেন, ‘সুদের মাত্র একটি রৌপ্যমুদ্রাও যে ব্যক্তি জেনে-শুনে খায়, তার গোনাহ ৩৬ বার ব্যভিচার করার চেয়েও বেশি হয়।’ (মুসনাদে আহমদ : ২২০০৭)। তিনি আরও বলেন, ‘সুদের গোনাহের ৭০টি স্তর রয়েছে। এর সবচেয়ে নিম্নস্তর হলো, আপন মাকে বিয়ে করা।’ (সুনানে ইবনে মাজাহ : ২২৭৪)। আবু হুরায়রা (রা.) সূত্রে বর্ণিত; রাসুল (সা.) আরও বলেন, মেরাজের রাতে আমি এমন এক শ্রেণির লোকের কাছে পৌঁছুলাম, যাদের পেট ঘরের মতো বিশাল। এর ভেতরে বহু সাপ রয়েছে, যা তাদের পেটের বাইরে থেকে দেখা যায়। আমি (আমার সঙ্গীকে) জিজ্ঞেস করলাম, ‘হে জিবরাইল! ওরা কারা?’ তিনি বললেন, ‘ওরা সুদখোর।’ (সুনানে ইবনে মাজাহ : ২২৭৩)।
ঋণ দিয়ে বন্ধকী জমি বা বাড়ি ভোগ করা হারাম : আমাদের দেশে ঋণ দিয়ে সুদ গ্রহণের একটি প্রচলিত প্রক্রিয়া হলো, জমি বন্ধক প্রথা। এটি মূলত ঋণ প্রদান করে বিনিময়ে সুদ গ্রহণেরই একটি প্রকার। এতে জমি ভোগ করার শর্তেই ঋণ দেওয়া হয় এবং ঋণের সুবিধা পাওয়ার কারণেই জমির মালিক ঋণ প্রদান করে থাকে; যা সম্পূর্ণ নাজায়েজ। উল্লিখিত কারবার বৈধভাবে করতে চাইলে শুরু থেকেই বন্ধকী চুক্তি না করে ভাড়া বা লিজ চুক্তি করবে। এ ক্ষেত্রে জমিটি আর উল্লিখিত ঋণের বন্ধক হিসেবে বহাল থাকবে না, বরং তা ভাড়া চুক্তির অধীন বলে বিবেচ্য হবে। যার বিবরণ হলো, জমির মালিক জমি ভাড়া দেবে। তার যত টাকা প্রয়োজন, সেজন্য যত বছর ভাড়া দিতে হয়, একত্রে তত বছরের জন্য ভাড়া দেবে। যেমন- এক বিঘা জমির বার্ষিক ভাড়া ৫ হাজার টাকা।
মালিকের ২০ হাজার টাকা প্রয়োজন। তাহলে সে ৪ বছরের জন্য জমি ভাড়া দেবে। আর অগ্রিম ২০ হাজার টাকা নিয়ে নেবে। এ ক্ষেত্রে জমির ভাড়া স্থানীয় ভাড়া থেকে সামান্য কমবেশিও হতে পারে। এরপর ভাড়ার মেয়াদ শেষ হলে অর্থদাতা জমি ফেরত দেবে, কিন্তু প্রদেয় টাকা ফেরত পাবে না। অবশ্য সময়ের আগে ফেরত দিলে যে কয়দিন ভাড়ায় ছিল, সে পরিমাণ ভাড়া কর্তন করে অবশিষ্ট টাকা ভাড়াটিয়া ফেরত পাবে।
তবে এ ক্ষেত্রে ভাড়া যৌক্তিক ও প্রচলিত বাজারদরের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হতে হবে। এত কম ভাড়া নির্ধারণ করা যাবে না, যার কারণে এমন সন্দেহ হয় যে, ঋণের কারণে ভাড়া অস্বাভাবিক কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। এমনটি হলেও তা ঋণ দিয়ে সুবিধা ভোগ করা বলে বিবেচ্য হবে; যা সুদগ্রহণের অন্তর্ভুক্ত। তা ছাড়া ঋণ আদান-প্রদানের সঙ্গে জমি ভাড়া দেওয়ার শর্তও করা যাবে না।
এমনিভাবে ঋণ দিয়ে নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত বাসা বা ফ্ল্যাটে বিনা ভাড়ায় থাকার সুবিধা ভোগ করাও হারাম। বর্তমানে জুয়েলারি দোকানে স¦র্ণ বন্ধক রেখে লাভের ওপর লোন প্রদান করার প্রচলিত পদ্ধতিও সুদের অন্তর্ভুক্ত। (রদ্দুল মুহতার : ৬/৪৮২, বাদায়েউস সানায়ে : ৫/২১২)।