টানা ভারী বৃষ্টি ও ভারতীয় ঢলে দেশের দক্ষিণ পূর্বাঞ্চল ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলে আবারও বন্যার শঙ্কা দেখা দিয়েছে। এরইমধ্যে ফেনী জেলায় বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের ১৪টি স্থান ভেঙে গেছে। এর ফলে ৩০টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। ঘরবাড়ি তলিয়ে যাওয়ায় মানুষ অন্যত্র আশ্রয় নিচ্ছে। এছাড়া ভারী বৃষ্টিতে দেশের বিভিন্ন জেলায় রাস্তা-ঘাট তলিয়ে গেছে। অনেক স্থানে যোগাযোগ ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। প্রবল বর্ষণে ভেসে গেছে হাজার হাজার পুকুর ও মাছের ঘের। তলিয়ে গেছে ফসলি জমি। সব মিলিয়ে জনদুর্ভোগ চরম পর্যায়ে পৌঁছেছে। বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ ভাঙনের কারণে একের পর এক প্লাবিত হচ্ছে নতুন নতুন এলাকা। গতকাল বৃহস্পতিবার সকাল পর্যন্ত পরশুরামে বন্যার পানি কমে এলেও ছাগলনাইয়া, ফেনী সদর উপজেলায় বন্যার পানি বাড়তে শুরু করে। ফুলগাজী উপজেলায় বন্যা পরিস্থিতিতে তেমন কোনো পরিবর্তন হয়নি। এদিকে পরশুরামের পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন এলাকায় ক্ষয়ক্ষতি দৃশ্যমান হতে শুরু করেছে।
স্থানীয়রা জানান, গত বুধবার বিকাল থেকেই চিথলিয়া ইউনিয়নে বন্যার পানি কমতে শুরু করে। এরই মধ্যে এসব এলাকা থেকে বন্যার পানি নেমে ফুলগাজী হয়ে ছাগলনাইয়া ও ফেনী সদরের দিকে চলে যাচ্ছে। এত করে পরশুরামে বন্যায় বাড়িঘর ও রাস্তাঘাটের ক্ষয়ক্ষতি দৃশ্যমান হতে শুরু করেছে। ধনীকুন্ডা এলাকায় বন্যায় ভেসে আসা বসতবাড়ি টিনের সেড পড়ে আছে। পানি গড়িয়ে যাওয়ার পর ক্ষতিগ্রস্ত রাস্তা এবং জমিতে থাকা বালুর স্তর স্থানীয়দের মাথায় চিন্তার ভাজ ফেলেছে।
এদিকে ছাগলনাইয়া ও ফেনী সদর উপজেলার বিভিন্ন এলাকা প্লাবিত হতে শুরু করেছে। ফুলগাজী ও পরশুরাম থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলের পানিতে ফেনী সদর উপজেলার কাজীরবাগ, মোটবী, ফাজিলপুর ইউনিয়নের বিভিন্ন এলাকা নিমজ্জিত হয়ে পড়েছে। ফেনী ছাগলনাইয়া সড়কের ওপর দিয়ে পানি গড়িয়ে যাওয়ায় রাস্তা বন্ধ হওয়ার উপক্রম। ফেনী আঞ্চলিক আবহাওয়া অফিসের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. মজিবুর রহমান বলেন, গত ২৪ ঘণ্টায় ফেনীতে ৫০ দশমিক ৫ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়। তবে ফেনীতে বৃষ্টির পরিমাণ কমে আসায় বন্যা পরিস্থিতি উন্নতির দিকে যাচ্ছে। ফেনী জেলা প্রশাসক মো. সাইফুল ইসলাম বলেন, ফুলগাজী, পরশুরাম, ছাগলনাইয়া ও ফেনী সদর উপজেলার একাংশ এরই মধ্যে প্লাবিত হয়েছে। বন্যা কবলিত এলাকার মানুষকে প্রশাসন ও স্বেচ্ছাসেবকরা আশ্রয়কেন্দ্রে পৌঁছে দিতে কাজ করছেন। ভারতীয় পানি আগ্রাসনের ফলে গতবছর ২১ আগস্ট দেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের ১২টি জেলা স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যায় প্লাবিত হয়। সেই দুঃসহ স্মৃতি এখনও তাদের তাড়িয়ে বেড়ায়। স্মরণকালের ওই ভয়াবহ বন্যায় প্লাবিত হয়েছিল ফেনী, নোয়াখালী, লক্ষীপুর, চট্টগ্রাম, খাগড়াছড়ি, রাঙামাটি, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, চাঁদপুর, কুমিল্লা ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা। তাতে অন্তত ৫০ লাখ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। বন্যায় ওইসব জেলার হাজার হাজার মাছের ঘের ও পুকুরের মাছ ভেসে গিয়েছিল। তলিয়ে গিয়েছিল কৃষকের ফসলি জমি। এবারও সেই ভয়াবহ বন্যার পদধ্বনি শুনতে পাচ্ছে ফেনী, নেয়াখালি, কুমিল্লা, চট্টগ্রামসহ দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের আরও কয়েকটি জেলার মানুষ।
বাংলাদেশে সাধারণত উত্তর-পূর্বাঞ্চলের জেলাগুলোতে প্রতি বছরই বন্যা দেখা দেয়। কিন্তু দক্ষিণ পূর্বাঞ্চলের মানুষ এর আগে কখনো এমন বন্যা দেখেনি। ফলে বন্যার সেই দুর্বিষহ স্মৃতি মনে হলে এখনও তারা আঁতকে উঠে। গতবছরের ভয়াবহ বন্যার পর ওই অঞ্চলে বন্যার্তদের পুনর্বাসন এখনও সম্পন্ন হয়নি। সরকারিভাবে বন্যা নিয়ন্ত্রণেরও কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। নদী দখলমুক্ত করা হয়নি, খাল খনন করা ও ড্রেনেজ ব্যবস্থা ঠিক করা হয়নি। এতে ভারী বৃষ্টিপাতের ফলে তলিয়ে যাচ্ছে রাস্তা-ঘাট। সাধারণ মানুষ এতে ক্ষোভ প্রকাশ করছে। এবারও টানা ভারী বর্ষণ ও ভারতীয় ঢলে যে ভাবে পানি বাড়ছে তাতে ফেনী, নোয়াখালী, কুমিল্লা এসব অঞ্চলের মানুল আবার বন্যার আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছে।
এদিকে দেশের উত্তরাঞ্চলে বন্যার পূর্বাভাস পাওয়া গেছে। আগামী ২৪ ঘণ্টায় তিস্তা নদীর পানি বেড়ে সতর্কসীমায় প্রবাহিত হতে পারে এবং রংপুর, নীলফামারী, কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট জেলার নদীসংলগ্ন নিম্নাঞ্চল সাময়িকভাবে প্লাবিত হতে পারে। গতকাল বৃহস্পতিবার পানি উন্নয়ন বোর্ডের বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র নদ-নদীর পরিস্থিতি ও পূর্বাভাসে এসব জানিয়েছে। পূর্বাভাস আরও বলা হয়েছে, তিস্তা, ধরলা ও দুধকুমার নদীসমূহের পানি সমতল বৃদ্ধি পাচ্ছে। তবে নদীসমূহ বিপৎসীমার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। আগামী ২ দিন উক্ত নদীসমূহের পানি সমতল বৃদ্ধি পেতে পারে এবং পরবর্তী ১ দিন পর্যন্ত পানি সমতল স্থিতিশীল থাকতে পারে।
সুরমা নদীর পানি সমতল স্থিতিশীল আছে, অন্যদিকে কুশিয়ারা নদীর পানি সমতল বৃদ্ধি পাচ্ছে। তবে বিপৎসীমার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। আগামী ২৪ ঘণ্টায় কুশিয়ারা নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়ে সতর্কসীমায় প্রবাহিত হতে পারে এবং সিলেট জেলার নদীসংলগ্ন নিম্নাঞ্চল সাময়িকভাবে প্লাবিত হতে পারে বলে জানায় বন্যা পূর্বাভাস কেন্দ্র। এছাড়া গঙ্গা-পদ্মা নদীসমূহের পানি সমতল বৃদ্ধি পাচ্ছে; যা আগামী ৫ দিন পর্যন্ত অব্যাহত থাকতে পারে। এই সময়ে নদীসমূহ বিপৎসীমার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হতে পারে।