ঢাকা শনিবার, ০৬ ডিসেম্বর ২০২৫, ২১ অগ্রহায়ণ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

জুলাইকন্যা পুরস্কার পেলেন দুই বোন

* ভয়কে জয় করে আহতদের পাশে ছিলেন ডা. নীলা ও ডা. ইভা * বন্ধু-সহকর্মীদের ডেকে এনে রক্ত জোগাড় করেন তারা
জুলাইকন্যা পুরস্কার পেলেন দুই বোন

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনের সময়ে ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের শত বাধা ও রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে মানবসেবার ঢাল হিসেবে আহতদের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন ডা. যাকিয়া সুলতানা নীলা ও ডা. ইসরাত জাহান ইভা।

জুলাই আন্দোলনের দিনগুলোতে আহতদের সেবা দেওয়ায় সামনের সারিতে ছিলেন তারা। হাসপাতালের করিডোরে, অপারেশন থিয়েটারে, জরুরি বিভাগে ঝুঁকি নিয়ে মানুষের জীবন বাঁচিয়েছেন। সেই মানবসেবার কর্মকাণ্ড স্মরণীয় করে রাখতে ‘জুলাই কন্যা অ্যাওয়ার্ড’ পেলেন দুই বোন। গত শুক্রবার রাজধানীর ফার্মগেটে কৃষিবিদ ইনস্টিটিউটশন বাংলাদেশ (কেআইবি) মিলনায়তনে জুলাই কন্যা ফাউন্ডেশন তাদের পুরস্কৃত করে। এ সময় বাছাইকৃত মোট ১০০ নারীকে জুলাই কন্যা অ্যাওয়ার্ড দেওয়া হয়। জুলাই কন্যা ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে আয়োজিত অনুষ্ঠানে তাদের হাতে পুরস্কার তুলে দেন মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ উপদেষ্টা ফরিদা আখতার, ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান জান্নাতুন নাইম প্রমি এবং শহীদ আবরার ফাহাদের মা রোকেয়া বেগম।

সংগ্রামের মঞ্চ থেকে সম্মাননার মঞ্চে : ডা. নীলা ও ডা. ইভা- পেশায় চিকিৎসক হলেও জুলাই আন্দোলনের সময় তারা হয়ে উঠেছিলেন মানবতার ফেরিওয়ালা। আন্দোলনের উত্তাল দিনগুলোতে আহত আন্দোলনকারীদের জন্য চিকিৎসা সামগ্রী সংগ্রহ, রক্তের ব্যবস্থা করা, মাঠে থেকে তাৎক্ষণিক সেবা দেওয়া- সবকিছুতেই ছিল তাদের নিরলস অংশগ্রহণ। নীলা বলেন, আমরা শুধু আমাদের দায়িত্ব পালন করেছি। আহতদের মুখে স্বস্তির হাসিই ছিল সবচেয়ে বড় পুরস্কার।

বাস্তব এক ঘটনার গল্প: জুলাই আন্দোলনের এক দিনে রাজধানী ঢাকার জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে টানা আট ঘণ্টা কাজ করেন নীলা। গুলিবিদ্ধ এক তরুণকে আনা হয় ওই দিন, অবস্থা ছিল আশঙ্কাজনক। হাসপাতালের জরুরি রক্তের মজুত ফুরিয়ে গিয়েছিল। বন্ধু-সহকর্মীদের ডেকে এনে রক্ত জোগাড় করেন এবং চিকিৎসা দেন তারা। নীলা স্মরণ করে বলেন, সেই ছেলেটা কয়েকদিন পর যখন হেঁটে আমাদের কাছে এসে ধন্যবাদ জানিয়েছিল, মনে হয়েছিল এর চেয়ে বড় আনন্দ পৃথিবীতে নেই।

ডা. যাকিয়া সুলতানা নীলা স্মৃতিচারণ করে বলেন, নির্দিষ্ট একটি দলের মদতপুষ্ট চিকিৎসকরা হুমকি-ধমকি ও ভয়ভীতি প্রদর্শন করে, যেন আহতদের চিকিৎসাসেবা না দেই। আমাকে আয়নাঘরে পাঠানোর হুমকি দেওয়া হয়। তার পরেও ভয়কে অগ্রাহ্য করে হাসপাতালের চিকিৎসকরা আহতদের সেবায় এগিয়ে এসেছেন। আমরা আমাদের সর্বস্ব দিয়ে মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছিলাম।

ডা. ইসরাত জাহান ইভা জানান, জাতীয় বীরদের সেবা দিতে পেরে প্রশান্তি অনুভব করেন তিনি। বলেন, যতদিন বেঁচে থাকবো, এই ভেবে মনে একটা প্রশান্তি কাজ করবে।

বোন থেকে সহযোদ্ধা : যে সম্পর্ক শুরু হয়েছিল রক্তের বন্ধনে, তা আন্দোলনের মাঠে রূপ নেয় সহযোদ্ধার ভূমিকায়। ডা. ইভা বলেন, জুলাই আন্দোলনে অনেকেই নিজের জীবন বাজি রেখে এগিয়ে এসেছেন। আমরা ছিলাম চিকিৎসার দায়িত্বে- এটা ছিল আমাদের দেশের জন্য, মানুষের জন্য।

স্বীকৃতির গুরুত্ব : পুরস্কার প্রদানকালে জান্নাতুন নাইম প্রমি বলেন, জুলাই আন্দোলন শুধু রাজনৈতিক পরিবর্তনের গল্প নয়, এটি মানবতারও গল্প। নীলা ও ইভা সেই মানবতার প্রতীক। শহীদ আবরার ফাহাদের মা রোকেয়া বেগমও এ দুই বোনের সাহসিকতা ও দায়িত্বশীলতার প্রশংসা করেন।

সংক্ষিপ্ত জীবনী : যাকিয়া সুলতানা নীলা ও ইসরাত জাহান ইভা- দুজনই ঢাকা মেডিকেল কলেজ থেকে চিকিৎসাশাস্ত্রে ডিগ্রি অর্জন করেছেন। ডা. নীলা জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের ভিট্রিও-রেটিনা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক। হাসপাতালটিতে ভর্তি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে আহতদের চিকিৎসাসেবার কো-অর্ডিনেটর এর ভূমিকাও পালন করেন তিনি। ছোট বোন ডা. ইভা ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজের (মমেক) সার্জারি বিভাগের রেজিস্ট্রার। নীলা বর্তমানে সার্জারি বিভাগে কর্মরত। চিকিৎসার পাশাপাশি তারা স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের সঙ্গেও যুক্ত, বিশেষ করে দুর্যোগকালীন সময়ে চিকিৎসা সহায়তা প্রদানে তারা সক্রিয় ভূমিকা রাখেন।

ভবিষ্যতের প্রেরণা : জুলাই কন্যা অ্যাওয়ার্ড শুধু একটি সম্মাননা নয়- এটি আগামী দিনের জন্য প্রেরণার প্রতীক। নীলা ও ইভা বিশ্বাস করেন, মানবতার ডাকে সাড়া দেওয়াই একজন মানুষের সর্বোচ্চ অর্জন।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত