
মিয়ানমার থেকে জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী ও তাদের আশ্রয়দাতা কক্সবাজারের স্থানীয়দের জন্য মৌলিক অবকাঠামো এবং জরুরিসেবার জন্য ৫৮.৬ মিলিয়ন ডলারের এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ফান্ড (এডিএফ) অনুদান এবং ২৮.১ মিলিয়ন ডলারের স্বল্পসুদে একটি ঋণের চুক্তি স্বাক্ষর করেছে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) ও বাংলাদেশ সরকার। এডিবি সবচেয়ে দরিদ্র ও ঝুঁকিপূর্ণ উন্নয়নশীল সদস্য দেশগুলোকে এডিএফ অনুদান দিয়ে থাকে। গতকাল সোমবার অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি) সচিব মো. শাহরিয়ার কাদের ছিদ্দিকী এবং এডিবির কান্ট্রি ডিরেক্টর হোয়ে ইউন জিয়ং বাংলাদেশ ও এডিবির পক্ষে চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন। ঢাকায় ইআরডি কার্যালয়ে চুক্তি স্বাক্ষর অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। এডিবির কান্ট্রি ডিরেক্টর হোয়ে ইউন জিয়ং বলেন, মিয়ানমারের বাস্তুচ্যুত ও তাদের আশ্রয়দাতা স্থানীয়দের স্থিতিশীলতা ও জীবিকা নির্বাহের সুযোগ জোরদারে বাংলাদেশকে সহায়তা করতে পেরে আমরা আনন্দিত। শরণার্থী শিবিরগুলোর বাসিন্দা ও স্থানীয় জনগোষ্ঠীর মধ্যে সামাজিক সংহতি বৃদ্ধি করছি। তিনি আরও বলেন, নতুন এই অনুদান জরুরি সহায়তা প্রকল্পের অধীনে আমাদের পূর্ববর্তী সহায়তা ও এর অতিরিক্ত অর্থায়নের ওপর ভিত্তি করে ব্যবস্থা করা হয়েছে। ২০১৮ সাল থেকে এডিবি বাস্তুচ্যুত ব্যক্তি ও স্থানীয় সম্প্রদায়- উভয়ের সুবিধার্থে মোট ১৭১.৪ মিলিয়ন ডলার অনুদান এবং ঋণ প্রদান করেছে।
‘ইন্টিগ্রেটেড সার্ভিসেস অ্যান্ড লাইভলিহুড ফর ডিসপ্লেসড পিপল ফ্রম মিয়ানমার অ্যান্ড হোস্ট কমিউনিটিজ ইমপ্রুভমেন্ট’ শীর্ষক প্রকল্পের আওতায় পানি, স্যানিটেশন ও স্বাস্থ্য, সড়ক ও সেতু, ড্রেনেজ ব্যবস্থা, খাদ্য নিরাপত্তা, বিদ্যুৎ এবং দুর্যোগ সহনশীলতা উন্নত ও সম্প্রসারিত করা হবে।
এই প্রকল্পের আওতায় কক্সবাজার ও ভাসানচর অঞ্চলে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গা এবং আশ্রয়দাতা স্থানীয় জনগণের জন্য পৃথক পদ্ধতির মাধ্যমে তাদের বিশেষ প্রয়োজনীয়তা পূরণ করা হবে।
প্রকল্পের মাধ্যমে কক্সবাজারে সোলার-পাওয়ারড স্ট্রিটলাইট স্থাপন বা প্রতিস্থাপন, ভাসানচরে পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা পুনঃস্থাপন এবং রান্নার জন্য বায়োগ্যাস উৎপাদনকে সমৃদ্ধ করা হবে। কক্সবাজার ও ভাসানচরে প্রাকৃতিক সমাধানে ড্রেনেজ খাল পুনঃস্থাপন করা হবে এবং নারী, শিশু ও প্রতিবন্ধীদের জন্য সুবিধা বাড়াতে খাদ্য বিতরণ কেন্দ্র নির্মাণ করা হবে। প্রকল্পের আওতায় আশ্রয়দাতা সম্প্রদায়ের জন্য হাতিয়ায় বহুমুখী সাইক্লোন শেল্টার নির্মাণ করা হবে এবং কক্সবাজারের ৯টি উপজেলায় মিনিপাইপড পানি সরবরাহ ব্যবস্থা চালু করবে।
এই প্রকল্পের মাধ্যমে স্থানীয় সম্প্রদায়ের জন্য হাতিয়ায় বহুমুখী ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ করা হবে এবং কক্সবাজারের নয়টি উপজেলাজুড়ে ক্ষুদ্র পাইপযুক্ত পানি সরবরাহ ব্যবস্থা চালু করা হবে।
টেকনাফের পানি সংকটাপন্ন এলাকায় পরিশোধিত পানি সরবরাহের জন্য পালংখালী ইউনিয়ন ও উখিয়ায় একটি ভূ-পৃষ্ঠস্থ পানি শোধনাগার নির্মাণ করা হবে এবং একটি ট্রান্সমিশন পাইপলাইন স্থাপন করা হবে। কক্সবাজার ও ভাসানচরে রাস্তার উন্নয়নের ফলে গতিশীলতা ও যোগাযোগ বৃদ্ধি পাবে।
বর্তমানে কক্সবাজারের ৩৩টি শিবিরে মিয়ানমার থেকে আসা ১০ লাখেরও বেশি বাস্তুচ্যুত মানুষ বাস করছে। যাদের মধ্যে প্রায় ৭৫ শতাংশ নারী ও শিশু। নোয়াখালী জেলার ভাসানচরে ৩৬ হাজারেরও বেশি স্বেচ্ছায় স্থানান্তরিত হয়েছে।
রোহিঙ্গাদের সহায়তায় ৩৪ লাখ ডলার দিচ্ছে জাপান : রোহিঙ্গাদের সহায়তায় জাপান ৩ দশমিক ৪ মিলিয়ন মার্কিন ডলার দিচ্ছে। গতকাল সোমবার ঢাকার জাপান দূতাবাস এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানিয়েছে। জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (ডব্লিউএফপি) রোহিঙ্গা ও আশ্রয়দাতা জনগোষ্ঠীর জীবন রক্ষাকারী সহায়তার জন্য জাপান সরকারের পক্ষ থেকে জাপানি সরকারের ৫০০ মিলিয়ন জাপানি ইয়েন (প্রায় ৩ দশমিক ৪ মিলিয়ন মার্কিন ডলার) সময়োপযোগী অনুদানকে স্বাগত জানিয়েছে।
ঢাকায় নিযুক্ত জাপানের রাষ্ট্রদূত সাইদা শিনিচি বলেন, রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর মৌলিক চাহিদা পূরণে জাপান বাংলাদেশ ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের পাশে দৃঢ়ভাবে রয়েছে। তিনি বলেন, ক্যাম্পগুলোতে ক্রমবর্ধমান চাহিদা এবং মানবিক তহবিলের তীব্র হ্রাস নিয়ে আমরা গভীরভাবে উদ্বিগ্ন। ক্রমবর্ধমান মানবিক সংকট রোধে এবং রোহিঙ্গারা নিরাপদে ও মর্যাদার সঙ্গে মিয়ানমারে ফিরে যেতে পারে এমন একটি দীর্ঘমেয়াদি সমাধানে অবদান রাখতে ডব্লিউএফপি ও সব অংশীদারদের সঙ্গে কাজ করতে জাপান প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
জাপানের সর্বশেষ অনুদানে ডব্লিউএফপি ১ লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থী এবং ২ হাজার ঝুঁকিপূর্ণ বাংলাদেশিকে মাসিক খাদ্য সহায়তা ও পুষ্টি সহায়তা দেবে। পরিবারগুলো ক্যাম্প স্টোরগুলোতে চাল, মসুর ডাল এবং তাজা শাকসবজিসহ বিভিন্ন খাবার কেনার জন্য ই-ভাউচার পাবে। অপুষ্টি প্রতিরোধ ও চিকিৎসার জন্য ক্যাম্পের ভেতরে ও বাইরে শিশু ও অন্তঃসত্ত্বা বা বুকের দুধ খাওয়ানো নারীদের কাছে বিশেষ পুষ্টি সহায়তা পৌঁছে যাবে।
২০২৪ সালের গোড়ার দিক থেকে প্রায় দেড় লাখ রোহিঙ্গা মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে তীব্র লড়াইয়ের কারণে ক্যাম্পে পৌঁছেছে। তাদের মোট জনসংখ্যা ১১ লাখ ছাড়িয়ে গেছে। ক্রমবর্ধমান চাহিদা সত্ত্বেও আন্তর্জাতিক তহবিলের তীব্র হ্রাস পুরো মানবিক প্রতিক্রিয়াকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলেছে। খাদ্য, রান্নার গ্যাস, পুষ্টি, স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা এবং সুরক্ষার মতো গুরুত্বপূর্ণ পরিষেবাগুলিকে হুমকির মুখে ফেলেছে। যদি নতুন তহবিল সুরক্ষিত না হয় তাহলে ডব্লিউএফপি ডিসেম্বর থেকে শুরু হওয়া তার খাদ্য সহায়তায় একটি বড় ব্যাঘাতের ঝুঁকির মুখোমুখি হবে।
বাংলাদেশে ডব্লিউএফপির কান্ট্রি ডিরেক্টর ডম স্কালপেলি বলেন, জাপানের অবিচল অংশীদারত্ব এবং জাপানের জনগণের উদারতার জন্য আমরা গভীরভাবে কৃতজ্ঞ। ক্যাম্পগুলোতে মানবিক পরিস্থিতির আরও অবনতি রোধে সহায়তা করার জন্য আমরা সব অংশীদারদের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি। ডব্লিউএফপিতে আমরা প্রতিটি ডলার প্রসারিত করা এবং দক্ষতা, স্বচ্ছতা এবং অর্থের মূল্য নিশ্চিত করার কাজ চালিয়ে যাব।
২০১৭ সালের আগস্ট থেকে রোহিঙ্গা আসা শুরু হওয়ার পর থেকে জাপান বাংলাদেশে রোহিঙ্গা শরণার্থী প্রতিক্রিয়াকে সমর্থন করেছে, এই নতুন তহবিলের মাধ্যমে ডব্লিউএফপি এবং অন্যান্য জাতিসংঘের সংস্থা এবং বাংলাদেশে এনজিওগুলোতে ২৪০ মিলিয়ন মার্কিন ডলারেরও বেশি অবদান রেখেছে।