ঢাকা ১১ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ২৮ মাঘ ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

আওয়ামী লীগের কর্মসূচি

পাত্তা দিচ্ছে না রাজনৈতিক দলগুলো

পাত্তা দিচ্ছে না রাজনৈতিক দলগুলো

ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার ছয় মাস পরে রাজনীতিতে ফেরার চেষ্টায় আওয়ামী লীগ। এরই অংশ হিসেবে অন্তর্বর্তী সরকারের পদত্যাগের দাবিতে আগামী ১ থেকে ১৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সর্বাত্মক ‘কঠোর’ হরতাল-অবরোধসহ মোট পাঁচ ধরনের কর্মসূচির ঘোষণা দিয়েছে দলটি। তবে আওয়ামী লীগের ভার্চুয়ালি ঘোষিত এই কর্মসূচি গায়ে মাখছে না রাজনৈতিক দলগুলো।

তারা বলছে, অস্তিত্বের জানান দিতেই এই কর্মসূচি ঘোষণা করেছে আওয়ামী লীগ। তবে ১৫ বছরের অপশাসন, গুম, খুন, লুটপাট ও জুলাই গণহত্যার কারণে জনগণের কাছে প্রত্যাখ্যাত আওয়ামী লীগ এত সহজেই হালে পানি পাবে না। তাদের দলীয় প্রধানসহ বেশিরভাগ নেতাকর্মী পলাতক কিংবা বিচারের মুখোমুখি।

আওয়ামী লীগ মাঠে নামলে দৌড়ানি খাবে। মাঠে নামলে কেউ ঘরে ফিরতে পারবে না। ছাত্রজনতা যে বিপ্লবী শক্তি, এই শক্তি তাদের প্রতিহত করবে এবং তাদের পুলিশের কাছে সোপর্দ করা হবে।

গত মঙ্গলবার রাতে আওয়ামী লীগের ভেরিফাইড ফেসবুক পেজ থেকে অন্তর্বর্তী সরকারের পদত্যাগ চেয়ে পহেলা ফেব্রুয়ারি থেকে ১৮ দিনব্যাপী কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়। কর্মসূচি অনুযায়ী, আগামী ১ ফেব্রুয়ারি থেকে ৫ ফেব্রুয়ারি বুধবার দাবির লিফলেট বা প্রচারপত্র বিলি করবে দলটি। ৬ ফেব্রুয়ারি দেশে প্রতিবাদ মিছিল ও সমাবেশ অনুষ্ঠিত হবে। ১০ই ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত হবে বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ। ১৬ ফেব্রুয়ারি রোববার অবরোধ এবং ১৮ ফেব্রুয়ারি মঙ্গলবার দেশব্যাপী সকাল-সন্ধ্যা সর্বাত্মক ‘কঠোর’ হরতাল কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়েছে।

আওয়ামী লীগের কর্মসূচি ঘোষণার পরে এ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যাপক সমালোচনার সৃষ্টি হয়েছে। এই কর্মসূচির বিষয়ে মন্তব্য করতে গিয়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা বলেন, আওয়ামী লীগ গোপনে গোপনে কর্মসূচি ঘোষণা করে মাঠে ফেরার চেষ্টা করছে। কিন্তু প্রকাশ্যে কর্মসূচি ঘোষণা করার মতো লোক তাদের নেই। তারা চোরাগুপ্ত কায়দায় যেভাবে ফেরার চেষ্টা করছে এটা মানুষ গ্রহণ করবে না। তারা তো ভারতে পালিয়ে গিয়েছে, তারা ভারতে থেকে কীভাবে বাংলাদেশে কর্মসূচি পালন করবে। মনে হয় না তারা সেই দুঃসাহস দেখাবে। গত ১৫ বছর তারা দেশকে ধ্বংস করে দিয়েছে। কর্মসূচি পালন করার মতো সেই শক্তি তাদের নেই।

গত ৫ আগস্ট ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর থেকে আওয়ামী লীগের কোনো সক্রিয় কর্মকাণ্ড লক্ষ্য করা যায়নি। দলের প্রধান নেতাকর্মীর বেশিরভাগই দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন, কেউ আত্মগোপনে রয়েছেন এবং বেশ কিছু নেতা একাধিক মামলায় আটক হয়ে কারাগারে রয়েছেন। দলের কয়েকজন নেতাকে বিচ্ছিন্নভাবে কিছু বিবৃতি দিতে দেখা গেলেও, এখন আর দলের কোনো নেতৃত্ব বা কার্যক্রম স্পষ্টভাবে দৃশ্যমান নয়। এমনকি ঢাকায় দলটির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ও ভাঙচুর করা হয়েছে। দেশের বিভিন্ন জেলায় আওয়ামী লীগের পাশাপাশি এর সহযোগী সংগঠনের কার্যালয় ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাট করা হয়।

গণ-আন্দোলনের মুখে আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনা ভারতে চলে যাওয়ার পর সেখানেই অবস্থান করছেন। তার বিরুদ্ধে জুলাই-আগস্ট আন্দোলন দমনে অতিরিক্ত বল প্রয়োগ করার অভিযোগ রয়েছে। পাশাপাশি হত্যা, গণহত্যা, গুম ও নির্যাতনসহ একাধিক মামলা করা হয়েছে। চলমান মামলায় আদালতে আত্মসমর্পণ না করায় ‘পলাতক’ ঘোষণা করা হয়েছে শেখ হাসিনাকে। তার প্রত্যর্পণের জন্য গত ২৩ ডিসেম্বর বাংলাদেশ ভারতকে আনুষ্ঠানিকভাবে অনুরোধ জানিয়েছে। দলের এরকম অবস্থায় ফেব্রুয়ারি মাসব্যাপী আওয়ামী লীগের কর্মসূচির বাস্তবায়ন কিছুটা অবাস্তব বলেই ধারণা করা হচ্ছে। এর আগে গত ১০ নভেম্বর রাস্তায় নামার ঘোষণা দিয়েও নামতে পারেননি আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা।

সরকার পতন ও এতো মানুষ হত্যার পর আওয়ামী লীগের কর্মসূচি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন জাতীয় নাগরিক কমিটির প্রধান সংগঠক সারজিস আলম। তিনি বলেন, এত মানুষ হত্যা করার পরও শেখ হাসিনা কীভাবে কর্মসূচি ঘোষণা করেন? যে দেশে এত হত্যাযজ্ঞ হয়েছে, সেখানে এলে তো ফাঁসির মঞ্চে ঝুলতে হবে। গত বুধবার কাকরাইলে উইলস লিটল ফ্লাওয়ার স্কুলে জুলাই গণঅভ্যুত্থান বিষয়ক প্রদর্শনী পরিদর্শন করতে গিয়ে এই মন্তব্য করেন তিনি।

প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম গুম-খুন ও হাজার কোটি টাকা পাচারে জড়িত আওয়ামী লীগকে কর্মসূচি পালনে অনুমতি দেয়ার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন। গত বুধবার ফেসবুকে দেয়া এক পোস্টে তিনি এ বিষয়ে নিজের অবস্থান পরিষ্কার করেছেন।

গণধিকার পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মো. রাশেদ খান বলেন, আওয়ামী লীগ মাঠে নামলে দৌড়ানি খাবে। মাঠে নামলে কেউ ঘরে ফিরতে পারবে না। ছাত্রজনতা যে বিপ্লবী শক্তি, এই শক্তি তাদের প্রতিহত করবে এবং তাদের পুলিশের কাছে সোপর্দ করা হবে। সুতরাং তাদের বলব সাবধান হয়ে যান। যারা ঘরে আছেন ঘরেই থাকেন, যারা পালিয়ে আছেন পালিয়েই থাকেন। মাঠে নামার চেষ্টা করবেন না। শেখ হাসিনার উসকানির ফাঁদে পা দিলে তাদের রক্ষা হবে না।

বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বলেন, আওয়ামী লীগ রাজনৈতিক মাঠে ফিরে আসার চেষ্টা করছে। তারা ফিরে আসতে পারছে এটা আমি মনে করছি না। কিন্তু তারা বহুভাবে চেষ্টা করছে। তারই অংশ হিসেবে ফেব্রুয়ারি মাসে ঘোষণা করেছে এটা সোশ্যাল মিডিয়া দেখেছি। অভ্যুত্থানকারী শক্তির মধ্যে অনাকাঙ্ক্ষিত বিভাজন-দূরত্ব তৈরি হচ্ছে। এই সুযোগটা আওয়ামী লীগ গ্রহণ করছে কি না এই বিষয়টি ভেবে দেখার দরকার সবাইকে। আমাদের মধ্যে নানা প্রশ্নের বিতর্ক থাকতে পারে। কিন্তু মনে হচ্ছে যে, দূরত্ব বিভাজনের জায়গাটা ক্রমান্বয়ে আরো স্পষ্ট হয়ে উঠছে। এই সুযোগটা হয়তো ফ্যাসিস্ট রিজিম নেয়ার চেষ্টা করবে।

তিনি বলেন, তারা চোরাগুপ্ত কায়দায় যেভাবে ফেরার চেষ্টা করছে এটা মানুষ গ্রহণ করবে না। সামগ্রিকভাবে একধরনের অস্থিরতা চলছে, এই সুযোগটা আওয়ামী লীগ নেয়ার চেষ্টা করছে এবং করবে এটা আমার আশঙ্কা। সেদিক থেকে জনগণকে ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে। অভ্যুত্থানের স্বপক্ষের শক্তিগুলোকে বিতর্কের মাঝেও তাদের মধ্যে বোঝা পড়ার ঐক্যটাকে ধরে রাখার জন্য সচেতন চেষ্টা অব্যাহত রাখা দরকার।

আওয়ামী লীগের কর্মসূচি কীভাবে দেখছে বিএনপি জানতে চাইলে দলটির ভাইস চেয়ারম্যান শামসুজ্জামান দুদু বলেন, আওয়ামী লীগ বলে দেশে কিছু আছে! এটাই তো এখন বিশ্বাসযোগ্য নয়। তাদের সভা নেত্রী, সাধারণ সম্পাদক ও অন্যান্য নেতৃবৃন্দ কোথায় পালিয়েছে সেটাই তো দেশবাসী জানে না। মাঝে মাঝে মাথা বের করে কচ্ছপের মতো শেখ হাসিনা। সেটাও ভারতের মাটিতে বসে। তাদের অফিস এখন পেশাবখানায় রূপান্তরিত হয়েছে। মানুষ কোন অবস্থায় ব্যবহার করে সেটা আমরা বিভিন্ন মিডিয়ার মাধ্যমে দেখছি। এমনকি তাদের যেসব আস্তানা ছিল তা ছেড়ে তারা সবাই পালিয়েছে। সেই অবস্থায় যদি তারা কর্মসূচির নামে তারা তামাশা করে তা নিয়ে আমাদের মন্তব্য নয়। এমন পরিণতি এই মাটিতে ব্রিটিশ আমলে, পাকিস্তান আমলে কিংবা বাংলাদেশের সময় কখনো হয়নি কোনো রাজনীতি দলের জন্য। এই কর্মসূচি নিখোঁজ আওয়ামী লীগ, নিখোঁজ আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দের জন্য, আমরা প্রত্যক্ষ করেছি। এটা ভয়াবহ এক অভিজ্ঞতা, এজন্য আওয়ামী লীগের কর্মসূচি নিয়ে আলোচনা করাটা একটি বিদ্রূপের মতো। এ নিয়ে কথা না বলাই ভালো।

নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, আওয়ামী লীগ তো গোপনে গোপনে কর্মসূচি ঘোষণা করেছে। প্রকাশ্যে ঘোষণা করার মতো মানুষও ওদের নেই। অস্তিত্বের জানান দিতে তাদের এই কর্মসূচি। যারা প্রকাশ্যে কর্মসূচি ঘোষণা করতে পারে না তারা কর্মসূচি করবে কীভাবে? অতীতে যে কোনো পার্টির ওপরে নিপীড়ন নির্যাতন নিষেধাজ্ঞা আসছে তখন এরকম পদ্ধতি নিয়েছে। এখন তো তাদের ওপর নির্যাতন করা হচ্ছে না। নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়নি। কেবলমাত্র তাদের মধ্যে যাদের বিরুদ্ধে সরাসরি হত্যা লুটপাট নির্যাতনের অভিযোগ রয়েছে তাদের বিরুদ্ধে মামলা দেয়া হয়েছে। যারা প্রকাশ্যে কর্মসূচি ঘোষণা করতে পারে না তারা কর্মসূচি করবে কীভাবে? জনগণ যদি সমর্থন করে তখন দেখা যাবে। মনে হয় না জনসম্মুখে আসার মতো পরিস্থিতি তাদের হয়েছে। তারা মাঠে আছে, অস্তিত্বের জানান দিতে কর্মসূচি ঘোষণা করেছে। তাদের কর্মসূচি মানুষের রেসপন্স করবে বলে প্রশ্নই আসে না। যত বড় অন্যায় অত্যাচার করেছে তার জন্য কোনো অনুশোচনা নেই। মানুষের কাছে তাদের ক্ষমা ভিক্ষা করা উচিত। বরং উল্টো দেখাচ্ছে। এসব করে কিছু হবে না।

আওয়ামী লীগের কর্মসূচি কীভাবে দেখছেন জানতে চাইলে এলডিপির প্রেসিডেন্ট ড. কর্নেল (অব.) অলি আহমদ বলেন, আওয়ামী লীগ তো ভারতে পালিয়ে গেছে, তারা ভারতে থেকে কীভাবে বাংলাদেশে কর্মসূচি পালন করবে। আমার মনে হয় না তাদের এই দুঃসাহস হবে। তারা গত ১৫ বছরে বাংলাদেশকে ধ্বংস করে দিয়েছে। কর্মসূচি পালন করার মতো তাদের সেই শক্তি আর নেই। আমাদের কোনো রাজনৈতিক দল যদি তাদের সাহায্য না করে তাহলে আওয়ামী লীগকে মুসলিম লীগের ভাগ্য বরণ করতে হবে।

আওয়ামী লীগ কর্মসূচি নিয়ে জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ডক্টর খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, একটি দল যদি প্রোগ্রাম করতে চায় জনগণ কীভাবে গ্রহণ করবে সেটা দেখব।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত