ঢাকা রোববার, ১৪ ডিসেম্বর ২০২৫, ২৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

কাতারে ইসরায়েলি হামলায় নিহত ৬, অক্ষত হামাস নেতা

* হামলাকে ‘কাপুরুষোচিত’ অভিহিত করে কাতারের নিন্দা * ইসরায়েলি হামলা সত্ত্বেও গাজায় মধ্যস্থতা চালিয়ে যাবে কাতার * কাতারে ইসরায়েলি হামলার ঘটনায় ‘খুবই অসন্তুষ্ট’ ট্রাম্প * বিশ্বজুড়ে নিন্দার ঝড় * হামলার ব্যাপারে কাতারকে আগেই সতর্ক করেছিল হোয়াইট হাউস * হামলার নিন্দা জানাল বাংলাদেশ
কাতারে ইসরায়েলি হামলায় নিহত ৬, অক্ষত হামাস নেতা

কাতারের দোহায় ইসরাইলের বিমান হামলায় অন্তত ৬ জন নিহত হয়েছে যার পাঁচজনই ফিলিস্তিনের গাজা নিয়ন্ত্রণকারী সশস্ত্র রাজনৈতিক গোষ্ঠী হামাসের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। তবে, এই হামলায় হামাস লিডারের কোনো ক্ষতি হয়নি। হামলার পর এক বিবৃতিতে এ তথ্য জানিয়েছে হামাস। বিবিসির প্রতিবেদন থেকে এসব তথ্য জানা গেছে।

বাকি যে একজন নিহত হয়েছেন, তিনি কাতারের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্য ছিলেন। কাতারের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, হামলায় ৬ জন নিহত ও বেশ কয়েকজন আহতও হয়েছেন। তবে, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিবৃতিতে নিহতের মোট সংখ্যা জানানো হলেও হামাসের নাম উল্লেখ করা হয়নি।

এর আগে গত মঙ্গলবার স্থানীয় সময় বিকেলে কাতারের আবাসিক এলাকায় বিমান হামলা চালায় ইসরাইলের প্রতিরক্ষা বাহিনী (আইডিএফ)।

হামাসের বিবৃতিতে এ হামলার নিন্দা জানিয়ে বলা হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের পাঠানো খসড়া যুদ্ধবিরতি পরিকল্পনা নিয়ে কাতারের আবাসিক এলাকার যে ভবনে বৈঠকে বসেছিলেন গোষ্ঠীটির নেতারা, সেই ভবনটিকে লক্ষ্যবস্তু করেছে ইসরাইলি সেনাবাহিনী।

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, ৮ টি বিস্ফোরণের শব্দ শুনেছেন তারা। হামাসের শীর্ষ নেতা ও মুখপাত্র খলিল আল হায়া এবং হামাস পশ্চিম তীর শাখার নেতা জাহের জাবারিনকে হত্যার উদ্দেশে এ হামলা পরিচালনা করা হয়েছিল বলে জানা গেছে।

এদিকে কাতারের রাজধানী দোহায় হামাসের শীর্ষ নেতাদের লক্ষ্য করে চালানো ইসরাইলি হামলাকে ‘কাপুরুষোচিত’ আখ্যা দিয়ে তীব্র নিন্দা জানিয়েছে দেশটি। এক বিবৃতিতে কাতার জানায়, এ ধরনের হামলা আন্তর্জাতিক আইন ও নীতিমালার স্পষ্ট লঙ্ঘন এবং দোহাসহ কাতারে বসবাসরত মানুষের নিরাপত্তা ও সুরক্ষার জন্য মারাত্মক হুমকি।

কাতারের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, ঘটনাটির পরপরই নিরাপত্তা বাহিনী, সিভিল ডিফেন্স ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ দ্রুত পদক্ষেপ নিয়েছে এবং রাজধানী দোহা ও আশপাশের এলাকায় বাসিন্দাদের নিরাপত্তা নিশ্চিতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে।

রাষ্ট্রীয়ভাবে কাতার আরও জানায়, তারা ইসরাইলের এ অবিবেচক কর্মকাণ্ড ও আঞ্চলিক নিরাপত্তার প্রতি চলমান হস্তক্ষেপ সহ্য করবে না। একই সঙ্গে কাতারের নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্বের বিরুদ্ধে যেকোনো আক্রমণাত্মক পদক্ষেপ গ্রহণযোগ্য হবে না বলেও স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছে দেশটি। কাতারে ইসরায়েলের প্রাণঘাতী বিমান হামলার পরেও গাজায় যুদ্ধবিরতি ও জিম্মিদের মুক্তির জন্য মধ্যস্থতার চেষ্টা চালিয়ে যাবে কাতার, এমনটাই জানিয়েছেন কাতারের প্রধানমন্ত্রী শেখ মোহাম্মদ বিন আবদুল রহমান আল থানি।

কাতারের প্রধানমন্ত্রী ইসরায়েলি হামলাকে ‘এই অঞ্চলের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত’ হিসেবে আখ্যায়িত করেন এবং বলেন, প্রকাশ্য এই আগ্রাসনের বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া জানানোর অধিকার কাতারের আছে।

তিনি আরো বলেন, ‘আমাদের অঞ্চলজুড়ে বিভিন্ন বিষয়ে মধ্যস্থতা চালিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে কিছুই আমাদের থামাতে পারবে না।

এর আগে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দেওয়া এক বিবৃতিতে ট্রাম্প লিখেছেন, হামলার ঠিক আগে মার্কিন সেনারা তাঁর প্রশাসনকে এ ব্যাপারে সতর্ক করেছে। তবে এ সতর্কবার্তা ইসরায়েলের কাছ থেকেই এসেছে কি না, তা তিনি বলেননি।

ট্রাম্প আরও লিখেছেন, ‘সার্বভৌম রাষ্ট্র ও যুক্তরাষ্ট্রের ঘনিষ্ঠ মিত্র দেশ কাতার শান্তিপ্রতিষ্ঠার চেষ্টায় মধ্যস্থতার জন্য অত্যন্ত কঠোর পরিশ্রম এবং ঝুঁকি নিয়ে কাজ করছে। দেশটির অভ্যন্তরে একতরফাভাবে বোমা হামলা চালিয়ে ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রের লক্ষ্যকে এগিয়ে নেওয়া যাবে না।’

ট্রাম্প বলেন, তিনি তাঁর দূত স্টিভ উইটকফকে নির্দেশ দিয়েছিলেন, যেন কাতারকে হামলার আগাম সতর্কতা দেওয়া হয়। তবে কাতার বলছে, হামলার আগে তাদের সতর্কবার্তা দেওয়ার খবর মিথ্যা। একজন মার্কিন কর্মকর্তা ফোন দিয়েছেন ঠিকই, তবে ততক্ষণে দোহায় বিস্ফোরণের শব্দ শোনা যাচ্ছিল।

ইসরায়েলি কর্মকর্তারা রয়টার্সকে বলেছেন, খলিল আল-হায়াসহ হামাসের শীর্ষ নেতারা এই হামলার লক্ষ্য ছিলেন। এক ব্যক্তি রয়টার্সকে বলেছেন, ইসরায়েল এখনো হামলার তথ্য সংগ্রহ করছে ও হামলায় কোনো হামাস নেতা বা কর্মকর্তা মারা গেছেন কি না, তা এখনো ঠিক জানা যায়নি।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দুই মার্কিন কর্মকর্তা রয়টার্সকে বলেন, ইসরায়েল হামলার ঠিক আগে মার্কিন সেনাদের জানিয়েছিল। কিন্তু ওয়াশিংটনের সঙ্গে আগে থেকে এ ব্যাপারে কোনো সমন্বয় করা হয়নি বা ওয়াশিংটন থেকে অনুমোদন দেওয়া হয়নি।

এ ঘটনায় মধ্যপ্রাচ্য অঞ্চল ও বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ও সংস্থার নেতারা তীব্র নিন্দা জানিয়ে একে আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন, কাতারের সার্বভৌমত্বে হস্তক্ষেপ এবং আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার জন্য হুমকি হিসেবে চিহ্নিত করেছেন অনেক দেশ ।

ইরান: ইরান এ হামলাকে ‘বিপজ্জনক’ এবং আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন আখ্যা দিয়ে আঞ্চলিক শান্তিকে বিপন্নকারী পদক্ষেপ অবিলম্বে বন্ধ করার আহ্বান জানায়।

এক বিবৃতিতে দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র ইসমাইল বাঘাই বলেন, ‘অত্যন্ত বিপজ্জনক ও অপরাধমূলক এই পদক্ষেপ আন্তর্জাতিক সব আইন ও বিধিনিষেধের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। এটি কাতারের জাতীয় সার্বভৌমত্ব ও ভৌগোলিক অখণ্ডতায় হস্তক্ষেপ’।

ইয়েমেন: ইয়েমেন এই হামলাকে কাতারের সার্বভৌমত্বের লঙ্ঘন ও আঞ্চলিক কূটনীতিকে ক্ষতিগ্রস্তকারী ঘটনা বলে উল্লেখ করে আরব দেশগুলোকে ইসরাইলি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানায়।

ইয়েমেনের সুপ্রিম পলিটিক্যাল কাউন্সিলের চেয়ারম্যান মাহদি আল-মাশাত সতর্ক করে বলেন, ‘যদি আমরা সবাই মিলে জায়নিস্ট হুমকির মোকাবিলা না করি, তাহলে দোহায় যা ঘটেছে, তা আবার ঘটবে এবং বাকি দেশগুলোতেও ঘটতে থাকবে’।

সৌদি আরব: সৌদি আরব এই হামলাকে ‘ভ্রাতৃপ্রতীম কাতার রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বের প্রকাশ্য লঙ্ঘন’ বলে উল্লেখ করেছে এবং ইসরাইলের অব্যাহত আগ্রাসনের ‘গুরুতর পরিণতির’ বিষয়ে সতর্ক করেছে।

পাকিস্তান: পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফ এ আক্রমণকে ‘অযৌক্তিক ও আগ্রাসী সার্বভৌমত্ব লঙ্ঘন’ হিসেবে নিন্দা করেছেন। তিনি কাতারের জনগণ ও নেতৃত্বের প্রতি গভীর সহানুভূতি প্রকাশ করে বলেন, পাকিস্তান সবসময় ফিলিস্তিনি সংগ্রামের পাশে থাকবে।

ইরাক: ইরাকও এ হামলাকে ‘কাপুরুষোচিত কর্মকাণ্ড’ আখ্যা দিয়ে কাতারের প্রতি পূর্ণ সমর্থন পুনর্ব্যক্ত করেছে এবং আঞ্চলিক শান্তি ও নিরাপত্তার প্রতি তাদের অঙ্গীকারের কথা জানিয়েছে।

তুরস্ক: তুরস্ক বলেছে, এই হামলা প্রমাণ করে ইসরাইল গাজার গণহত্যার সমাধানে কোনো আগ্রহ রাখে না। আঙ্কারা অবিলম্বে যুদ্ধবিরতি এবং কূটনৈতিক আলোচনায় ফেরার আহ্বান জানিয়েছে।

জর্ডান: জর্ডানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আয়মান সাফাদি এ আক্রমণকে আন্তর্জাতিক আইন ও জাতিসংঘ সনদের প্রকাশ্য লঙ্ঘন আখ্যা দেন। তিনি বলেন, ‘এটি ইসরাইলের বর্বর আগ্রাসনের ধারাবাহিকতা, যা আঞ্চলিক স্থিতিশীলতাকে হুমকির মুখে ফেলছে’।

সংযুক্ত আরব আমিরাত (ইউএই): ইউএই বিমান হামলাকে ‘বিশ্বাসঘাতক ইসরাইলি হামলা’ বলে নিন্দা জানিয়েছে। দেশটি একে ‘প্রকাশ্য ও কাপুরুষোচিত’ আখ্যা দিয়ে দেশগুলোর জাতীয় সার্বভৌমত্বের প্রতি সম্মান এবং আন্তর্জাতিক আইন মেনে আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখার আহ্বান জানিয়েছে।

আরব লীগ: আরব লীগ বলেছে, কাতারের সার্বভৌমত্বের এই লঙ্ঘন আঞ্চলিক স্থিতিশীলতাকে বিপন্ন করছে। সংস্থাটি ভবিষ্যতে এমন আগ্রাসন ঠেকাতে যৌথ পদক্ষেপের আহ্বান জানিয়েছে।

মালদ্বীপ: মালদ্বীপের প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ মুইজ্জু এ বিমান হামলাকে ‘আন্তর্জাতিক আইন ও সার্বভৌমত্বের গুরুতর লঙ্ঘন’ বলে আখ্যা দিয়েছেন।

তিনি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে দ্রুত ও ঐক্যবদ্ধ পদক্ষেপ নিয়ে ইসরাইলকে জবাবদিহির মুখোমুখি করার আহ্বান জানান।

পোপ লিও চতুর্দশ: ভ্যাটিক্যানের পোপ লিও চতুর্দশও কাতারে ইসরাইলের বিমান হামলা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। তিনি বলেন, পরিস্থিতি ‘অত্যন্ত গুরুতর’ এবং এর ফলে আঞ্চলিক অস্থিরতার ঝুঁকি আরও বাড়বে।

ইসরাইলের হামলার ব্যাপারে কাতারকে আগেই সতর্কবার্তা দেওয়া হয়েছিল বলে দাবি করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের সরকারি বাসভবন হোয়াইট হাউসের প্রেস সেক্রেটারি ক্যারোলিন লিভিট।

গত মঙ্গলবার হোয়াইট হাউসে এক সংবাদ ব্রিফিংয়ে লিভিট বলেন, ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু এ হামলার ব্যাপারে আগে জানিয়েছিলেন। নেতানিয়াহু বলেছিলেন, তিনি শান্তি স্থাপন করতে চান এবং তা শিগগিরই চান। তাই আমাদের কাছে আগে থেকেই এ হামলার খবর ছিল। নেতানিয়াহুর সঙ্গে কথা বলার পর তাৎক্ষণিকভাবে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প স্টিফ উইটকফের মাধ্যমে দোহাকে আসন্ন হামলার ব্যাপারে সতর্কবার্তা দিয়েছিলেন।

কাতারে চালানো ইসরাইলি সামরিক হামলার নিন্দা জানিয়েছে বাংলাদেশ সরকার। একইসঙ্গে এ বিষয়ে জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক মহলের কার্যকর পদক্ষেপের আহ্বান জানানো হয়েছে। গতকাল বুধবার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে পাঠানো এক প্রেস বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে এ নিন্দা জানানো হয়।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত