সত্যিকারের ভালোবাসায় কোমল হৃদয় সিক্ত হয়। এমন ভালোবাসা মানবিক আবেগের অন্যতম। এ এক শুদ্ধ ও পবিত্র অনুভূতি। বহু সাহিত্যিক ও সুবক্তা এ ভালোবাসা নিয়ে অসাধারণ কথামালা ও অনিন্দ্য শব্দশৈলী প্রকাশ করেছেন; যা আবেগকে জাগিয়ে তোলে এবং অনুভূতিকে আলোড়িত করে। অবশ্য ভালোবাসার একটি ধরন রয়েছে, যা সমস্ত পর্যায়ের শীর্ষে অবস্থান করে সকল সীমা ছাড়িয়ে যায়। এটি এমন এক ভালোবাসা, যা ভৌত ও পার্থিববিষয় থেকে মুক্ত এবং নিম্নমানের ইচ্ছা ও কামনা-বাসনার ঊর্ধ্বে। এ ভালোবাসা প্রবাহিত হয় মানুষের হৃদয় থেকে সেই মহান সৃষ্টিকর্তার প্রতি, যিনি হৃদয় সৃষ্টি করেছেন। এটাই আল্লাহর প্রতি ভালোবাসা, যিনি পবিত্র ও মহিমাময়। এ ভালোবাসা জীবনের তপ্ত রোদে শীতল বাতাসের মতো শান্তি আনে এবং জীবনের পথে অন্তরের জন্য প্রশান্তিময় ছায়া হয়।
ভালোবাসা হলো ইবাদতের দুটি মূলভিত্তির একটি, যা দুটি স্তম্ভের ওপর দাঁড়িয়ে দুই ডানার সাহায্যে ওড়ে। এ দুটি ভিত্তি হলো পূর্ণ ভালোবাসা, বিনয় ও আত্মসমর্পণ। ইবাদত হলো উভয়ের সমন্বয়। এ কারণে ইবাদত একমাত্র আল্লাহর জন্য। আল্লাহর প্রতি ভালোবাসা হলো ইবাদতের প্রাণ; এর আসল সত্য ও গোপন রহস্য। কেবল আল্লাহতায়ালা এ পূর্ণ অনুভূতি ও তার সর্বোচ্চ প্রকাশের যোগ্য। কেবল তিনি নিজের জন্য ও প্রতিটি দিক বিবেচনায় ভালোবাসার যোগ্য। এ কারণে আল্লাহ ছাড়া অন্য কেউ ইবাদতের বা পূর্ণ ভালোবাসার যোগ্য নয়। কবি বলেন, ‘তোমার ছাড়া অন্য কারো জন্য জেগে থাকা চোখ বৃথা। তোমার অভাব ছাড়া অন্য কোনো কারণে কাঁদা অর্থহীন।’
প্রকৃতপক্ষে সকল নেয়ামতের দাতা আল্লাহতায়ালা। তিনিই নেয়ামতের দরজাগুলো উন্মুক্ত করেন এবং সেগুলো অর্জনের পথ সহজ করে দেন। মহান আল্লাহ বলেন, ‘তোমাদের কাছে যে সমস্ত নেয়ামত রয়েছে, তা আল্লাহর কাছ থেকেই এসেছে।’ (সুরা নাহল : ৫৩)। মহৎপ্রাণ ব্যক্তিরা অনুগ্রহকারীদের প্রতি ভালোবাসা অনুভব করেন। অতএব, যিনি সকল নেয়ামত ও কল্যাণের উৎস, তার প্রতি ভালোবাসা কত গভীর হওয়া উচিত? আল্লাহতায়ালা আরো বলেন, ‘উত্তম কাজের জন্য উত্তম পুরস্কার ছাড়া কী হতে পারে? সুতরাং তোমরা উভয়ে তোমাদের প্রতিপালকের কোন অনুগ্রহ অস্বীকার করবে?’ (সুরা আর রহমান : ৬০-৬১)।
এ মহান উপলব্ধির কারণে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘সর্বোত্তম ইস্তিগফার হলো, বান্দা যখন এভাবে বলে, হে আল্লাহ! তুমি আমার রব, তুমি ছাড়া কোনো মাবুদ নেই। তুমি আমাকে সৃষ্টি করেছ, আমি তোমার দাস। আমি তোমার অঙ্গীকারে ও প্রতিশ্রুতিতে যতটুকু পারি, অটল আছি। আমি আমার কৃতকর্মের শর্ত থেকে তোমার কাছে আশ্রয় চাই। আমি স্বীকার করছি, তুমি আমাকে যে নেয়ামত দিয়েছ, তা একান্তই তোমার পক্ষ থেকে। আমি আমার পাপের কথাও স্বীকার করছি। অতএব, তুমি আমাকে ক্ষমা করে দাও। কারণ, একমাত্র তুমি ছাড়া কেউ গোনাহ মাফ করতে পারে না।’ এখানে বান্দা তার ইস্তিগফারে দুটি বিষয় একত্রিত করে- ১. আল্লাহর দেয়া নেয়ামতের প্রতি কৃতজ্ঞতা, ২. নিজের পাপ ও কর্মের ঘাটতি স্বীকার করা। আল্লাহর অসংখ্য নেয়ামতের কথা স্মরণ করলে বান্দার মনে তার প্রতি পূর্ণ ভালোবাসা জন্মে। আর নিজের ঘাটতি ও পাপ দেখলে তার মধ্যে ন¤্রতা, আত্মসমর্পণ ও তওবার তাড়না সৃষ্টি হয়। বান্দা অনুভব করে, আল্লাহর অগণিত নেয়ামতের সামনে তার কৃতজ্ঞতা ও কর্ম সব সময় অপূর্ণ থেকে যায়। যে কোনো ইবাদত বা কর্মপ্রচেষ্টা কেবল আল্লাহর দেয়া তৌফিকের কারণে সম্ভব হয়। কবি বলেন, ‘আমি আল্লাহর প্রশংসার মুক্তামালা নিবেদন করি, যা আসলে তাঁর দেয়া নেয়ামতের এক অংশ। যেমন মেঘ সমুদ্রকে বৃষ্টি দান করে, কিন্তু সে বৃষ্টি তো প্রকারান্তরে সমুদ্রের পানি।’
রাসুলুল্লাহ (সা.) যেহেতু আল্লাহ সম্পর্কে সর্বাধিক জ্ঞানী এবং তাঁর প্রতি সবচেয়ে বেশি ইবাদতশীল ছিলেন। তাই তিনি সব সময় অধিক পরিমাণে ইস্তিগফার ও তওবা করতেন। আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, আমি রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে বলতে শুনেছি, ‘আল্লাহর কসম! আমি প্রতিদিন ৭০ বারের বেশি আল্লাহর কাছে তওবা ও ইস্তিগফার করি।’ (বোখারি : ৬৩০৭)। যদিও আল্লাহ তার পূর্ববর্তী ও পরবর্তী সমস্ত ভুল ক্ষমা করে দিয়েছেন, তবু এটি ছিল রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর প্রতি তাঁর সত্যিকারের ভালোবাসা ও পূর্ণ ইবাদতের প্রকাশ।
যখন একজন মোমিন আল্লাহর মহিমান্বিত গুণাবলি ও তাঁর অসীম অনুগ্রহ নিয়ে চিন্তা করেন, তখন তার হৃদয়ে আল্লাহর প্রতি ভালোবাসা বেড়ে যায়। এমনকি আল্লাহ ও তাঁর রাসুল (সা.) তার কাছে অন্য সবকিছুর চেয়ে প্রিয় হয়ে ওঠে। এ সময় সে ঈমানের মধুরতা অনুভব করতে থাকে। আল্লাহর বন্দেগির আনন্দে সিক্ত হয়। আনাস ইবনে মালেক (রা.) বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘তিনটি গুণ যার আছে, সে ঈমানের স্বাদ আস্বাদন করতে পারে। ১. আল্লাহ ও তাঁর রাসুল তার কাছে অন্য সবকিছু থেকে অধিক প্রিয়, ২. কাউকে একমাত্র আল্লাহর জন্য ভালোবাসা, ৩. কুফরিতে প্রত্যাবর্তনকে আগুনে নিক্ষিপ্ত হওয়ার মতো অপছন্দ করা।’ (বোখারি : ১৬)। আল্লাহর প্রতি ভালোবাসার পথিকৃৎ হওয়া মানে পৃথিবীতে সুখ-শান্তি লাভ করা, আনন্দের উৎস থেকে সুধা পান করা ও বন্ধুত্বের পরিপূর্ণতা অর্জন করা। কবি বলেন, ‘যদি আমার হৃদয় আল্লাহর ভালোবাসায় পূর্ণ হতো, তাহলে পৃথিবীর সকল হৃদয় তাকে ভালোবাসত।’
আসল ভালোবাসা কখনোই শব্দ দ্বারা প্রকাশ করা যায় না কিংবা তার সীমা নির্ধারণ করা সম্ভব হয় না। আসল ভালোবাসা কেবল অনুভূতি, যা তার প্রভাব ও ফলাফলে প্রকাশিত হয়। ভালোবাসার বাস্তবতা, মর্ম ও প্রভাব হলো, তা কখনোই চিনে বা বুঝে শেষ করা যায় না। অবশ্য তা এতটাই সুস্পষ্ট, এর প্রকাশ কোথাও গোপন নয়। ভালোবাসার মূলতত্ত্ব হলো প্রিয়জনের প্রতি পূর্ণাঙ্গ আনুগত্য। কবি বলেন, ‘ভালোবাসা মানে কেবল আনুগত্য ও বিসর্জন। তার অর্থ ও মর্ম যতই বর্ণনা করা হোক, ততই তা আরো বেশি বোঝা যায়। আমি আমার আত্মাকে তার প্রেমে সস্তায় উৎসর্গ করেছি। আর যে প্রেমে পড়ে, সে কখনোই প্রেমের চেয়ে দামি অন্য কিছুকে প্রাধান্য দেয় না।’
আল্লাহর প্রতি সত্যিকারের ভালোবাসা তার আনুগত্যের ফল। আর আনুগত্যও কেবল রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর অনুসরণে হতে পারে। যারা আল্লাহকে ভালোবাসে এবং মহানবী (সা.)-এর পথ অনুসরণ করে, আল্লাহ তাদের দুটি সুসংবাদ দেন- ১. তিনি তাদের ভালোবাসবেন, ২. তাদের পাপ মোচন করবেন। মহান আল্লাহ বলেন, ‘বল, তোমরা যদি আল্লাহকে ভালোবাস, তবে আমাকে অনুসরণ কর, আল্লাহ তোমাদের ভালোবাসবেন। আর তোমাদের অপরাধ ক্ষমা করবেন। আল্লাহ অত্যন্ত ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।’ (সুরা আলে ইমরান : ৩১)।
মসজিদে নববিতে প্রদত্ত জুমার খুতবার সংক্ষেপিত অনুবাদ করেছেন- আবদুল কাইয়ুম শেখ