
বিগত বছরের তুলনায় দেশের বাজারে এ বছর ইলিশ মাছের দাম কিছুটা বেশি। ইলিশ জাতীয় মাছ হওয়ার পরও সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে থাকছে। সম্প্রতি সরকারি সমীক্ষায় ইলিশের দাম বাড়ার পেছনে ১১টি কারণ উঠে এসেছে। তবে এসব বিষয়ে সমাধানে পৌঁছানো যাচ্ছে না। ফলে ইলিশ এখন অনেকের কাছেই বিলাসী পণ্য। ইলিশের চড়া দামের পেছনে দাদন ব্যবসায়ীরা সরাসরি জড়িত। ইলিশের চড়া দাম নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতার কথা স্বীকার করেন অন্তর্বর্তী সরকারের মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ফরিদা আখতার। তিনি আক্ষেপ করে বলেন, ‘বাজারে ইলিশের দাম কমাতে না পারাটা আমার কাছেও কষ্টের কারণ।’
ইলিশের নিরাপদ প্রজনন নিশ্চিতে শনিবার থেকে ইলিশ ধরা বন্ধ থাকবে। আগামী ২৫ অক্টোবর পর্যন্ত মোট ২২ দিন রাজবাড়ী ও গোয়ালন্দ উপজেলার পদ্মা নদীসহ দেশের বিভিন্ন নদনদী-সাগরে ইলিশসহ সব ধরনের মাছ ধরায় নিষেধাজ্ঞা থাকবে। গোয়ালন্দ উপজেলা প্রশাসন সূত্রে জানা যায়, অভিযানে মৎস্য কর্মকর্তাদের পাশাপাশি কাজ করবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। নিষেধাজ্ঞা বাস্তবায়নে জেলেদের সহায়তায় ভিজিএফ কর্মসূচির আওতায় চাল বিতরণ করা হবে। মাছ ধরায় নিষেধাজ্ঞা বাস্তবায়নে ইলিশ ধরার নিষেধাজ্ঞায় রাজবাড়ী ও গোয়ালন্দ উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় চলছে প্রচার। এই সময়ে কাজ না থাকায় জেলেদের ২৫ কেজি করে চাল দেবে সরকার। বরাদ্দ পেতে সঠিকভাবে তালিকা তৈরির দাবি জানিয়েছেন জেলেরা। অভিযান সফল করতে প্রশাসনের সঙ্গে কাজ করবে নৌপুলিশ, কোস্টগার্ড। নিষেধাজ্ঞা মেনে চলতে জেলেপল্লিগুলোতে লিফলেট বিতরণের পাশাপাশি নদী তীরবর্তী এলাকায় করা হয়েছে মাইকিং। স্থানীয়রা বলছেন, জেলেরা এখন অনেক সচেতন। সরকারের আইন অমান্য করে নদীতে কেউ যাবে না। এদিকে ইলিশ ধরা বন্ধের খবর শুনে ক্রেতারা ইলিশ কিনতে ছুটছেন মৎস্য ঘাটগুলোতে। ক্রেতারা বলেছেন, ইলিশের দাম স্বাভাবিক রয়েছে। গোয়ালন্দ উপজেলা সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তা আনোয়ারুল ইসলাম পাইলট বলেন, ‘আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, প্রশাসন ও মৎস্য বিভাগ ২২ দিন নদীতে কঠোর নজরদারি রাখবে। আমরা এ বিষয়ে সব প্রস্তুতি গ্রহণ করেছি।’
দৌলতদিয়া নৌপুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ ত্রিনাথ সাহা বলেন, ‘জেলেদের ২২ দিন ধৈর্য ধরে মা ইলিশ রক্ষায় সক্রিয় ভূমিকা রাখতে হবে। সরকার এ সময় বিকল্প কর্মসংস্থান ও সহায়তা দেবে। তবু যদি কেউ নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে নদীতে নামে, তাহলে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’ গোয়ালন্দ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. নাহিদুর রহমান জেলেদের উদ্দেশে বলেন, ‘নিষিদ্ধ সময় নদী থেকে ইলিশ আহরণ, পরিবহন, মজুত, বাজারজাতকরণ, ক্রয়-বিক্রয় সম্পন্ন নিষেধ। যারা এই আইন অমান্য করবে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘উৎপাদন বাড়াতে মা ইলিশকে নিরাপদে ডিম ছাড়ার সুযোগ দিতে হবে। প্রজনন মৌসুমে মা ইলিশ ধরা হলে ভবিষ্যতে মাছের উৎপাদন মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এই নিষেধাজ্ঞা শুধু শাস্তির জন্য নয়-বরং আপনাদের (জেলেদের) ভবিষ্যৎ সুরক্ষার জন্য।’ ইউএনও বলেন, ‘ইলিশের প্রজনন মৌসুমে কেউ নিষেধাজ্ঞা অমান্য করলে ২ বছরের কারাদণ্ড, ৫ হাজার টাকা পর্যন্ত জরিমানা, অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন।’
রাজধানীর বিভিন্ন বাজার ঘুরে দেখা গেছে, চলতি বছরের আগস্ট মাসে দেড় কেজি বা তারও বেশি ওজনের ইলিশের প্রতি কেজির মূল্য ছিল ২ হাজার ৬০০ থেকে ৩ হাজার টাকা। এক কেজি থেকে দেড় কেজি ওজনের প্রতি কেজি ইলিশের গড় দাম ছিল ২ হাজার ৪০০ থেকে ২ হাজার ৭০০ টাকা। আর ৭৫০ গ্রাম থেকে এক কেজি সাইজের প্রতি কেজি ইলিশ বিক্রি হয়েছে ১ হাজার ৬০০ টাকা এবং আধা কেজি থেকে ৭৫০ গ্রাম ওজনের ইলিশের কেজি ছিল ১ হাজার ২০০ থেকে ১ হাজার ৪০০ টাকা। ইলিশের দাম বাড়ার কারণ নিয়ে সম্প্রতি সমীক্ষা চালিয়েছে বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশন (বিটিটিসি)।
সংস্থাটির প্রতিবেদনে ইলিশের দাম বৃদ্ধির পেছনে ১১ কারণ চিহ্নিত করা হয়েছে। এগুলো হলো- চাহিদা ও সরবরাহের ভারসাম্যহীনতা; অবৈধ মজুত ও মুনাফাখোর সিন্ডিকেট; জ্বালানি তেল ও পরিবহন খরচ বৃদ্ধি; মাছ ধরার খরচ বৃদ্ধি; নদীর নাব্য সংকট ও পরিবেশগত সমস্যা; অবৈধ জালের ব্যবহার; দাদন প্রথার প্রচলন; বিকল্প কর্মসংস্থান; নিষিদ্ধ সময়ে মাছ ধরা; মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য ও রফতানির চাপ। অভিযোগ রয়েছে, অধিক লাভের আশায় চাহিদা ও জোগানের মধ্যে ভারসাম্যের ক্ষেত্রে অনেক সময় কৃত্রিম সংকট তৈরি করেন ব্যবসায়ীরা। এ জন্য তারা ইলিশের অবৈধ মজুত গড়ে তোলেন বলেও ট্যারিফ কমিশনের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। প্রতিবেদনটি বাণিজ্য এবং মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিবের কাছে পাঠিয়েছে কমিশন।
ট্যারিফ কমিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত বছরের আগস্টে দেড় কেজি বা তারও বেশি ওজনের প্রতি কেজি ইলিশের দাম ছিল ১ হাজার ৮০০ থেকে ২ হাজার টাকা। এক থেকে দেড় কেজি ওজনের ইলিশ বিক্রি হয়েছে ১ হাজার ৬০০ টাকা থেকে ১ হাজার ৮০০ টাকায়। ৭৫০ গ্রাম থেকে এক কেজি ওজনের ইলিশের কেজি ছিল ১ হাজার ১০০ টাকা থেকে ১ হাজার ১৫০ টাকা, ৫০০ থেকে ৭৫০ গ্রাম ওজনের ইলিশের কেজি ছিল ৮০০ থেকে ১ হাজার টাকা।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, স্থানীয় বাজারে আকৃতি ভেদে ৩ হাজার টাকা কেজি দরে ইলিশ বিক্রি হলেও এ বছর ভারতে প্রতি কেজি ইলিশের রফতানি মূল্য ১ হাজার ৫৩৩ টাকা। এদিকে সরকার নির্ধারিত রফতানি মূল্যের চেয়ে দেশের বাজারে ইলিশের দাম অনেক বেশি হওয়ায় অনুমতি পেয়েও রফতানিতে অনীহা ইলিশ রফতানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলোর।
ট্যারিফ কমিশনের প্রতিবেদনে সরাসরি পাইকার বা আড়তদারদের কাছে মাছ বিক্রির জন্য জেলেদের সমবায় সমিতি গঠন করার সুপারিশ করেছে। সরবরাহ চেইনের ধাপ কমানোর জন্য একটি অনলাইন প্ল্যাটফর্ম তৈরি, ন্যায্য দামে ইলিশ বিক্রি নিশ্চিত করতে প্রধান শহরগুলোতে সরকারি উদ্যোগে ইলিশের বিশেষ বিপণন কেন্দ্র স্থাপন, কোল্ডস্টোরেজ তৈরি, আড়তদার ও পাইকারদের বাধ্যতামূলক রেজিস্ট্রেশন ও লাইসেন্স, সরবরাহ ব্যবস্থার ধাপ অনুযায়ী যৌক্তিক মুনাফা বেঁধে দেওয়ার পাশাপাশি দাদন ব্যবসায়ীদের দৌরাত্ম্য কমাতে সহজ শর্তে জামানতবিহীন ঋণ দেওয়ার সুপারিশ করেছে কমিশন।
এ বিষয়ে ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনের চেয়ারম্যান মইনুল খান বলেন, ‘সরেজমিন সমীক্ষায় দেখা গেছে, ইলিশ মাছ প্রায় শতভাগ দেশীয় পণ্য হলেও বাজারে এর দামের পেছনে কৃত্রিমতার সংযোগ রয়েছে। ইলিশ আহরণে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য বা ডলারের ওঠানামার তেমন প্রভাব নেই। সমীক্ষায় চিহ্নিত মূল জায়গা হলো আহরণ পরবর্তী সময়ে মধ্যস্বত্বভোগীদের নানা স্তর ও তাদের অতিরিক্ত মুনাফা।’ মইনুল খান জানান, মূলত দাদন ব্যবসায়ীদের কারসাজি এর পেছনে বেশি ভূমিকা রাখছে। সমীক্ষায় এসব স্তর কমানোর উদ্যোগ নেওয়ার পাশাপাশি দাদন ব্যবসায়ীদের মনিটরিংয়ের সুপারিশ করা হয়েছে। তবে কমিশনের সুপারিশে সবচেয়ে বেশি জোর দেওয়া হয়েছে, খরচ বিশ্লেষণ করে আকৃতি অনুযায়ী ইলিশের সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য নির্ধারণের বিষয়ে। এতে ইলিশের প্রান্তিক বিক্রেতা ন্যায্য দাম পাবে, অন্যদিকে ভোক্তাদের কাছে তা নির্ধারিত দামে বিক্রি হবে মনে করে কমিশন।
মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ফরিদা আখতার বলেছেন, ‘বাংলাদেশের মানুষ যেন সাশ্রয়ী দামে ইলিশ খেতে পারে, সে জন্য আমরা গবেষণা চালাচ্ছি। আসল সমস্যাটা খুঁজে বের করার চেষ্টা করছি।’ ইলিশের দাম প্রসঙ্গে ভোলার জেলে এমদাদ হোসেন বলেন, ‘ইলিশের বাজার অস্থির করে দাদন ব্যবসা। আমরা নিরুপায় হয়ে দাদন নিতে বাধ্য হই। এরাই ইলিশের কৃত্রিম সংকট তৈরি করে। অধিক মুনাফার আশায় অবৈধ মজুত করে। এগুলো ঠিক করা গেলে ইলিশের বাজার স্থির হতে সময় লাগবে না।’
উল্লেখ্য, বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশের মোট মাছ উৎপাদনের প্রায় ১২ শতাংশই ইলিশ। দেশের জিডিপিতে এটি প্রায় ১ শতাংশ অবদান রাখে। বাংলাদেশের জেলেরা বছরে ছয় লাখ টন ইলিশ ধরেন। এই মাছের বেশিরভাগই আসে সমুদ্র থেকে।