ঢাকা ২৩ জানুয়ারি ২০২৫, ৯ মাঘ ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

রজব থেকে রমজানের প্রস্তুতি

ইলিয়াস মশহুদ
রজব থেকে রমজানের প্রস্তুতি

বারো মাসের মধ্যে সবচেয়ে বরকতময় মাস রমজান। রোজার কারণে রমজান এক অনন্য মর্যাদার অধিকারী মাস। রমজান মাসে মোমিন বান্দারা বেশি বেশি ইবাদত করেন। রমজানের ইবাদতের প্রস্তুতি হিসেবে রজব ও শাবান মাসে তারা ইবাদত করে থাকেন। কারণ, রাসুল (সা.) রমজান আসার দু’মাস আগে থেকেই রমজানের প্রস্তুতি নিতেন। আমরা জানি, আরবি বর্ষপঞ্জিকার মধ্যে রজব বিশেষ মাস। মাসটির পুরো নাম ‘রজবুল মুরাজ্জাব’ বা ‘আর-রজব আল-মুরাজ্জাব’ হলেও এটি রজব মাস নামে পরিচিত। মাসটির অর্থগত তাৎপর্য রয়েছে। ‘রজব’ শব্দের অর্থ সম্ভ্রান্ত, মহান বা প্রাচুর্যময়। আর ‘মুরাজ্জাব’ অর্থ ‘সম্মানিত’। সুতরাং এর অর্থ দাঁড়ায় ‘প্রাচুর্যময় সম্মানিত মাস’।

রজব ও শাবান মাসের ফজিলত : ইসলামপূর্ব জাহেলি যুগের লোকেরা এ মাসকে অন্য মাসের তুলনায় বেশি সম্মান করত। এজন্য তারা এ মাসের নাম রেখেছিল রজব। এ মাস নাম ও অর্থগতভাবে প্রাচুর্যময় সম্মানিত মাস। এর মর্যাদা সম্পর্কে রাসুল (সা.) বলেন, ‘যে রজব মাসে (ইবাদত দ্বারা অন্তরের) জমিন চাষাবাদ করল না, আর শাবান মাসে (ইবাদতের মাধ্যমে মনের) জমিন আগাছামুক্ত করল না, সে রমজান মাসে (ইবাদতের) ফসল তুলতে পারবে না।’ (বায়হাকি)। এ সম্পর্কে কোরআনে এসেছে, ‘নিশ্চয় আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবী সৃষ্টির দিন থেকে আল্লাহর কাছে গণনায় মাস ১২টি। তার মধ্যে ৪টি (সম্মানিত হওয়ার কারণে) নিষিদ্ধ। এটাই সুপ্রতিষ্ঠিত বিধান।’ (সুরা তাওবা : ৩৬)। মর্যাদাপূর্ণ মাস চারটি হলো- জিলকদ, জিলহজ, মহররম ও রজব। মর্যাদার এ মাসে আল্লাহতায়ালা যাবতীয় যুদ্ধবিগ্রহ, হানাহানি ও রক্তপাত নিষিদ্ধ করেছেন। রাসুল (সা.) বলেন, ‘আল্লাহতায়ালা আসমান-জমিন সৃষ্টি করার দিন থেকে বারো মাসে বছর হয়। এর মধ্যে চারটি মাস সম্মানিত; তিনটি একাধারে জিলকদ, জিলহজ ও মহররম এবং চতুর্থটি হলো ‘রজব মুদার’, যা জুমাদাল আখিরা ও শাবানের মধ্যবর্তী মাস।’ (মুসলিম)।

ইবাদত ও বরকত লাভের মাস : রাসুল (সা.) এ মাসে বেশি বেশি ইবাদত-বন্দেগি করতেন। রোজাও রাখতেন। আনাস ইবনে মালেক (রা.) থেকে বর্ণিত; পশ্চিমাকাশে রজবের চাঁদ দেখা গেলে রাসুল (সা.) আবেগময় কণ্ঠে বরকত লাভের আশায় পড়তেন, ‘আল্লাহুম্মা বারিক লানা ফি রজাবা ওয়া শাবান, ওয়া বাল্লিগনা রমাদান।’ (বোখারি ও মুসলিম)। এ কারণে রজব শুরু হতে মোমিন বান্দারা রমজানের প্রতীক্ষায় দিন গুনতে থাকে। রজবের পরে আসে ‘শাবান’।

এ মাসের ১৪ তারিখ দিবাগত রাতটি বিশেষ মর্যাদাপূর্ণ। ভারত উপমহাদেশে এ রাতকে শবেবরাত বলা হয়। শবেবরাত মোমিনের হৃদয়ে আলাদা এক উত্তাপ ছড়ায়। শাবানের পূর্ণ নাম হলো ‘আশ শাবানুল মুআজ্জাম।’ অর্থাৎ মহিমান্বিত শাবান। রাসুল (সা.) রমজানের আগের দু’মাস অর্থাৎ রজব ও শাবানে বেশি বেশি নফল ইবাদত ও রোজা রাখতেন। রাসুল (সা.) বলেন, ‘রজব হলো আল্লাহর মাস, শাবান হলো আমার মাস; রমজান হলো আমার উম্মতের মাস।’ (তিরমিজি)। তাই রমজানের প্রস্তুতির ব্যাপারে প্রত্যেক মোমিনের জন্য জরুরি হলো, রজবে বেশি বেশি ইবাদতের মাধ্যমে মনের জমিন চাষাবাদ করা, শাবানে বেশি নফল ইবাদত ও রোজার অভ্যাস তৈরি করে মনের জমিনে বীজ বপন করা; আর রমজানে রোজা, তারাবি ও তাহাজ্জুদ ইত্যাদির মাধ্যমে ফসল ঘরে তুলে আনা।

শাবান মাসে নবী (সা.) ও সাহাবিদের আমল : নবী (সা.) ও সাহাবায়ে কেরাম রজবের দিন-রাত যাপন করতেন অশ্রুসিক্ত নয়নে। প্রতীক্ষা করতেন অধীর আগ্রহে কবে আসবে রমজান। রাসুল (সা.) ও সাহাবিগণ রজব ও শাবানে প্রচুর আমল করতেন। সালাফে সালিহিন ও আমাদের আকাবিররাও শাবান এলেই রমজানের প্রস্তুতি গ্রহণ করতেন। প্রতীক্ষার প্রহর গুণতেন, কবে আসবে রমজান। আম্মাজান আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত, ‘রাসুলুল্লাহ (সা.) শাবান মাসের (দিন-তারিখের হিসাবের) প্রতি বেশি লক্ষ রাখতেন, যা অন্য মাসের ক্ষেত্রে রাখতেন না।’ (আবু দাউদ)। উম্মে সালমা (রা.) বলেন, ‘আমি রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে শাবান ও রমজান মাস ছাড়া অন্য কোনো দুই মাসে একাধারে রোজা রাখতে দেখিনি।’ (আবু দাউদ)। আয়েশা রা. বলেন, ‘আমি নবী করিম (সা.)-কে শাবান মাসের মতো এত বেশি নফল রোজা আর অন্য কোনো মাসে রাখতে দেখিনি। এ মাসের সামান্য কয়েক দিন ছাড়া সারা মাসই রোজা রাখতেন।’ (তিরমিজি)। আনাস রা. থেকে বর্ণিত, ‘একবার রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে জিজ্ঞাসা করা হলো, হে আল্লাহর রাসুল, রমজানের পর কোন মাসের রোজা সবচেয়ে বেশি ফজিলতপূর্ণ? উত্তরে তিনি বলেন, ‘শাবান মাসের রোজা সবচেয়ে বেশি ফজিলতপূর্ণ ।’ (তিরমিজি)।

নবীপত্নীদের রমজানের প্রস্তুতি : সাহাবি ও নবীপত্নীরাও বেশ গুরুত্বসহকারে শাবানে রমজানের প্রস্তুতি নিতেন। যারা শাবানে রোজা রাখতেন না রাসুল (সা.) তাদের রমজানের পরে অতিরিক্ত দুটি রোজা রাখতে উপদেশ দিতেন। ইমরান ইবনু হুসাইন (রা.) থেকে একটি হাদিস বর্ণিত আছে, ‘রাসুল (সা.) কোনো একজনকে বলেছিলেন, ‘হে অমুকের পিতা! তুমি কি শাবান মাসের শেষ দিকে রোজা রাখোনি? তিনি বললেন, না। এ কথা শুনে নবীজি বললেন, তাহলে তুমি রমজানের পরে দুটি রোজা রেখে দিয়ো।’ (বোখারি ও মুসলিম)। তাই আমাদের প্রত্যেকের উচিত, রজব ও শাবান থেকেই রমজানের প্রস্তুতি শুরু করে দেওয়া। বিশেষত কোরআন তেলাওয়াত, নফল রোজা ও তাহাজ্জুদের সময় বের করা। আল্লাহর কাছে দোয়া করা, তিনি যেন আমাদের রমজান পর্যন্ত পৌঁছে দেন।

রমজানের পূর্বপ্রস্তুতি :

১. রমজানের আগেই তওবা করা : রমজানের আগে তওবা করে নেয়া উচিত। যাতে পুতঃপবিত্র মন ও প্রশান্ত চিত্ত নিয়ে এ মোবারক মাসে প্রবেশ করা সম্ভব হয়। আর স্থির হৃদয় নিয়ে আল্লাহর আনুগত্য ও ইবাদতে মশগুল থাকার সুযোগ হয়। তওবা সম্পর্কে আল্লাহতায়ালা বলেছেন, ‘হে মোমিনগণ! তোমরা সবাই আল্লাহর কাছে তওবা কর; যাতে করে সফলকাম হতে পার।’ (সুরা নুর : ৩১)। আর রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘হে লোকেরা, আপনারা আল্লাহর কাছে তওবা করুন। আমি প্রতিদিন তাঁর কাছে ১০০ বার তওবা করি।’ (মুসলিম)।

২. দোয়া করা : অনেক সালাফের জীবনে আমরা দেখতে পাই, তাঁরা রমজানের প্রতীক্ষায় ছয় মাস আগে থেকেই আল্লাহর কাছে দোয়া করতেন, যেন আল্লাহ তাঁদের রমজান পর্যন্ত পৌঁছে দেন। আর রমজানের পর পাঁচ মাস দোয়া করতেন যেন আল্লাহ তাঁদের আমলগুলো কবুল করে নেন।

তাই একজন মুসলিম তার রবের কাছে বিনীতভাবে দোয়া করবে, আল্লাহ যেন তাকে সুস্থতার সঙ্গে রমজান পর্যন্ত জীবিত রাখেন। মুমিন আরো দোয়া করবে, মহান আল্লাহ যেন তাকে নেক আমলের ক্ষেত্রে সাহায্য করেন এবং তার আমলগুলো কবুল করে নেন।

৩. ওয়াজিব রোজা থেকে মুক্ত হওয়া : আবু সালামা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন আমি আয়েশা (রা.)-কে বলতে শুনেছি, ‘আমার উপর বিগত রমজানের রোজা বাকি থাকলে শাবান মাস ছাড়া আমি তা আদায় করতে পারতাম না।’ (বোখারি ও মুসলিম)। ইবনে হাজার (রহ.) বলেন, ‘শাবান মাসে আয়েশা (রা.) তার কাজা রোজা আদায় করার বিষয়ে সচেষ্ট হওয়া থেকে বিধান গ্রহণ করা যায়, রমজানের কাজা রোজা পরবর্তী রমজান আসার আগেই আদায় করে নিতে হবে।’ (ফাতহুল বারি)।

৪. মাসআলা জানা : রোজার মাসআালা-মাসাইল জেনে নেয়া এবং রমজানের ফজিলত সম্পর্কে অবগত হওয়া। রোজা ভেঙ্গে যাওয়ার কারণগুলো জেনে নেয়া, কোনো কারণবশত রোজা ভেঙে গেলে তা কাযা করার নিয়ম কী, কাফফারা আসবে কিনা এসব বিষয়ে মাসাইল জেনে নেয়া।

৫. ইবাদতে প্রতিবন্ধকতা থেকে মুক্ত হওয়া : যেসব কাজ রমজানে ইবাদত-বন্দেগিতে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে পারে, সেগুলো আগ থেকেই দ্রুত শেষ করার চেষ্টা করা। রমজানে যেন পুরো ফ্রি থেকে শুধু ইবাদতে মশগুল থাকা যায়, এমনভাবে নিজেকে প্রস্তুত করা।

৬. পরিবারকে রমজানের বিষয়ে সচেতন করা : স্ত্রী-পুত্রসহ পরিবারের সবাইকে নিয়ে বসে রমজানের মাসআলা-মাসাইল আলোচনা করা এবং ছোটদেরকেও রোজা পালনে উদ্বুব্ধ করা।

৭. রমজানবিষয়ক বইপত্র পড়া : রমজান আসার আগেই রমজানের বিধিবিধান সম্পর্কিত বিষয়ে জ্ঞান লাভ করার চেষ্টা করা। রোজা ও তারাবিবিষয়ক মাসআলাগুলো বারবার পড়ে নেয়া। যাতে যথাযথভাবে রোজা আদায় করে রমজানের পূর্ণ ফজিলত আদায় করা যায়।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত