ঢাকা রোববার, ১৪ ডিসেম্বর ২০২৫, ২৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

ক্ষুধা ভয় ও অশ্রুর জীবন

রোহিঙ্গা শিবির থেকে ভেসে আসছে আর্তনাদ
ক্ষুধা ভয় ও অশ্রুর জীবন

জাতিসংঘের আসন্ন উচ্চপর্যায়ের সম্মেলনের আগে কক্সবাজারের রোহিঙ্গা শিবিরগুলো থেকে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে রোহিঙ্গাদের করুণ কণ্ঠস্বর। চিকিৎসাসেবামূলক আন্তর্জাতিক সংস্থা ডক্টরস উইদাউট বর্ডারস-মেডিসিনস স্যান্স ফ্রন্টিয়ারস (এমএসএফ)-এর সাম্প্রতিক এক জরিপ প্রতিবেদনে উঠে এসেছে আট বছর ধরে অনিশ্চিত জীবনযাপনে থাকা লাখো রোহিঙ্গার হতাশা, ভয় ও বঞ্চনার বাস্তবতা।

এমএসএফ-এর কমিউনিকেশন অফিসার তানিয়া সুলতানা জানান, এই জরিপ পরিচালিত হয় গত ২৬ আগস্ট থেকে ২ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত। কক্সবাজারের চারটি এমএসএফ চিকিৎসাকেন্দ্রে সেবা নিতে আসা ৪২৭ জন রোহিঙ্গার সঙ্গে আলোচনা করে তথ্য সংগ্রহ করা হয়। তাদের মধ্যে পুরুষ ছিলেন ৪৬ শতাংশ এবং নারী ৫৪ শতাংশ।

জরিপে দেখা গেছে, বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ রোহিঙ্গা শরণার্থী বর্তমান পরিস্থিতিতে মিয়ানমারে ফিরে যেতে নিরাপদ বোধ করেন না। শিবিরে অবস্থানরত অনেকেই নিজেদেরই অনিরাপদ মনে করেন। অধিকাংশই স্বাস্থ্যসেবা প্রাপ্তির ক্ষেত্রে ক্রমবর্ধমান সমস্যার কথা জানিয়েছেন। জাতিসংঘের আলোচনার মতো গুরুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক প্রক্রিয়া সম্পর্কেও তারা খুব বেশি জানেন না; মাত্র এক-তৃতীয়াংশ শরণার্থী আসন্ন সম্মেলন সম্পর্কে অবগত ছিলেন এবং তাদের অধিকাংশই অনানুষ্ঠানিকভাবে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের মাধ্যমে তা জেনেছেন।

এই জরিপে অংশ নেওয়া শরণার্থীদের অনেকেই তাদের ভয়াবহ অভিজ্ঞতার কথা বর্ণনা করেছেন। বিশেষ করে যারা ২০২৪ সালে রাখাইন থেকে বাস্তুচ্যুত হয়ে বাংলাদেশে এসে আশ্রয় নিয়েছেন, তাঁদের বর্ণনা যেন একেকটি রক্তক্ষয়ী ইতিহাস। উত্তর রাখাইন থেকে পালিয়ে আসা এক নারী কণ্ঠরুদ্ধ হয়ে জানান, কীভাবে ড্রোন হামলায় তার মেয়ে নিহত হয় এবং তিনিও গুরুতর আহত হন। মৃত ভেবে তাকে ফেলে যাওয়া হয়েছিল। ঘণ্টার পর ঘণ্টা মেয়ের লাশের পাশে পড়ে থেকে পরে কোনোভাবে বেঁচে যান তিনি। সেই ভয়ের স্মৃতি আজও তাকে তাড়া করে বেড়ায়।

অন্যদিকে, শিবিরে অবস্থানরত অনেক রোহিঙ্গাই জানিয়েছেন, ভবিষ্যতের অনিশ্চয়তায় তারা দিশেহারা। একজন শরণার্থী বলেন, ‘যদি আমাকে জিজ্ঞাসা করেন বার্মায় ফিরতে চাই কি না, আমি ফিরতে চাই না। আমার সন্তানদের ভবিষ্যতের জন্য আমি শিক্ষা চাই। আমার কিছু নেই, কিন্তু আমি চাই- অন্তত আমার সন্তানরা শিক্ষিত হোক। এখানে শিক্ষার কোনো আশা নেই।’

এমএসএফ আঞ্চলিক অপারেশনাল ডিরেক্টর পল ব্রকম্যান মনে করেন, শরণার্থী শিবিরগুলোতে রোহিঙ্গাদের অনিরাপত্তা প্রতিদিনের জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে প্রভাব ফেলছে। অসুস্থ সন্তানকে রাতে ক্লিনিকে নেওয়া সম্ভব হবে কিনা, কিংবা যে আশ্রয়ে তাঁরা থাকেন তা সহিংসতা থেকে সুরক্ষিত কি না- এসব মৌলিক প্রশ্নই তাঁদের প্রতিদিনের বাস্তবতা। পরিস্থিতি আরও খারাপ হচ্ছে কারণ দাতাদের অর্থায়ন উল্লেখযোগ্য হারে কমে গেছে, ফলে মৌলিক পরিষেবাগুলো হুমকির মুখে পড়েছে।

জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক হাই কমিশনার (ইউএনএইচসিআর)-এর হিসাব অনুযায়ী, শুধু জুলাই ২০২৫ পর্যন্ত অন্তত ১ লাখ ৫০ হাজার নতুন রোহিঙ্গা বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। যদিও প্রকৃত সংখ্যা এর চেয়ে অনেক বেশি হতে পারে, কারণ অনেকেই অনানুষ্ঠানিকভাবে শিবিরে বা বাইরে বসবাস করছে। এই নতুন ঢল আসছে রাখাইনে ক্রমবর্ধমান সহিংসতার কারণে, যা দীর্ঘদিন ধরে রোহিঙ্গাদের ভবিষ্যৎকে আরও অন্ধকার করে তুলছে।

আগামী ৩০ সেপ্টেম্বর নিউইয়র্কে জাতিসংঘের উচ্চপর্যায়ের সম্মেলনে মিয়ানমারের রোহিঙ্গা মুসলিম ও অন্যান্য সংখ্যালঘুদের সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা হবে।

কিন্তু শরণার্থীদের আশঙ্কা, তাদের দুর্দশার প্রকৃত চিত্র এবং দাবি সেখানে যথাযথভাবে প্রতিফলিত নাও হতে পারে। একজন শরণার্থী বলেন, “আমরা মর্যাদা ও সমতা নিয়ে একটি শান্তিপূর্ণ জীবন চাই। আমরা নাগরিকত্ব, নিরাপত্তা, আমাদের বাড়ি ও পরিচয়সহ প্রত্যাবাসন চাই।”

পল ব্রকম্যান আরও বলেন, কক্সবাজারে ৮ বছর ধরে অনিশ্চয়তায় থাকার পর রোহিঙ্গাদের মানবিক পরিস্থিতি এখনও অস্থিতিশীল। তাদের আশা ও মানসিক শক্তি ক্রমেই ক্ষয়ে যাচ্ছে। এমএসএফ মনে করে, রোহিঙ্গাদের কণ্ঠস্বরকে আন্তর্জাতিক আলোচনার কেন্দ্রে রাখতে হবে। শুধু আশ্রয় নয়, বরং নিরাপত্তা, অধিকার এবং মর্যাদা সহকারে স্বেচ্ছায় প্রত্যাবর্তনের সুযোগ নিশ্চিত করতে হবে। রোহিঙ্গাদের শেষ আহ্বান তাই স্পষ্ট- তারা একটি টেকসই ভবিষ্যৎ চায়, যেখানে শিক্ষা, মর্যাদা, নিরাপত্তা ও নাগরিকত্বের নিশ্চয়তা থাকবে। কারণ শান্তিপূর্ণ ও সম্মানজনক জীবনের অধিকার প্রত্যেক মানুষেরই রয়েছে।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত