ঢাকা শুক্রবার, ০৪ জুলাই ২০২৫, ২০ আষাঢ় ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

হজ ইসলামের শ্রেষ্ঠ আমল

ইলিয়াস মশহুদ
হজ ইসলামের শ্রেষ্ঠ আমল

হজ আরবি শব্দ। এর শাব্দিক অর্থ- সংকল্প করা, ইচ্ছা করা, সফর করা। পরিভাষায় হজ বলা হয়, নিয়তসহ ইহরাম ধারণ করে নির্দিষ্ট দিনে আরাফার ময়দানে অবস্থান করা ও কাবা শরিফ তাওয়াফ করা। (ফতোয়ায়ে শামি : ২/৪৫৪)। হজের নির্দিষ্ট সময় হলো আশহুরুল হুরুম তথা শাওয়াল, জিলকদ ও জিলহজের প্রথম ১০ দিন; বিশেষত জিলহজের ৮ থেকে ১২ তারিখ পর্যন্ত পাঁচদিন। এ দিনগুলোতেই মূলত হজ পালন করা হয়। হজের নির্ধারিত স্থান হলো পবিত্র কাবা, সাফা-মারওয়া, মিনা, আরাফা ও মুজদালিফা। দূরের হাজিদের জন্য মদিনা মোনাওয়ারায় রাসুল (সা.)-এর রওজা জেয়ারত করা ওয়াজিব। হজের কার্যাবলির মধ্যে রয়েছে- ইহরাম, তালবিয়া, তাওয়াফ ও সাঈ; আরাফা, মুজদালিফা ও মিনায় অবস্থান, কংকর নিক্ষেপ, দম ও কোরবানি, মাথা মুণ্ডানো ও কসর (নামাজ সংক্ষিপ্তকরণ) এবং রাসুল (সা.)-এর রওজা জেয়ারত ইত্যাদি।

হজের বিধান : হজ ইসলামের অন্যতম স্তম্ভ ও রোকন। আর্থিক ও দৈহিকভাবে সামর্থ্যবান নারী-পুরুষের ওপর জীবনে একবার হজ করা ফরজ। মহান আল্লাহর নৈকট্য লাভের একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হজ। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘প্রত্যেক সামর্থ্যবান লোকের ওপর আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য বাইতুল্লাহর হজ করা ফরজ।’ (সুরা আলে ইমরান : ৯৭)। রাসুল (সা.) বলেন, ‘লোকসকল! আল্লাহতায়ালা তোমাদের ওপর হজ ফরজ করেছেন।’ আকরা ইবনে হাবিস (রা.) বললেন, ‘হে আল্লাহর রাসুল! এটা কি প্রত্যেক বছর ফরজ?’ রাসুল (সা.) বললেন, ‘আমি যদি হ্যাঁ বলতাম, তবে ফরজ হয়ে যেত। আর প্রতি বছর হজ ফরজ হলে তা তোমরা সম্পাদন করতে সক্ষম হতে না। এজন্য হজ জীবনে একবারই ফরজ। কেউ যদি একাধিকবার করে, তবে তা হবে নফল হজ।’ (বোখারি : ৭২৮৮)। এ ছাড়া হাদিসে হজের অসংখ্য সওয়াব ও ফজিলত বর্ণিত হয়েছে।

হজের ধরন : হজ তিন ধরনের- ইফরাদ, তামাত্তু, কিরান। ১. ইফরাদ : শুধু হজের নিয়তে ইহরাম ধারণ করে ওই ইহরামেই হজের সব আমল সম্পন্ন করাকে ইফরাদ হজ বলে। ২. তামাত্তু : শুধু ওমরার নিয়তে ইহরাম ধারণ করে উমরার কাজ সমাপ্ত করা, এরপর মাথা মুণ্ডিয়ে ইহরাম থেকে মুক্ত হওয়া, তারপর ওই সফরেই হজের নিয়তে ইহরাম বেঁধে হজের সব আমল সম্পাদন করাকে তামাত্তু হজ বলে। ৩. কিরান : একসঙ্গে ওমরা ও হজের নিয়তে ইহরাম ধারণ করে ওই (একই) ইহরামেই ওমরা ও হজ পালন করাকে কিরান হজ বলে। এ তিন ধরনের হজের মধ্যে সওয়াবের দিক দিয়ে সর্বাধিক উত্তম হলো কিরান, এরপর তামাত্তু, এরপর ইফরাদ। তবে আদায়ের ক্ষেত্রে সহজতার বিবেচনায় প্রথমে তামাত্তু, এরপর ইফরাদ, এরপর কিরান হজ উত্তম। যেহেতু তামাত্তু পালন করা সবচেয়ে সহজ, তাই অধিকাংশ বাংলাদেশি তামাত্তু হজ আদায় করে থাকেন। যারা অন্যের বদলি হজ করতে যান বা যাদের অবস্থান মিকাতের মধ্যে, তারা সাধারণত ইফরাদ হজ করেন। এ ছাড়া কিছুসংখ্যক হাজি কিরান হজ করেন, তবে এদের সংখ্যা খুব কম। (ফতোয়ায়ে শামি : ২/৫২৯)।

যাদের ওপর হজ ফরজ : পাঁচটি শর্তসাপেক্ষে হজ ফরজ হয়। যথা- ১. মুসলমান হওয়া, ২. বিবেকবান হওয়া, অর্থাৎ পাগল না হওয়া, ৩. প্রাপ্তবয়স্ক হওয়া, ৪. স্বাধীন হওয়া এবং ৫. দৈহিক ও আর্থিকভাবে সামর্থ্যবান হওয়া। তবে নারীদের ক্ষেত্রে আরেকটি শর্ত যুক্ত হবে, সেটি হলো- সঙ্গে ‘মাহরাম’ (যেসব পুরুষের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ বৈধ) থাকা। স্মরণ রাখতে হবে, জাকাত ফরজ না হয়েও কারও ওপর হজ ফরজ হতে পারে। কেননা, হজ ও জাকাতের মধ্যে বিশেষ পার্থক্য রয়েছে। যেমন- জাকাতের সম্পর্ক নির্ধারিত নেসাবের সঙ্গে। হজের সম্পর্ক মক্কায় আসা-যাওয়ার খরচের সঙ্গে। সুতরাং স্থাবর সম্পত্তির কিছু অংশ বিক্রি করে কেউ যদি হজ আদায় করতে সক্ষম হয় এবং হজ থেকে ফিরে এসে বাকি সম্পত্তি দিয়ে জীবিকা নির্বাহ করতে পারে, তাহলে তার ওপর হজ ফরজ। (আহসানুল ফাতাওয়া : ৪/৫১৬)। একইভাবে ব্যবসায়ীর দোকানে যে পরিমাণ পণ্য আছে, তার কিছু অংশ বিক্রি করলে যদি হজ করা সম্ভব হয় এবং ফিরে এসে যদি বাকি পণ্য দিয়ে জীবিকা নির্বাহ করা যায়, তাহলে তার ওপরও হজ ফরজ। (ইমদাদুল আহকাম : ২/১৫৩)।

সমাজের প্রচলিত ভুল ধারণা : আমাদের সমাজে একটি ভুল ধারণা প্রচলিত আছে, তা হলো- আগে মাতাপিতাকে হজ করাবে, পরে নিজের কথা চিন্তা করবে। এটি সঠিক নয়; বরং সামর্থ্য থাকলে তাদের নিয়ে একসঙ্গে হজ করবে। অন্যথায় আগে নিজের ফরজ আদায় করবে। (ফতোয়ায়ে রহিমিয়া : ৮/২৮২)। আবার অনেকে মনে করেন, সন্তানের বিয়ে দেওয়ার পর হজ আদায় করতে হয়। অথচ এ কথা ইসলাম সমর্থিত নয়। ইসলামের দৃষ্টিতে সন্তানের বিয়ের জন্য হজে বিলম্ব করা যাবে না। (ফতোয়ায়ে রহিমিয়া : ৮/২৭৬)। যাদের ওপর হজ ফরজ, যত দ্রুত সম্ভব হজ আদায় করা উত্তম। যেখানে মানুষের জীবন-মরণের এক সেকেন্ডের নিশ্চয়তা নেই, সেখানে এক বছর অনেক দীর্ঘ সময়। তাই রাসুল (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি হজ করার ইচ্ছা করেছে, সে যেন তাড়াতাড়ি তা করে নেয়।’ (সুনানে আবি দাউদ : ১৭৩২)।

হজ ইসলামের অন্যতম আমল : যে কাজে কষ্ট বেশি, তার সওয়াব ও ফজিলত তত বেশি। তাই রাসুল (সা.)-এর প্রতি ঈমান আনার পর জিহাদ ও হজকে সর্বোত্তম আমল বলা হয়েছে। একবার রাসুল (সা.)-কে জিজ্ঞেস করা হলো, ‘সর্বোত্তম আমল কোনটি?’ তিনি বললেন, ‘আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের প্রতি ঈমান আনা।’ প্রশ্ন করা হলো, ‘তারপর কোনটি?’ তিনি বললেন, ‘আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করা।’ আবার প্রশ্ন করা হলো, ‘এরপর কোনটি?’ তিনি বললেন, ‘হজ্জে মাবরুর তথা মকবুল হজ।’ (বোখারি : ১৫১৯)।

নিষ্পাপ হওয়ার মাধ্যম : রাসুল (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশে হজ করল এবং এ সময় অশ্লীলতা ও গোনাহের কাজ থেকে বিরত থাকল, সে যেন নবজাতক শিশুর মতো নিষ্পাপ হয়ে ফিরল।’ (বোখারি : ১৫২১)। হজের বিনিময় জান্নাত। আবু হুরায়রা (রা.) সূত্রে বর্ণিত; রাসুল (সা.) বলেন, ‘এক ওমরা থেকে আরেক ওমরা পর্যন্ত মধ্যবর্তী সময়ের গোনাহের ক্ষতিপূরণ হয়ে যায়। আর হজ্জে মাবরুরের প্রতিদান তো জান্নাত ছাড়া আর কিছুই নয়।’ (বোখারি : ১৭৭৩, মুসলিম : ১৩৪৯)।

হজ না করার পরিণাম : সামর্থ্য থাকার পরও হজ না করার পরিণাম অত্যন্ত ভয়াবহ। ফরজ হজ ত্যাগ করলে ইহুদি-নাসারার মতো মৃত্যু হবে বলে হাদিসে সতর্ক করা হয়েছে। ওমর ইবনুল খাত্তাব (রা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি হজ করার সামর্থ্য রাখে, তবু হজ করে না, সে ইহুদি নাকি খ্রিষ্টান হয়ে মৃত্যুবরণ করল, তার কোনো পরোয়া আল্লাহর নেই।’ (তাফসিরে ইবনে কাসির : ১/৫৭৮)। কেউ যদি হজ অস্বীকার করে বা কোনো ধরনের অবহেলা প্রদর্শন করে, তবে সে আল্লাহর জিম্মার বাইরে বলে বিবেচিত হবে। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘মানুষের মধ্যে যারা সেখানে (বাইতুল্লাহ) পৌঁছার সামর্থ্য রাখে, তাদের ওপর আল্লাহর উদ্দেশে সেই ঘরের হজ করা ফরজ। আর কেউ যদি অস্বীকার করে, তাহলে জেনে রাখা উচিত, আল্লাহতায়ালা সৃষ্টিজগতের প্রতি মুখাপেক্ষী নন।’ (সুরা আলে ইমরান : ৯৭)। এ ছাড়া হাদিসে কুদসিতে মহান আল্লাহ হজ না করার পরিণতি সম্পর্কে বলেছেন, ‘যে বান্দাকে আমি দৈহিক সুস্থতা দিয়েছি এবং আর্থিক প্রাচুর্য দান করেছি, এরপর (গড়িমসি করে) তার পাঁচবছর অতিবাহিত হয়ে যায়, অথচ আমার দিকে (হজব্রত পালন করতে) আগমন করে না, সে অবশ্যই বঞ্চিত।’ (সহিহ ইবনে হিব্বান : ৩৭০৩)।

লেখক : সহ-সম্পাদক, কালান্তর

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত