ঢাকা শনিবার, ১৩ ডিসেম্বর ২০২৫, ২৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

ছয় বড় বিপদে নেতানিয়াহু

ছয় বড় বিপদে নেতানিয়াহু

গাজায় ইসরায়েলের হামলায় গত দুই বছরে অগণিত প্রাণহানি ও ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয় ঘটেছে। তবু দেশটির প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর জন্য এ উপত্যকায় শান্তি যেন অকালেই এসেছে। এমনটাই মনে হচ্ছে কিছু পর্যবেক্ষকের চোখে। সমালোচকেরা বলছেন, এ যুদ্ধকে নেতানিয়াহু নিজ রাজনৈতিক অবস্থান ও এমনকি তার স্বাধীনতার (বিভিন্ন মামলা থেকে মুক্তি) চ্যালেঞ্জগুলো থেকে মনোযোগ সরানোর হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছেন। এখন যুদ্ধবিরতি কার্যকর হলেও, এসব সমস্যার একটিও মুছে যায়নি। যুদ্ধবিরতিকে নেতানিয়াহু বিজয় হিসেবে দেখানোর চেষ্টা করছেন। কিন্তু সাবেক ইসরায়েলি রাষ্ট্রদূত আলন পিনকাসসহ অনেকের মতে, এ যুদ্ধবিরতি ছিল মূলত সাজানো নাটক; যা হোয়াইট হাউসের চাপে নেতানিয়াহু মানতে রাজি হয়েছেন। কারণ, ওয়াশিংটন গাজা যুদ্ধের আর্থিক ও কূটনৈতিক বোঝা বইতে আর রাজি ছিল না। তাহলে প্রশ্ন উঠছে, যদি নেতানিয়াহু নতুন কোনো যুদ্ধ শুরু করতে না পারেন, তবে আগামী বছরের ইসরায়েলি নির্বাচনের আগে-পরে নেতানিয়াহুর সামনে কী কী চ্যালেঞ্জ আছে? আর সেগুলো কতটা ভয়ানক হতে পারে? চলুন, একে একে দেখে নেওয়া যাক-

১. আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নেতানিয়াহু কি আরও একা হয়ে পড়বেন : বর্তমানে ইসরায়েল আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে যতটা নিঃসঙ্গ, অতীতে কখনো এতটা ছিল না। আর অনেকের কাছেই সেই নিঃসঙ্গতার প্রতীক এখন বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু। গত দুই বছরে গাজায় ইসরায়েলি হামলায় ৬৭ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। খাদ্য অবরোধে সৃষ্ট দুর্ভিক্ষের ভয়াবহ দৃশ্য বিশ্বজুড়ে ক্ষোভের জন্ম দিয়েছে। স্বল্প মেয়াদে, যদি না নেতানিয়াহু সরকার আন্তর্জাতিক সাংবাদিকদের স্থায়ীভাবে গাজায় প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা দেয়, তবে বিশ্বের গণমাধ্যমে এ হত্যাযজ্ঞের চিত্র আরও স্পষ্টভাবে প্রকাশ পাবে। এটি ইসরায়েলের একঘরে অবস্থানকে আরও দীর্ঘস্থায়ী করবে। তবে ইসরায়েলের জন্য ক্রমবর্ধমাণ এ কূটনৈতিক নিঃসঙ্গতা নতুন নয়। গত সেপ্টেম্বরেই নেতানিয়াহু যেন এ অবস্থাকে স্থায়ী করার ইঙ্গিত দিয়েছিলেন। তিনি ঘোষণা করেছিলেন একটি ‘সুপার স্পার্টা’ তৈরির স্বপ্ন। সেটি প্রাচীন যুদ্ধবাজ গ্রিক নগররাষ্ট্র স্পার্টার আদলে এমন এক রাষ্ট্র, যা অর্থনৈতিকভাবে বিচ্ছিন্ন, কূটনৈতিকভাবে আলাদা এবং যুদ্ধকেই জীবনধারা হিসেবে গ্রহণ করবে। এ বক্তব্য ইসরায়েলি বিনিয়োগকারীরা ভালোভাবে নেননি। ঘোষণার পরই তেল আবিব স্টক এক্সচেঞ্জে সূচক ধসে পড়ে এবং শেকেলের মান অন্যান্য মুদ্রার তুলনায় কমে যায়। দেশের ২০০ বড় প্রতিষ্ঠানের সংগঠন ‘ইসরায়েল বিজনেস ফোরাম’ এক বাক্যে বলেছিল, ‘আমরা স্পার্টা নই।’

২. দক্ষিণপন্থিরা কি নেতানিয়াহুর জোট সরকার ভেঙে দিতে পারেন : এটি সম্ভব। তবে নেতানিয়াহু এরইমধ্যে সেই ঝুঁকি এড়াতে নানা পদক্ষেপ নিয়েছেন। যুদ্ধ চলাকালে ও এর আগে বিচারব্যবস্থার স্বাধীনতা নিয়ে বিতর্কের সময়েও চরম দক্ষিণপন্থিদের ওপর নির্ভর করেছেন তিনি। সবচেয়ে দৃশ্যমানভাবে, অর্থমন্ত্রী বেজালেল স্মোট্রিচ ও জাতীয় নিরাপত্তামন্ত্রী ইতামার বেন গভির— দুজনই যুদ্ধবিরতির বিরোধিতা করলেও এখনও নেতানিয়াহুর জোটে আছেন। এ দুজনের বেরিয়ে যাওয়ার আশঙ্কায় নেতানিয়াহু এখন একটি আইন আনতে যাচ্ছেন; যাতে ধর্মীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের (ইয়েশিভা) শিক্ষার্থীদের সামরিক নিয়োগ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হবে। এতে তিনি আশা করছেন, আলট্রা-অর্থডক্স দলগুলো আবার তার জোটে ফিরবে। ফলে কোনো দল যদি সরে যায়, তবু সরকার টিকে থাকবে।

৩. আইসিসি ও আইসিজে কি নেতানিয়াহু ও ইসরায়েলকে দোষী সাব্যস্ত করতে পারেন : হ্যাঁ, আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত (আইসিসি) ও আন্তর্জাতিক বিচার আদালত (আইসিজে) নেতানিয়াহু এবং ইসরায়েলকে গাজায় যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্ত করতে পারেন। ২০২৪ সালের নভেম্বর মাসে আইসিসি যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু, তার সাবেক প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইয়োভ গ্যালান্ট ও ফিলিস্তিনি স্বাধীনতাকামী সংগঠন হামাসের সামরিক কমান্ডার মোহাম্মদ দেইফের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেন। দেইফকে পরবর্তী সময়ে ইসরায়েল হত্যা করে। অন্যদিকে, আইসিজেও ইসরায়েলের বিরুদ্ধে দায়ের হওয়া জাতিহত্যার মামলা শুনছেন। যদি আদালত ইসরায়েলকে দোষী সাব্যস্ত করেন, তবে অনেকেই সে জন্য সরাসরি নেতানিয়াহুকেই দায়ী করবেন। গ্যালান্ট ও নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে আইসিসির মামলার কোনো নির্দিষ্ট সময়সূচি নেই। আইসিজের রায়ও ২০২৭ সালের আগে আসার সম্ভাবনা কম। আইসিসি যদি দোষী সাব্যস্ত করেন, তবে সর্বোচ্চ ৩০ বছরের কারাদণ্ড হতে পারে। আর আইসিজে কাউকে দোষী সাব্যস্ত করে রায় দিলে বিষয়টি সাধারণত জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের কাছে কার্যকর করতে পাঠানো হয়।

৪. ট্রাম্প কি নেতানিয়াহুকে পরিত্যাগ করতে পারেন : এ সম্ভাবনা একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রই ইসরায়েলের সবচেয়ে বড় আর্থিক, সামরিক ও কূটনৈতিক ভরসা। ওয়াশিংটনের সমর্থন ছাড়া ইসরায়েল আর নেতানিয়াহু মারাত্মক বিপদে পড়বেন। যতই নেতানিয়াহু দাবি করুন, প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সমর্থনেরও সীমা আছে। ২০২১ সালে ট্রাম্প নাকি ভীষণ ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন। ওই সময় নেতানিয়াহু প্রথম কয়েকজন বিশ্বনেতার একজন ছিলেন, যিনি জো বাইডেনকে নির্বাচনে জেতায় অভিনন্দন জানিয়েছিলেন। এমনকি গত মে মাসে ট্রাম্প নেতানিয়াহুর সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ করে দেন বলে জানা যায়। কারণ, তিনি মনে করেছিলেন, নেতানিয়াহু তাকে ব্যবহার করার চেষ্টা করছেন। সম্প্রতি দোহায় হামাসের আলোচকদের ওপর ইসরায়েলের বিমান হামলার পর ট্রাম্পের ক্ষোভ চরমে ওঠে।

তিনি ক্ষুব্ধ হয়ে বলেছিলেন, ‘ওই লোকটা (নেতানিয়াহু) আমাকে ধোঁকা দিচ্ছে!’ যুদ্ধবিরতির আগে ট্রাম্প বলেছেন, তিনি নেতানিয়াহুর সঙ্গে কঠিন কথা বলেছেন এবং বলেছেন, ‘আমি না বলা পর্যন্ত ইসরায়েল গাজায় আবার ঢুকবে না।’ পরে ইসরায়েলি পার্লামেন্টে যুদ্ধবিরতি উপলক্ষে দেওয়া বক্তৃতায় ট্রাম্প বলেন, ‘এই যুদ্ধবিরতি ৩ হাজার বছর ধরে প্রস্তুত হচ্ছিল এবং এটা টিকেও থাকবে।’ এখন যদি নেতানিয়াহু সেই স্থিতাবস্থা নষ্ট করেন, ট্রাম্প যে ভালোভাবে নেবেন না, তা বলাই যায়।

৫. ৭ অক্টোবরের হামলার আগে নিরাপত্তা ব্যর্থতা নিয়ে কি তদন্ত হবে : এ সম্ভাবনা এখন ক্রমেই বাড়ছে। ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামাসের নেতৃত্বে ইসরায়েলে হামলায় ১ হাজার ১৩৯ জন নিহত হন। জিম্মি করা হয় প্রায় ২৫০ জনকে। এ ঘটনার তদন্তে দেখা গেছে, ইসরায়েলের সেনা ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর মধ্যে গুরুতর দুর্বলতা ও সমন্বয়হীনতা ছিল। তারা এমন আক্রমণের কোনো পূর্বাভাসই ধরতে পারেনি। পৃথক তদন্তের পর সেনাবাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থার প্রধান দুজনই পদত্যাগ করেন। নেতানিয়াহু অন্যান্য তদন্তে কোনো আপত্তি জানাননি, তবে নিজ সরকারের ভূমিকা নিয়ে হওয়া তদন্তের তিনি বিরোধ করেছেন। তিনি বলেছেন, এটি রাজনৈতিকভাবে পক্ষপাতদুষ্ট হবে এবং যুদ্ধ চলাকালীন এটা করা সম্ভব নয়। কিন্তু যুদ্ধবিরতির পর ইসরায়েলের সর্বোচ্চ আদালত সর্বসম্মতভাবে রায় দেন যে, তদন্ত বিলম্বের কোনো যৌক্তিক কারণ আর নেই। আদালত সরকারকে ৩০ দিনের মধ্যে জবাব দিতে বলেছে।

৬. নেতানিয়াহুর কি জেলে যাওয়ার আশঙ্কা আছে : হ্যাঁ, তা রয়ে গেছে। গত সোমবার ট্রাম্প নিজেই গাজার যুদ্ধ ও নেতানিয়াহুর দুর্নীতি মামলার যোগসূত্রের ইঙ্গিত দিয়েছেন। ইসরায়েলের পার্লামেন্টে দেওয়া ভাষণে ট্রাম্প দেশটির প্রেসিডেন্ট আইজ্যাক হারজগকে নেতানিয়াহুকে ক্ষমা করে দেওয়ার আহ্বান জানান। মজা করে বলেন, ‘সিগার আর শ্যম্পেন নিয়ে কি কারও মাথাব্যথা আছে?’ তবে বাস্তবে নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে তিনটি দুর্নীতি মামলা চলছে। যুদ্ধকালেও নানা বিলম্ব সত্ত্বেও মামলাগুলোর কার্যক্রম থেমে থাকেনি। নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে ঘুষ, জালিয়াতি ও আস্থাভঙ্গের অভিযোগ আনা হয়েছে। এসব মামলায় দোষী প্রমাণিত হলে তার ১০ বছরের কারাদণ্ড হতে পারে।

রাফা সীমান্ত খুলে দিতে ইসরায়েলকে চাপ দিন, মধ্যস্থতাকারীদের প্রতি হামাস : গাজায় ত্রাণ প্রবেশের জন্য রাফা সীমান্ত খুলে দিতে ইসরায়েলের ওপর চাপ প্রয়োগের আহ্বান জানিয়েছে ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী সংগঠন হামাস। একই সঙ্গে গাজা পুনর্গঠনে কাজ শুরুর বিষয়ে জোর দিয়েছে তারা। গাজায় যুদ্ধবিরতি চুক্তির মধ্যস্থতাকারীদের প্রতি এ আহ্বান জানানো হয়েছে। গত শুক্রবার বার্তা আদান-প্রদানের অ্যাপ টেলিগ্রামে একটি বিবৃতি প্রকাশ করে হামাস। তাতে ইসরায়েলের ওপর চাপ প্রয়োগের আহ্বান জানানো হয়। বিবৃতিতে যুদ্ধবিরতি চুক্তির জন্য দুই বছর ধরে মিসর, কাতার ও তুরস্কের মধ্যস্থতার প্রশংসা করেছে হামাস। গত ১০ সেপ্টেম্বর গাজায় হামাস ও ইসরায়েলের মধ্যে যুদ্ধবিরতির প্রথম ধাপ শুরু হয়। যুদ্ধবিরতির শর্ত অনুযায়ী গাজার নির্দিষ্ট এলাকা পর্যন্ত সেনা সরিয়ে নিয়েছে ইসরায়েল। দুই পক্ষের মধ্যে বন্দিবিনিময়ও হয়েছে। তবে মৃত জিম্মিদের সবার মরদেহ ফেরত দিতে পারেনি হামাস। একে যুদ্ধবিরতি চুক্তির লঙ্ঘন উল্লেখ করে গাজায় নির্দিষ্ট ত্রাণ প্রবেশে বাধা দিচ্ছে ইসরায়েল। ত্রাণ প্রবেশ ও গাজাবাসীর নির্বিঘ্ন যাতায়াতের জন্য গত বুধবার থেকে গাজা-মিসর সীমান্তে রাফা ক্রসিং খুলে দেওয়ার কথা ছিল ইসরায়েলের। তবে বৃহস্পতিবার এক বিবৃতি দিয়ে ইসরায়েলি বাহিনীর পক্ষ থেকে দাবি করা হয় যে যুদ্ধবিরতি চুক্তিতে রাফা সীমান্ত খুলে দেওয়ার কথা বলা হয়নি। তাই সীমান্তটি বন্ধ থাকবে। গাজায় সব ত্রাণ প্রবেশ করবে ইসরায়েলের কারেম আবু সালেম সীমান্ত দিয়ে। যদিও ইসরায়েলের পররাষ্ট্রমন্ত্রী গিদেয়ন সারের বরাতে ইতালির বার্তা সংস্থা এএনএসএর খবরে বলা হয়েছে, আগামী রোববার রাফা সীমান্ত খুলে দেওয়া হতে পারে। তবে এ নিয়ে বিস্তারিত কিছু জানানো হয়নি। এদিকে রাফা সীমান্ত বন্ধ থাকার কারণে গাজায় ত্রাণ প্রবেশ ব্যাহত হচ্ছে। যুদ্ধবিরতি চুক্তি অনুযায়ী প্রতিদিন ৬০০ ট্রাক ত্রাণ গাজায় প্রবেশ করতে দিতে হবে। তবে এখন প্রবেশ করতে পারছে ৩০০ ট্রাকের কম। এমন পরিস্থিতিতে গাজায় ত্রাণ সরবরাহের জন্য সব সীমান্ত খুলে দিতে ইসরায়েলের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির (ডব্লিউএফপি) মুখপাত্র আবির ইতেফা। এদিকে রাফা সীমান্ত ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর কাছে কৌশল খাটানোর একটি উপাদান বলে মনে করেন রোমের আমেরিকান ইউনিভার্সিটির সহকারী অধ্যাপক আন্দ্রিয়া দেসি। তিনি বলেন, আপাতত ইসরায়েল এই ক্রসিং খুলে দেবে বলে মনে হয় না। তবে ত্রাণ প্রবেশ ও আহত ফিলিস্তিনিদের চিকিৎসা দিতে গাজার বাইরে নেওয়ার জন্য সীমান্তটি খুলে দেওয়া গুরুত্বপূর্ণ। ফলে সীমান্তটি খুলতে ইসরায়েল যে বাধা দিচ্ছে, তা আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন।

আরও এক জিম্মির লাশ হস্তান্তর করল হামাস : ইসরায়েলের কাছে আরও এক জিম্মির লাশ হস্তান্তর করেছে হামাস। গত শুক্রবার রাতে লাশটি ইসরায়েলে পৌঁছায়। ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী সংগঠনটি বলেছে, বিধ্বস্ত গাজার ধ্বংসস্তূপের নিচে থাকা যেসব জিম্মির লাশ এখনও পাওয়া যায়নি, সেগুলো খুঁজে বের করে ফেরত দেওয়া হবে। নতুন করে আরেকটি লাশ ফেরত পাওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করেছে ইসরায়েল। ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর কার্যালয় এক বিবৃতিতে বলেছে, রেডক্রসের মাধ্যমে গাজায় নিরাপত্তা বাহিনীর (ইসরায়েলি) কাছে ফেরত দেওয়া এক জিম্মির মরদেহবাহী কফিন গ্রহণ করেছে ইসরায়েল। ইসরায়েলের একটি চিকিৎসাকেন্দ্রে লাশটি শনাক্ত করা হবে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের উদ্যোগে সম্প্রতি গাজায় ইসরায়েল ও হামাসের মধ্যে যুদ্ধবিরতি কার্যকর হয়েছে। এ-সংক্রান্ত চুক্তির আওতায় এখন পর্যন্ত ২০ জন জীবিত ইসরায়েলি জিম্মির সবাইকে মুক্তি দিয়েছে হামাস। পাশাপাশি ৯ জিম্মির লাশ হস্তান্তর করেছে। হস্তান্তর করা লাশের পরিচয় শনাক্ত না হওয়ায় এটিকে এখনও জিম্মির লাশ হিসেবে হিসাব করা হয়নি। হামাসের কাছে মোট ২৮ জিম্মির লাশ থাকার কথা। জিম্মি মুক্তির বিনিময়ে প্রায় দুই হাজার ফিলিস্তিনি বন্দিকে ইসরায়েল কারাগার থেকে মুক্তি দিয়েছে। গাজা উপত্যকায় সামরিক অভিযানও বন্ধ রেখেছে তারা। ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু গত বৃহস্পতিবার আবারও বলেছেন, হামাসের কাছ থেকে সব জিম্মির মুক্তি নিশ্চিত করার ব্যাপারে তিনি দৃঢ় অবস্থানে আছেন। তার প্রতিরক্ষামন্ত্রীও হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছেন, হামাস এটা করতে না পারলে ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী আবারও যুদ্ধ শুরু করবে। হামাসের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা গাজি হামাদ এসব হুমকিকে ‘অগ্রহণযোগ্য চাপ তৈরির কৌশল’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। এক বিবৃতিতে হামাদ বলেন, লাশ ফেরত দেওয়ার বিষয়টি জটিল ও সময় লাগবে। বিশেষ করে দখলদারির (ইসরায়েলি) কারণে গাজার চিত্র পাল্টে যাওয়ায় এ প্রক্রিয়া জটিল হয়ে গেছে। তিনি আরও বলেন, ‘আমরা লাশগুলো ফেরত দেব এবং আমাদের প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী চুক্তি মেনে চলব।’ গাজায় ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়া লাশ উদ্ধারে সহযোগিতা করার জন্য তুরস্ক একটি বিশেষজ্ঞ দল পাঠিয়েছে।

তুর্কি এক কর্মকর্তা এএফপিকে বলেন, ইসরায়েল কখন তুর্কি দলকে গাজায় প্রবেশ করতে দেবে, তা এখনো নিশ্চিত নয়। তুরস্কের দলটিকে ফিলিস্তিনি ও জিম্মি উভয়ের লাশ খুঁজে বের করার কাজ দেওয়া হয়েছে বলে উল্লেখ করেন তিনি। হামাসের একটি সূত্র এএফপিকে বলেছে, তুর্কি প্রতিনিধিদল রোববারের মধ্যে গাজায় প্রবেশ করবে বলে আশা করা হচ্ছে। গাজায় হামাসের অধীন পরিচালিত উদ্ধারকারী সংস্থা সিভিল ডিফেন্স বলেছে, যুদ্ধবিরতি কার্যকর হওয়ার পর ধ্বংসস্তূপ থেকে ২৮০টির বেশি লাশ উদ্ধার করা হয়েছে।

যুদ্ধবিরতির পরও গাজায় ২৮ জনকে হত্যা করেছে ইসরায়েল : যুদ্ধবিরতি চুক্তি কার্যকর হওয়ার পরও গাজায় ইসরায়েলি হামলায় এখন পর্যন্ত অন্তত ২৮ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। গাজা সিটির জেইতুন এলাকায় সবচেয়ে ভয়াবহ হামলায় একই পরিবারের ১১ জন সদস্য নিহত হন। ইসরায়েলি সেনাবাহিনী দাবি করেছে, ওই পরিবারের গাড়িটি তাদের নিয়ন্ত্রণাধীন এলাকায় প্রবেশ করেছিল। হামাস এই হামলাগুলোকে যুদ্ধবিরতির স্পষ্ট লঙ্ঘন বলে আখ্যা দিয়েছে এবং যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যান্য মধ্যস্থতাকারীদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে যাতে তারা ইসরায়েলের ওপর চাপ সৃষ্টি করে চুক্তি মেনে চলতে বাধ্য করে। হামাস এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, ইসরায়েলের অব্যাহত হামলা যুদ্ধবিরতির বিশ্বাসযোগ্যতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে। মধ্যস্থতাকারীরা যদি নীরব থাকে, তবে এটি আরও রক্তপাতের পথ খুলে দেবে। হামাস জানিয়েছে, তারা রেড ক্রসের মাধ্যমে এক নিহত ইসরায়েলি বন্দির মরদেহ ফেরত দিয়েছে। এদিকে, গাজার মানবিক পরিস্থিতি এখনও অত্যন্ত ভয়াবহ। জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর আহ্বান সত্ত্বেও বড় পরিসরে ত্রাণ সরবরাহ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে ইসরায়েলের আরোপিত বিধিনিষেধের কারণে। ফলে স্থানীয় মানুষ এখনো খাবার, পানি ও চিকিৎসা সংকটে ভুগছে। ২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে শুরু হওয়া ইসরায়েল-গাজা যুদ্ধে এ পর্যন্ত অন্তত ৬৭ হাজার ৯৬৭ ফিলিস্তিনি নিহত এবং ১ লাখ ৭০ হাজার ১৭৯ জন আহত হয়েছেন বলে গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে। নতুন করে এই হামলাগুলোর ফলে যুদ্ধবিরতির ভবিষ্যৎ নিয়ে আন্তর্জাতিক মহলে উদ্বেগ বেড়েছে এবং পর্যবেক্ষকরা আশঙ্কা করছেন, সংঘাত পুনরায় তীব্র রূপ নিতে পারে যদি ইসরায়েলি অভিযান বন্ধ না হয়।

ইসরায়েলের বিরুদ্ধে নিহত ফিলিস্তিনিদের দেহ থেকে অঙ্গ চুরির অভিযোগ : ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে নিহত ফিলিস্তিনিদের দেহ থেকে অঙ্গ চুরির ভয়াবহ অভিযোগ এনেছে গাজা কর্তৃপক্ষ। এ ঘটনায় তারা আন্তর্জাতিক তদন্তের আহ্বান জানিয়েছে। গত শুক্রবার গাজার সরকারি গণমাধ্যম দপ্তরের পরিচালক ইসমাইল থাওয়াবতা জানান, গত তিন দিনে আন্তর্জাতিক রেড ক্রস কমিটির মাধ্যমে ইসরায়েল ১২০টি লাশ ফেরত দিয়েছে। তিনি বলেন, এসব দেহের অধিকাংশই ভয়াবহ অবস্থায় ছিল। নির্যাতন ও গুলি করে এবং পরিকল্পিতভাবে হত্যার স্পষ্ট প্রমাণ দেখা গেছে। থাওয়াবতা আরও বলেন, অনেক লাশের চোখ, কর্নিয়া ও অন্যান্য অঙ্গ অনুপস্থিত। কেউ কেউ হাত-পা বাঁধা অবস্থায়, চোখ বেঁধে রাখা অবস্থায় ফেরত এসেছে। কারও গলায় দড়ির দাগ, কারও শরীরে শ্বাসরোধের চিহ্ন এসবই ইঙ্গিত দেয় ইসরায়েলি সেনারা তাদের হত্যা করেছে এবং অঙ্গ চুরি করেছে। থাওয়াবতা এই পরিস্থিতিকে ‘অসভ্য ও নিষ্ঠুর অপরাধ’ বলে অভিহিত করেছেন এবং আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলোর প্রতি অবিলম্বে একটি তদন্ত কমিটি গঠনের আহ্বান জানিয়েছেন, যেন ইসরায়েলকে জবাবদিহির মুখে ফেলা যায়। তুরস্কের সংবাদমাধ্যম টিআরটি জানিয়েছে, ইসরায়েলি সেনাবাহিনী এখনও এসব অভিযোগের কোনো আনুষ্ঠানিক জবাব দেয়নি। ফিলিস্তিনি ন্যাশনাল ক্যাম্পেইনের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে ইসরায়েলের হেফাজতে রয়েছে ৭৩৫ জন ফিলিস্তিনি বন্দির লাশ। তাদের মধ্যে ৬৭টি শিশু। তবে ইসরায়েলি সংবাদমাধ্যম হারেৎজ জানিয়েছে, দক্ষিণ ইসরায়েলের নেগেভ মরুভূমির সডে তেইমান সামরিক ঘাঁটিতে গাজার প্রায় দেড় হাজার ফিলিস্তিনির দেহ সংরক্ষিত রয়েছে। এদিকে সম্প্রতি এক যুদ্ধবিরতি চুক্তির অধীনে হামাস ২০ জন জীবিত ইসরায়েলি বন্দিকে মুক্তি দিয়েছে এবং ১০ জনের লাশ ফেরত দিয়েছে, যার বিনিময়ে প্রায় দুই হাজার ফিলিস্তিনি বন্দিকে মুক্তি দিয়েছে ইসরায়েল।

গাজায় স্থায়ী শান্তির জন্য কাজ করছে তুরস্ক, জানালেন এরদোগান : তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোগান বলেছেন, গাজা এখন জরুরি ভিত্তিতে পুনর্গঠন ও পুনরুদ্ধার প্রয়োজন। সেইসঙ্গে হামাস ও ইসরায়েলের চুক্তি যেন স্থায়ী শান্তির ভিত্তি স্থাপন করে সে জন্য তুরস্ক সক্রিয়ভাবে কাজ করছে বলেও জানান তিনি। খবর সংবাদ সংস্থা মেহেরের। গত শুক্রবার ইস্তাম্বুলে আয়োজিত ৫ম তুরস্ক-আফ্রিকা ব্যবসা ও অর্থনৈতিক ফোরামে বক্তৃতা দেওয়ার সময় এসব কথা বলেন এরদোগান। তিনি বলেন, ‘ইসরায়েলের অতীত আচরণের কারণে আমরা সতর্ক রয়েছি, কারণ গাজার এখন দ্রুত পুনর্গঠন প্রয়োজন।’ তিনি আরও বলেন, ‘তুরস্ক হামাস-ইসরায়েল চুক্তি স্থায়ী করার এবং এটি যেন দীর্ঘস্থায়ী শান্তির পথ নিশ্চিত করতে নিরলস প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।’ এছাড়া চলমান সুদান সংকট নিয়ে এরদোগান বলেন, তুরস্ক সুদানের সংঘর্ষে গভীরভাবে মর্মাহত এবং দেশটিতে যুদ্ধবিরতি ও স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠার আশা করছে। তিনি জোর দিয়ে বলেন, ‘আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় সুদানের মানবিক বিপর্যয়ের প্রতি যথেষ্ট মনোযোগ দেয়নি যদিও রক্তপাত বন্ধ করা সবার মানবিক দায়িত্ব।’ তুর্কি প্রেসিডেন্ট আরও বলেন, ‘দুঃখজনকভাবে, পশ্চিমা বিশ্ব আফ্রিকার গৃহযুদ্ধ, সংঘাত ও বিরোধগুলোকে মহাদেশটির নিয়তি হিসেবে দেখছে।’

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত