দিগন্ত বিস্তৃত হাওরাঞ্চলে ঢেউ খেলানো পাকা সোনালি বোরো ধান কাটার মহোৎসবে মেতে উঠেছেন কৃষকরা। আকাশে ছুটন্ত মেঘের ভেলা, পাখির কলতান, সারি সারি কুঁড়েঘর, হাওরের বুক চিরে বয়ে যাওয়া নরসুন্ধা নদীতে রাজহংসের জলকেলি ও শিশুদের দুরন্তপনায় চিরন্তন বাংলার প্রকৃতির রূপ যেন এখন কিশোরগঞ্জের তাড়াইল উপজেলার সাতটি ইউনিয়নে আছড়ে পড়েছে। বোরো ধান কাটার মৌসুমে প্রকৃতি যেন সেখানে স্বরূপে জেগে উঠেছে। কাকডাকা ভোর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত রোদে পুড়ে বৃষ্টিতে ভিজে কষ্ট করে ফলানো ফসল অনেকেই গোলায় তুলছেন। তাতে সব কষ্ট ভুলে কৃষান-কৃষানিরা হাসছেন তৃপ্তির হাসি। এ বছর খরা এবং শিলা বৃষ্টি না হওয়ায় কৃষকরা বোরো চাষ নির্বিঘ্নে করতে পারছেন। কিন্তু অনেক সময় অনাবৃষ্টি ও অকাল বন্যায় পুরো চিত্রই পাল্টে যায়।
উপজেলা কৃষি অফিস সূত্রে জানা যায়, চলতি ইরি-বোরো মৌসুমে উপজেলার সাতটি ইউনিয়নে ১০ হাজার ৩৩০ হেক্টর জমিতে বোরো ধান আবাদের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল। গতকাল বুধবার সরেজমিন দেখা যায়, উপজেলার সাতটি ইউনিয়নে বোরো ধানের বাম্পার ফলন হয়েছে। গত ১ সপ্তাহ ধরে ধান কাটতে শুরু করেছেন স্থানীয় কৃষকরা। তবে শ্রমে-ঘামে ফলানো এই ধান নিয়ে বাজারে কৃষকের সেই হাসিমুখ একেবারে মলিন হয়ে যাচ্ছে। বুক চিরে বেরিয়ে আসছে দীর্ঘশ্বাস। হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রমে ধানের বাজারমূল্য উৎপাদিত খরচের চেয়ে কম থাকায় কৃষক দিশাহারা। প্রতি বছর লোকসান গুনতে গুনতে কৃষকরা তাদের কৃষি কাজে আস্থা হারিয়ে ফেলছেন। আর তাতে দেশের খাদ্য নিরাপত্তা হুমকিতে পড়তে পারে বলে কৃষিবিদরা মনে করছেন। তাই বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ মতে কৃষিকে বাঁচাতে হলে কৃষককে বাঁচাতে হবে। আর সে ধানের ন্যায্যমূল্য দিতে প্রয়োজনে সরকারকে এ খাতে প্রণোদনা দিতে হবে। এক মণ ধানের মূল্যে মিলছে একজন শ্রমিক। দফায় দফায় বিদ্যুতের মূল্য বৃদ্ধি এবং কৃষি শ্রমিকের মজুরি বৃদ্ধির কারণে উৎপাদন ব্যয় বেড়েছে কৃষকের। তাছাড়া চলতি মৌসুমে নদীনালায় পানি না থাকা ও সেচে বেশি খরচ হওয়ায় উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধির অন্যতম কারণ। কৃষকদের সংসার চালানোর যাবতীয় সব খরচ এই বোরো ধান বিক্রি করে চলে। তাই গোলায় ধান ওঠার সঙ্গে সঙ্গে তাদের ধারদেনা পরিশোধ, পরিবারের সদস্যদের জন্য জামা-কাপড় কেনাসহ অন্যান্য প্রয়োজনে ধান বিক্রি করতে হয়। কিন্তু বাজারে ধান বিক্রি করতে গেলেই তাদের মুখের হাসি মলিন হয়ে যায়। হতাশায় বেরিয়ে আসে দীর্ঘশ্বাস। বর্তমানে বাজারে মোটা জাতের ধান বিক্রি হচ্ছে ৯০০ থেকে ৯৫০ টাকা মণ। আর বিআর ২৯ জাতের চিকন ধান বিক্রি হচ্ছে ১০০০ থেকে ১০৫০ টাকা মণ। প্রতিমণ ধানের উৎপাদন খরচ ১২০০ টাকা, বাজারে বিক্রি হচ্ছে প্রতিমণে কৃষকের লোকসান ৩০০ থেকে ৩৫০ টাকা।
স্থানীয় কয়েকজন কৃষকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, শুধু ধান কাটা ও খলায় পৌঁছানো পর্যন্ত পারিশ্রমিক হিসেবে শ্রমিকদের ১০ শতাংশ থেকে ১২ শতাংশ ধান দিতে হয়। অর্থাৎ ১০০ বস্তা ধানের জন্য দেয়া হয় ১০-১২ বস্তা। আবার ধান মাড়াইয়ের জন্য ১০০ বস্তায় দিতে হয় ৫-৭ বস্তা। নগদ টাকায় ধান কাটলে দিতে হয় ৯০০-১ হাজার টাকা। প্রকারভেদে অর্থাৎ দূরের জমি থেকে কেটে আনলে দিতে হয় জনপ্রতি ১২শ’ টাকা প্রতিদিনের মুজুরি। এছাড়া জমিতে চারা রোপণ, সার, কীটনাশক দেওয়ায় প্রচুর খরচ করতে হয়। উপজেলার তালজাঙ্গা ইউনিয়নের আড়াইউড়া গ্রামের কৃষক নব কুমার তালুকদার জানান, এক বিঘা জমিতে উৎপাদিত ধানের মূল্যের সমান আমার খরচ হয়েছে। তাছাড়া খাদ্য গুদামে আমাদের মতো কৃষকরা ধান দিতে পারে না কখনও। এক শ্রেণির লোক ওখানে সুবিধা পায়। ওইসব সুবিধাভোগী লোকদের সুবিধা দিতে পারলেই ধান দেওয়া যায় খাদ্যগুদামে। একই সুরে কথা বলেন তাড়াইল-সাচাইল (সদর) ইউনিয়নের সহিলাটি গ্রামের কৃষক শাহাব উদ্দীন এবং কালনা গ্রামের কৃষক হাবিবুর রহমান।
তাড়াইল উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা বিকাশ রায় বলেন, খরা, কালবৈশাখি ঝড়, শিলাবৃষ্টিতে এবছর বোরো ধানের ক্ষতির কোনো সম্ভাবনা নেই। তাছাড়া সেচ, সার সরবরাহ ও কৃষি উপকরণ সহজলভ্য হওয়ায় এবার বাম্পার ফলন হয়েছে। তিনি আরও বলেন, কৃষিনির্ভর উপজেলায় মানুষ একমাত্র বোরো ফসলের ওপর নির্ভরশীল। তাই বোরো ধান তোলার সময় কৃষক পরিবারের সব সদস্য মিলে আনন্দের মধ্য দিয়ে গোলায় ধান তোলেন।