শেরপুরের নকলা উপজেলার তিন শতাধিক পরিবারের জীবন-জীবিকার একমাত্র অবলম্বন বাঁশের তৈরি পণ্য। উপজেলার চন্দ্রকোনা, নারায়ণখোলা, চরকৈয়া, মমিনাকান্দা, বারমাইসা, ছত্রকোনা, বাউসা, মোজার, চিথলিয়াসহ বিভিন্ন এলাকার ৩ শতাধিক পরিবার এ পেশায় জড়িত। এ পেশাতেই চলে তাদের জীবন-জীবিকা। তাদের রুটি-রুজির একমাত্র মাধ্যম বাঁশ। বাঁশ দিয়ে বিভিন্ন পণ্যসামগ্রী তৈরি করে তা পাইকারি ও খুচরা হিসেবে বিক্রি করেই চলে তাদের ছেলে-মেয়েদের লেখাপড়াসহ পরিবারের সব খরচ। উপজেলার চরঅষ্টধর ইউনিয়নের নারায়ণখোলা গ্রামের একটি এলাকার অধিকাংশ পরিবার এ পেশার সাথে যুক্ত থাকায় এলাকাটি বেপাড়িপাড়া হিসেবে পরিচিত। এখানের স্কুলপড়ুয়া শিক্ষার্থী থেকে বৃদ্ধ সবাই এ পেশায় জড়িত। নারীরা সাংসারিক কাজ শেষ করে এবং শিক্ষার্থীরা পড়ার লেখার ফাঁকে ও ছুটির দিন কাজ করেন। এ থেকে যে আয় হয় তা দিয়েই তাদের পড়া লেখাসহ সব খরচ চলে যায়। ফলে পরিবারের প্রধানকে তাদের ছেলে মেয়েদের পড়া লেখার খরচ বহন করতে বাড়তি চাপ নিতে হয় না। নকলার বাঁশ শিল্পীরা বাঁশ দিয়ে সাধারণত ডালা, কুলা, চালনি, পানের ঢালা, মাছ ধরার ঝুঁড়ি, চাটাই, বিভিন্ন খেলনা, ধান মজুদের ডুলি, ধান রাখার গোলা, মাচা, বিভিন্ন ধরনের খাঁচাসহ মই ও গৃহসজ্জার বাহারি পণ্য ও দৈনন্দিন কাজের নানা রকমের জিনিস তৈরি করেন। বিভিন্ন জেলাতে নকলার তৈরি বাঁশ পণ্যের বেশ চাহিদা রয়েছে। অনেক সময় অগ্রীম টাকা নিয়ে অর্ডার রেখেও তারা কাজ করেন। এতে করে বাঁশ কিনতে নিজের পকেটের টাকা ব্যয় করতে হয় না। ক্রেতাদের টাকাতে বাঁশ কিনে পণ্য তৈরি শেষে তাদের কাছে অল্প লাভে বিক্রি করা হয়। এসব বিক্রি করে চলে তাদের ছেলে-মেয়ের লেখাপড়া ও সংসারের যাবতীয় খরচ। অনেক সময় বিভিন্ন প্রতিকূলতার মাঝেও ধার-দেনায় পুঁজি খাটিয়ে বাপ-দাদার এই পেশাকে আঁকড়ে ধরে রেখেছেন নকলা উপজেলার কয়েকশ’ বাঁশ শিল্পের কারিগর। তাদের তৈরি পণ্য রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলা-উপজেলা শহরে সরবরাহ করা হয়।
সরজমিনে নকলা পৌরসভার চরকৈয়া গ্রামের বাঁশ পণ্যের নির্মাতা মোবারক আলী, ফসি আলী ও আশিক মিয়া এবং বারমাইশা গ্রামের নান্টু চন্দ্র বিশ্বাস, জগদীস চন্দ্র বিশ্বাসসহ অনেকের সাথে কথা বলে জানা গেছে, রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন বিভাগীয় ও জেলা-উপজেলার পাইকাররা এখান থেকে বাঁশের তৈরি পণ্য কিনে নিয়ে নিজ এলাকায় বিক্রি করে সংসার চালান। এখানের শ্রমিকদের বাঁশের তৈরি পণ্যের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। তাদের তৈরি পণ্যসমূহের মধ্যে মই, চালুন. খাচা, ধান রাখার ডুলি ও মাচা, চালুন ও কুলার চাহিদা সবচেয়ে বেশি।
বাঁশ শিল্পী মোবারক আলী জানান, স্থানীয় বিভিন্ন বাজারের দিন প্রায় ৩ হাজার থেকে ৪ হাজার টাকা এবং অন্যান্য দিন বিভিন্ন এলাকা ঘুরে প্রায় এক হাজার থেকে ১ হাজার ৫০০ টাকার বাঁশ পণ্য বিক্রি করতে পারেন। অনেক সময় খুচরা বিক্রেতারা তাদের কাছ থেকে পণ্য কিনে নিয়ে বাজারে বাজারে বিক্রি করেন। তাই তাদের কাছে খুচরা দামের চেয়ে কিছুটা কমে বিক্রি করা হয়। নির্মাতাদের কাছ থেকে পণ্য কিনে নিয়ে তা বিক্রি করে যে লাভ পান। এমন খুচরা বিক্রেতাদের গড়ে দৈনিক লাভ থাকে ৫০০ থেকে ৮০০ টাকা। এ টাকাতেই তাদের ছেলে-মেয়ের শিক্ষা খরচসহ সংসারের সকল খরচ মেটাতে হয়।
আরেক বাঁশ শিল্পী জোসনা জানান, তাদের ছেলে মেয়রাও তাদের ছুটির দিন ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে এসে অবসর সময়ে সকাজে সহযোগিতা করে। তাতে বেশ কাজে লাগে। নতুবা বাড়তি সময় লাগত। একা একা সব কাজ করলে একজন যতটা পণ্য তৈরি করতে পারেন, ছেলে মেয়রা কাজে সহযোগিতা করায় প্রতিজন বাঁশ শিল্পী বা বাঁশ শ্রমিক দেড়গুণ কাজ করতে পারেন।
মই তৈরির শিল্পী ফসি আলী নিজের মতো করে অঞ্চলিক ভাষায় বলেন, ‘প্রতিডা চঙ্গ (মই) ছুডু গুনা ৪,০০ টেহা কইরা আর বড় গুনা ১ হাজার ১২০০ টেহা কইরা বেচুন যায়। একেকটা চঙ্গ বানাইতে ছুডু গুনা ৩,০০ টেহা আর বড় গুনা ৮শ’ থাইক্কা এক হাজার টেহা কইরা আঙ্গরে খরচ অয়। এতে যে নাভ অয় তা দিয়াই আঙ্গরে সংসার চালাইন নাগে। অহনত গিরস্তরা সব কিছু মেশিন দিয়াই কইরা হারে, তাই আগের মত মই, চালুন. খাচা, ডুলি, চালুন, কুলা এগুনা বেচাকেনা অয় না। আমরা আগের মত অহন নাভ পাই না। এই কারনে আঙ্গরে পুলাপানরে বেশি নেহাপড়া করাবার পাইনা। আঙ্গরে পোলাপান কোন চাকরি বাকরি করবার পায় না। আঙ্গরে পোলাপানগরেও সারাজীবনই কষ্ট করুন নাগবো।’
অন্য এক বাঁশ শিল্পী কালাম অঞ্চলিক ভাষায় বলেন, ‘আংগরে টেহা পয়সা কম, তাই বেশি কইরা বাঁশ কিনাবার পাই না। ছোডু একটা থাহার ঘর ছাড়া আংগরে তেমুন কিছুই নাই। সরকার যদি ব্যাংক থাইক্কা আংগরে এই কামের নাইগ্যা ঋণ দেওনের ব্যবস্থা করত তাইলে আমরা অনেক কিছু করবার পাইতাম। পোলাপানরে বালা কইরা নেহা পড়া করাবার পাইতাম। তাতে খালি আংগরে নাভ অইত না, সরকারেরও নাভ অইত।’
উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা মো. রোমান হাসান জানান, বাঁশ শিল্পকে টিকিয়ে রাখতে সমাজসেবা অধিদপ্তরের উদ্যোগে প্রান্তিক ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীর জীবন মান উন্নয়ন শীর্ষক প্রকল্পের মাধ্যমে বিভিন্ন গ্রামে কয়েক ধাপে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে। তাছাড়া সরকারের পক্ষ থেকে তাদের মাঝে নিয়মিত অনুদান ও আর্থিক সহায়তা প্রদান কর্মসূচি চালু আছে।