ঢাকা শনিবার, ১৩ ডিসেম্বর ২০২৫, ২৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

সুসংবাদ প্রতিদিন

চান্দিনায় ড্রাগন চাষে সাফল্য

চান্দিনায় ড্রাগন চাষে সাফল্য

কুমিল্লার চান্দিনা উপজেলার কাদুটির চাঁদসার গ্রামের বাসিন্দা নাছিমা বেগম একজন সফল ড্রাগন চাষী এবং নারী উদ্যোক্তা। তিনি সামান্য কয়েকটি চারা দিয়ে শুরু করেছিলেন এই ফল চাষ। তার এই উদ্যোগ শুধু তাকেই অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী করেনি, বরং স্থানীয় নারীদের এবং অন্যান্য কৃষকদের ড্রাগন চাষে আগ্রহী করে তুলেছে। নাছিমার ড্রাগন বাগান এখন চান্দিনার একটি পরিচিত নাম এবং তিনি এই অঞ্চলের প্রথম ড্রাগন চাষি হিসেবে পরিচিত। তার কঠোর পরিশ্রম, আত্মবিশ্বাস এবং সফলতার গল্প গ্রামীণ অর্থনীতিতে এক নতুন দিক খুলে দিয়েছে।

নাছিমার স্বামী মোহাম্মদ আলী দীর্ঘদিন প্রবাসে ছিলেন। স্বামীর পাঠানো ১০ লাখ টাকা দিয়ে ২০১৯ সালে বাড়ি নির্মাণের বদলে ড্রাগন ফলের বাগান গড়েন নাছিমা বেগম। আর সেই বাগানের আয়ে পরে জমি কিনেছেন, গড়েছেন বাড়িও। বর্তমানে স্বামী, সংসার ও সন্তানদের নিয়ে সুখে আছেন তিনি। ফলের বাগান গড়ে নিজের সংসারের পাশাপাশি নাছিমা রাঙিয়েছেন অনেকের জীবন। বাগান থেকে গাছের চারা এবং নাছিমার কাছ থেকে বিভিন্ন পরামর্শ নিয়ে তার আশপাশের গ্রামের অর্ধশতাধিক ব্যক্তি ড্রাগন বাগান করেছেন।

নাছিমা দম্পতি এখন আরও বাগান গড়ার স্বপ্ন দেখছেন। সেখানে এলাকার বহু বেকারের কর্মসংস্থান হবে বলেও আশা তাদের। সরেজমিনে দেখা যায়, চান্দিনার চাঁদসার গ্রামে বাড়ির সঙ্গেই ড্রাগন বাগান। ফলের রঙে বাগান রঙিন হয়ে উঠেছে। নাছিমা দম্পতি আরও চারজনকে সঙ্গে নিয়ে বাগান থেকে ড্রাগন ফল তুলছেন। বালতিভর্তি ড্রাগন নিয়ে রাখছেন পাশের ঘরে। সেখান থেকে তাজা ড্রাগন কিনে নিচ্ছেন পাইকাররা। তাদের কেউ এসেছেন চান্দিনা শহর থেকে, কেউ এসেছেন কুমিল্লা নগরী থেকে। স্থানীয় অনেকে আবার বাগান থেকে খুচরা দরে ড্রাগন কিনে সেখানে বসেই খাওয়া শুরু করেছেন। ফলের রঙে তাদের হাত ও মুখ রঙিন হয়ে গেছে। উদ্যোক্তা নাছিমা বেগম জানান, স্বামী প্রবাসে ছিলেন। প্রবাসে আর কত দিন কাজ করতে পারবেন, এই ভাবনা থেকে স্থায়ী আয়ের ব্যবস্থা করার তাগিদ অনুভব করেন তিনি। স্বামীকে ফোনে জানালে তিনিও সায় দেন। তবে প্রতিবেশীরা অনেক কটূ কথা বলেছেন। গাছের ডাল লাগিয়ে ব্যর্থ হলে স্বামী তাকে ছেড়ে দেবেন, সন্তানরা অসহায় হয়ে পড়বে, এমন সব কথা শুনতে হয়েছে তাকে। তবে নীরবে সবার কথা শুনলেও সেগুলোকে মনের ভেতরে স্থান দেননি তিনি।

নাছিমা বলেন, আমি আমার মনের কথাগুলো শুনেছি। হাড়ভাঙা পরিশ্রম করেছি। এখন মনে হচ্ছে, প্রতিবেশীদের কথা শুনলে আমার স্বপ্ন পূরণ হতো না।

ড্রাগন চাষের গল্প তুলে ধরে নাছিমা বলেন, ‘ফলের বাগান করতে প্রথমে আমি নাটোর থেকে চারা সংগ্রহ করি। ৮০ শতক জমিতে ড্রাগন চাষ শুরু করি। এতে খরচ হয় ১০ লাখ টাকার মতো। প্রথম বছরে দেড় লাখ টাকার ফল পাই। পরের বছরে পাই পাঁচ লাখ টাকা। তৃতীয় বছরে ৪০ শতকের আরও দুটি জায়গা কিনে বাগান বাড়াই। পরে আর বাগান করতে তেমন খরচ লাগেনি। শুধু পিলারে খরচ হয়েছে। রোগবালাই ও সার প্রয়োগে বিভিন্ন সময়ে স্থানীয় কৃষি অফিসের পরামর্শ পেয়েছি। এখন প্রতিকেজি পাইকারি ২৭০-৩০০ টাকায় বিক্রি করি। গতকালও ২৫০ কেজি ফল বিক্রি করেছি। চলতি বছর এখন পর্যন্ত ১২ লাখ টাকার ফল বিক্রি করেছি। ড্রাগনের আয়ে পরিবারের খরচ, সন্তানদের লেখাপড়া ও সঞ্চয় করতে পারছি। নাছিমার স্বামী মোহাম্মদ আলী বলেন, ড্রাগনের আয়ে আমাদের পরিবারে সচ্ছলতা এসেছে। আমরা সুখে আছি।’

চান্দিনা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মোরশেদ আলম বলেন, নাছিমা বেগম চান্দিনার প্রথম ড্রাগনচাষি। তার দেখাদেখি মাইজখার ও হারংয়ে আরও দুটি ড্রাগন বাগান হয়েছে। ড্রাগন চাষ বৃদ্ধি পাওয়ায় ভোক্তারা আগের থেকে কম দামে ফল কিনতে পারছেন। আমরা যে বাণিজ্যিক কৃষির কথা বলি, নাছিমা বেগমসহ অন্যরা সেগুলো বাস্তবায়ন করছেন। উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা ও ব্লক সুপারভাইজারসহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে নির্দেশনা দেওয়া আছে, তারা যেন কৃষি উদ্যোক্তাদের পাশে থেকে তাদের বিভিন্ন পরামর্শ দেন। তাদের সমস্যা শুনে সে অনুযায়ী পদক্ষেপ নেন। সব কথার মূল কথা- বাণিজ্যক কৃষিতে নারীদের অংশগ্রহণ আমাদের অর্থনীতির জন্য আশাব্যঞ্জক খবর। চান্দিনার নাছিমার এই সফলতার গল্পটি প্রমাণ করে যে, সঠিক উদ্যোগ, পরিশ্রম আর নতুন কিছু করার সাহস থাকলে গ্রামীণ অর্থনীতিতে বড় পরিবর্তন আনা সম্ভব।

ড্রাগন ফল চাষ করে নাছিমা শুধু নিজের আর্থিক সচ্ছলতা ও আত্মবিশ্বাস ফিরে পাননি, বরং এলাকার আরও অনেকের জন্য তিনি অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে উঠেছেন। এই লাল ফল যেন এখন আর কেবল ফল নয়, এটি স্বাবলম্বী হওয়ার প্রতীক। নাছিমার এই প্রচেষ্টা ইঙ্গিত দিচ্ছে, আগামীতে এই ড্রাগন চাষই গ্রামীণ কৃষি ক্ষেত্রে এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করতে চলেছে।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত