
বঙ্গোপসাগরে আট বর্গকিলোমিটার আয়তনের দেশের একমাত্র প্রবালসমৃদ্ধ দ্বীপ কক্সবাজারের সেন্টমার্টিন। দেশি-বিদেশি পর্যটকদের কাছে আকর্ষণীয় এই দ্বীপের মানুষ দুই দশক আগেও জড়িত ছিলেন মাছ শিকার ও কৃষিকাজে এক-দেড় যুগের মধ্যে পর্যটকদের আনাগোনায় রাতারাতি বদলে যায় দ্বীপের মানুষের হালচাল। অনেকের পেশা হয়ে উঠে পর্যটননির্ভর। দেশের বিত্তশালীরাও জমি কিনে সেখানে হোটেল-রিসোর্ট ও কটেজ বানাতে ঝাঁপিয়ে পড়েন। প্রসার গড়ে পর্যটকনির্ভর নানা ধরনের ব্যবসা-বাণিজ্যের।
পর্যটনকে ঘিরে পরিবর্তনের এই ছোঁয়া লাগে দ্বীপের মানুষের শিক্ষা-দীক্ষা ও জীবনযাপনে। মৎস্যজীবী থেকে অনেকে হয়ে ওঠেন পর্যটন ব্যবসায়ী। কিন্তু আদি পেশা হারানো দ্বীপের সহজ-সরল মানুষগুলোর পর্যটননির্ভর এই অর্থনীতি বেশিদিন টিকেনি। গত দুই বছর ধরে ছেদ পড়া এই অর্থনীতি এ বছর মুখ থুবড়ে পড়েছে। এখন পর্যটকশূন্য সেন্টমার্টিনে চলছে সুনসান নিরবতা। হোটেল-রিসোর্ট, কটেজ, রেস্তোরাঁসহ পর্যটকনির্ভর সব ধরনের ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ হয়ে গেছে। জীবিকা হারিয়ে দ্বীপের অধিকাংশ মানুষ অভাব-অনটনে দিন কাটাচ্ছেন।
দীর্ঘদিন ধরে অনিয়ন্ত্রিত পর্যটনের কারণে সেন্টমার্টিনের পরিবেশ-প্রতিবেশ সংকটের মুখে পড়ায় ২০২৩ সাল থেকে সরকার দ্বীপে পর্যটক যাতায়াত নিয়ন্ত্রণের সিদ্ধান্ত নেয়। চলতি বছরের ১ ফেব্রুয়ারি থেকে পুরোপুরি পর্যটক যাতায়াতে সরকার নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। এর আগে ডিসেম্বর ও জানুয়ারি মাসে শুধু দৈনিক দেড় হাজার পর্যটক যাওয়া ও রাতযাপনের অনুমতি দেয় পরিবেশ, বন ও জলাবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়। এখন দ্বীপে কেউ গবেষণা কিংবা আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে গেলে উপজেলা প্রশাসনের অনুমতি নিয়ে যেতে হয়। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রতিবেশ সংকটাপন্ন সেন্ট মার্টিনের পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য পুনরুদ্ধারে এরইমধ্যে নানা পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি কর্মহীন মানুষের কর্মসংস্থানের উদ্যোগ নিচ্ছে সরকার।
প্রস্তুত ৭ জাহাজ, ১ ডিসেম্বর থেকে সেন্টমার্টিনে যাবে জাহাজ : দেশের একমাত্র প্রবাল দ্বীপ সেন্টমার্টিনে ১ ডিসেম্বর থেকে জাহাজ চলাচল শুরু হচ্ছে। এর জন্য ৭টি জাহাজ প্রস্তুত রয়েছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। সেন্টমার্টিন রুটের পর্যটকবাহী জাহাজ মালিকদের সংগঠন ‘সি ক্রুজ অপারেটর ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ’-এর সাধারণ সম্পাদক হোসাইন ইসলাম বাহাদুর বলছেন, ডিসেম্বর ও জানুয়ারি এই দুই মাস কক্সবাজার শহরের নুনিয়ারছড়াস্থ বিআইডব্লিউটিএ-এর ঘাট থেকে সেন্টমার্টিনে পর্যটক নিয়ে ৭ জাহাজ চলাচল করবে। তবে ১ ডিসেম্বর কয়টি জাহাজ চলবে তা নির্ভর করছে পর্যটকের উপর।
ঘাটে প্রস্তুত থাকা জাহাজগুলো হলো- কর্ণফুলী এক্সপ্রেস, বার আউলিয়া, এমভি বে ক্রুজ, এমভি কাজল, কেয়ারী সিন্দাবাদ, কেয়ারী ক্রুজ এন্ড ডাইন ও আটলান্টিক ক্রুজ। হোসাইন ইসলাম বাহাদুর জানান, ৭টি জাহাজের অনুমোদন এখনও শতভাগ নিশ্চিত হয়নি। তবে আগামী ১০ দিনের মধ্যে যা শেষ হবে। ১ ডিসেম্বর থেকে চলাচলের জন্য সকল প্রস্তুতি শেষ। সরকারি বিধিনিষেধের আলোকে ৯ মাস বন্ধ থাকার পর ১ নভেম্বর থেকে উন্মুক্ত হয় সেন্টমার্টিন। কথা ছিল ১ নভেম্বর থেকে সেন্টমার্টিন রুটে পর্যটকবাহী জাহাজ চলাচল শুরু হবে। কিন্তু তা সম্ভব হয়নি শর্তের কারণে।
‘সি ক্রুজ অপারেটর ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ’-এর সাধারণ সম্পাদক হোসাইন ইসলাম বাহাদুর জানিয়েছেন, সরকারি সিদ্ধান্তের শর্ত মতে নভেম্বরে পর্যটকরা সেন্টমার্টিন গেলেও রাত্রিযাপনের সুযোগ নেই। দিনে গিয়ে দিনে তাদের ফিরতে হবে কক্সবাজার। কক্সবাজার শহরের নুনিয়ারছড়াস্থ ঘাট থেকে পর্যটনবাহী জাহাজ সেন্টমার্টিন দ্বীপের জেটি ঘাটে পৌঁছতে সময় লাগে ৭ থেকে সাড়ে ৭ ঘণ্টা। ফলে দিনে গিয়ে দিনে ফিরতে জাহাজে সমুদ্র যাত্রায় সময় প্রয়োজন ১৪ থেকে ১৫ ঘণ্টা। জোয়ার-ভাটা এবং আসা-যাওয়ার জন্য নিরাপত্তার ক্ষেত্রে সেন্টমার্টিনে পৌঁছে জাহাজ অপেক্ষা করতে পারবে এক ঘণ্টা। ফলে ১৫ ঘণ্টার সমুদ্রযাত্রা শেষে ১ ঘণ্টার দ্বীপভ্রমণে ইচ্ছুক নন পর্যটকদের বেশি ভাগই। তাই যাত্রীর সংখ্যা বিবেচনায় জাহাজ চলা সম্ভব হয়নি।
হোসাইন ইসলাম বাহাদুর বলেন, ডিসেম্বর ও জানুয়ারি দ্বীপে রাত্রিযাপনের সুযোগ থাকায় জাহাজ চলাচলের জন্য প্রস্তুত রয়েছি। সরকারি সিদ্ধান্ত মতে বঙ্গোপসাগরের বুকে আট বর্গকিলোমিটার আয়তনের প্রবালসমৃদ্ধ দ্বীপ সেন্টমার্টিনে গত ১ ফেব্রুয়ারি থেকে পর্যটকদের যাতায়াত বন্ধ রয়েছে। নভেম্বর থেকে জানুয়ারি পর্যন্ত তিন মাস দ্বীপটিতে ভ্রমণের সুযোগ পাবেন পর্যটকরা। প্রতিদিন সর্বোচ্চ দুই হাজার পর্যটক সেন্টমার্টিনে যাওয়ার সুযোগ পাবেন। তবে পর্যটকদের মানতে হবে সরকারের ১২টি নির্দেশনা। সরকারি প্রজ্ঞাপন মতে, নভেম্বরে পর্যটকরা শুধু দিনের বেলায় দ্বীপটি ভ্রমণ করতে পারবেন। রাতযাপন করতে পারবেন না। ডিসেম্বর ও জানুয়ারি দুই মাস রাতযাপনের সুযোগ থাকবে।
এ ছাড়া পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের ১২টি নির্দেশনার মধ্যে রয়েছে বিআইডব্লিউটিএ এবং মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন ছাড়া সেন্টমার্টিন দ্বীপে কোনো নৌযান চলাচলের অনুমতি পাবে না। পর্যটকদের অবশ্যই বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ডের স্বীকৃত ওয়েব পোর্টালের মাধ্যমে অনলাইনে টিকিট কিনতে হবে। সেখানে প্রতিটি টিকিটে ট্রাভেল পাস এবং কিউআর কোড সংযুক্ত থাকবে। কিউআর কোড ছাড়া টিকিট নকল হিসেবে গণ্য হবে।
তথ্য অনুযায়ী, আগামী জানুয়ারি মাস পর্যন্ত সেন্টমার্টিন দ্বীপে যেতে পারবেন পর্যটকরা। আগামী বছরের ১ ফেব্রুয়ারি থেকে আবার ৯ মাসের জন্য দ্বীপে পর্যটক যাতায়াত সম্পূর্ণভাবে বন্ধ থাকবে। দ্বীপে ভ্রমণের সময়সূচি এবং পর্যটক উপস্থিতিও এবার কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রিত থাকবে। ফেব্রুয়ারি মাসে দ্বীপে পর্যটক যাতায়াত সম্পূর্ণভাবে বন্ধ থাকবে। প্রতিদিন গড়ে দুই হাজারের বেশি পর্যটক ভ্রমণ করতে পারবেন না। পর্যটকদের ভ্রমণকালে রাতে সৈকতে আলো জ্বালানো, শব্দ সৃষ্টি বা বারবিকিউ পার্টি নিষিদ্ধ করা হয়েছে। কেয়াবনে প্রবেশ, কেয়া ফল সংগ্রহ বা ক্রয়-বিক্রয়, সামুদ্রিক কাছিম, পাখি, প্রবাল, রাজকাঁকড়া, শামুক-ঝিনুক ও অন্যান্য জীববৈচিত্র্যের ক্ষতি করা কঠোরভাবে নিষেধ। সৈকতে মোটরসাইকেল, সি-বাইকসহ যেকোনো মোটরচালিত যানবাহন চলাচল সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ থাকবে।
ভ্রমণকালে নিষিদ্ধ পলিথিন বহন করা যাবে না এবং একবার ব্যবহার্য প্লাস্টিক, যেমন চিপসের প্যাকেট, প্লাস্টিক চামচ, স্ট্র, সাবান ও শ্যাম্পুর মিনিপ্যাক, ৫০০ ও ১০০০ মিলিলিটারের প্লাস্টিক বোতল ইত্যাদি বহন নিরুৎসাহিত করা হয়েছে। পর্যটকদের নিজস্ব পানির ফ্লাস্ক সঙ্গে রাখার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।
পর্যটকশূন্য দ্বীপে মানুষের ক্ষোভণ্ডহতাশা : টেকনাফের শাহপরীরদ্বীপ জেটিঘাটের নাফনদীর ওপারে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য। প্রায় দেড় বছর ধরে সেখানে সংঘাত চলছে। এ কারণে টেকনাফ-সেন্টমার্টিন নৌরুটে যান চলাচলেও রয়েছে বিশেষ সতর্কতা। এ ঘাট থেকে নাফনদী মোহনা হয়ে ১৮ কিলোমিটার বঙ্গোপসাগর পাড়ি দিলেই সেন্টমার্টিন।
সম্প্রতি দ্বীপের জেটিঘাটে গিয়েই দেখা যায়, জেটির দুই পাশে সারিবদ্ধ করে নোঙর করে আছে মাছ ধরার ট্রলার ও যাত্রী পরিবহনের নৌযান। ঘাট থেকে কয়েক কদম এগুলেই দ্বীপের জেটিঘাট স্টেশন। দ্বীপের প্রবেশদ্বারের এই স্টেশনে আগন্তুক পর্যটকদের বরণে ট্যুরিস্ট গাইড কিংবা হোটেল কর্মচারীদের আগের সেই জটলা নেই। যানবাহন চলাচলও চোখে পড়ার মতো নয়। সড়কের দুইপাশের অধিকাংশ দোকান-পাট, রেস্তোরাঁ, হোটেল-রিসোর্ট ও পর্যটকনির্ভর ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে তালা ঝুলছে। স্থানীয় লোকজনেরও তেমন একটা আনাগোনা নেই। সবখানেই সুনসান নিরবতা। স্টেশনজুড়ে খাদ্যের খুঁজে দলবদ্ধ হয়ে শুধু ঘুরছে কুকুরের দল। হাতেগোনা যে কয়টি দোকান খোলা আছে, তাতে উঠতি বয়সের কিশোর-যুবকরা কেরাম বোর্ড ও মোবাইলে গেম খেলায় সময় পার করছে।
দ্বীপ ঘুরে ও স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, পর্যটকদের ভ্রমণে কড়াকড়ি আরোপের কারণে দ্বীপে জীবনযাত্রা অচল হয়ে পড়েছে। জীবিকা সংকটে পড়ে লোকজন চরম অভাব-অনটনে পড়েছেন। দ্বীপে এ রকম সংকট আগে তেমন একটা দেখেননি বলে জানান সেন্টমার্টিনের কোনারপাড়ার বাসিন্দা তৈয়ব উল্লাহ (৫৫)। তিনি বলেন, পর্যটন বন্ধের পাশাপাশি এখন সাগরে মাছ ধরার ওপরও ৫৮ দিনের নিষেধাজ্ঞা চলছে। কোনো মানুষের হাতে কাজ নেই। কেউ এক বেলা খেতে পারলে আরেক বেলা খাবার জুটছে না।
সেন্টমার্টিন দ্বীপের স্থানীয় বাসিন্দা ১০ হাজারের মতো। সরকারি-বেসরকারি চাকরিজীবী ও ব্যবসা-বাণিজ্যের সুবাদে আরও প্রায় এক হাজার মানুষের বসবাস। পর্যটন মৌসুমে পাঁচ মাস ব্যবসা করে দ্বীপের বাসিন্দাদের বড় অংশ পুরো বছরের সংসার চালান। ৪০ বছরেরও বেশি সময় মধ্যপ্রাচ্যেরে বিভিন্ন দেশ ঘুর এক যুগ আগে দেশে ফিরেছেন দক্ষিণপাড়ার বাসিন্দা আবদুল করিম (৭৫)। এখনও সাগরে মাছ ধরে তিনি সংসারে খরচ জোগান। তিনি বলেন, দ্বীপের মানুষের এক সময় ঘরে ঘরে হালচাষ ও গবাদিপশু ছিল। কিন্তু কয়েক বছর ধরে পর্যটন ব্যবসায় ঝুঁকেছে মানুষ। বেশিরভাগ স্থানীয় বাসিন্দা বিত্তশালীদের কাছে হোটেল-রিসোর্ট করার জন্য জমি বিক্রি করে দিয়েছে। ফলে কৃষিজমিও কমে গেছে। সাগরে আগের মতো মাছও পাওয়া যাচ্ছে না। এর ফলে দ্বীপের বাসিন্দাদের হাতে কাজ নেই বললেই চলে।
স্থানীয় পর্যটন ব্যবসায়ী আজিজুল হক বলেন, ১ ফেব্রুয়ারি থেকে দ্বীপের ২৪০টি হোটেল-রিসোর্ট ও কটেজ, দুই শতাধিক রেস্তোরাঁ ও পর্যটকনির্ভর ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রয়েছে। দ্বীপে পর্যটন ব্যবসায় জড়িত বিনিয়োগকারীরাও বিপাকে পড়েছেন। তারা দ্বীপে এসে ব্যবসা-বাণিজ্য কী অবস্থায় আছে তা দেখতে আসারও সুযোগ পাচ্ছেন না। দ্বীপের মাঝের পাড়ার বাসিন্দা মদিনা বেগম (৬০)। তিনি মেয়ে ও দুই ছেলে। মেয়েদের বিয়ে দিয়েছেন। দুই ছেলে পড়ালেখা করছে। বড় ছেলে টেকনাফ ডিগ্রি কলেজের স্নাতক শ্রেণিতে পড়ছেন। অর্থের অভাবে ছেলের পড়ালেখা বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছে বলে জানান মদিনা বেগম।
স্থানীয় আবদুল্লাহ (২৫) নামের এক যুবক বলেন, দ্বীপের অনেক শিক্ষার্থী এখন টাকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যেতে পারছেন না।
সেন্টমার্টিন ইউনিয়ন পরিষদের ২ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক সদস্য হাবিবুর রহমান জানান, হোটেল-রেস্তোরাঁ ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে প্রায় দেড় হাজার কর্মচারী কাজ করতেন। সবাই এখন বেকার। পর্যটকশূন্যতার কারণে প্রায় ৪০০ অটোরিকশা চালকও কর্মহীন হয়ে পড়েছেন। অনেকেই গরু-ছাগল ও স্বর্ণ বিক্রি এবং ধারকর্জ করে সংসার চালাচ্ছেন। দুই মাস ব্যবসা করে কীভাবে পুরো বছর সংসার চলবে- এ প্রশ্ন তুলে হাবিবুর রহমান বলেন, ‘আগামী পর্যটন মৌসুম শুরুর আগে সরকারের এ বিষয়ে পদক্ষেপ নেওয়া দরকার। দ্বীপের পরিবেশ যেমন বাঁচানো দরকার, তেমনি মানুষও বাঁচানো দরকার।
কক্সবাজার নাগরিক ফোরামের সভাপতি আ ন ম হেলাল উদ্দিন বলেন, ‘সেন্ট মার্টিনের পরিবেশ-প্রতিবেশ রক্ষায় যে কড়াকড়ি আরোপ হয়েছে, তাতে মানুষের মৌলিক অধিকার খর্ব হচ্ছে। পাশাপাশি দ্বীপের মানুষের বিকল্প আয়ের ব্যবস্থা করা হয়নি।
নিষেধাজ্ঞা কেন : ১৯৯৯ সালে সেন্ট মার্টিন দ্বীপকে পরিবেশ অধিদপ্তর প্রতিবেশ-সংকটাপন্ন এলাকা ঘোষণা করেছিল। নারিকেল জিঞ্জিরা হিসেবে পরিচিত এই দ্বীপে ১৫৩ প্রজাতির সামুদ্রিক শৈবাল, ১৫৭ প্রজাতির স্থলজ ও গুপ্তবীজী উদ্ভিদ রয়েছে। এখানে ৬৬ প্রজাতির প্রবাল, ১৫৭ প্রজাতির শামুক ঝিনুক ও ২৪০ প্রজাতির মাছ, চার প্রজাতির উভচর ও ২৯ প্রজাতির সরীসৃপ প্রাণীর অস্থিত্ব আছে। দ্বীপে বিচরণ রয়েছে ৬৭ প্রজাতির স্থানীয় পাখি ও ৫৩ প্রজাতির অতিথি পাখিসহ ১৯ প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণী। সংকটাপন্ন এই দ্বীপে দুই দশক ধরে অপরিকল্পিত পর্যটনের কারণে ধ্বংস হয়েছে প্রাকৃতিক পরিবেশ। হুমকির মুখে পড়ে জীববৈচিত্র্য। দ্বীপকে বড় বির্যয়ের মুখে পেলে প্লাস্টিক বর্জ্যরে দূষণ। বিভিন্ন সময়ে দ্বীপের পরিবেশ-প্রতিবেশ রক্ষায় নানা উদ্যোগ নেওয়ার কথা বলা হলেও পর্যটন ব্যবসায়ীরা তা আমলে নেননি।
সর্ববেশ, ২০২৩ সালের ৪ জানুয়ারি বন্যপ্রাণী (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইন অনুযায়ী, সেন্টমার্টিন দ্বীপসংলগ্ন বঙ্গোপসাগরের ১ হাজার ৭৪৩ বর্গকিলোমিটার এলাকাকে সামুদ্রিক সংরক্ষিত এলাকা হিসেবে ঘোষণা করে পরিবেশ মন্ত্রণালয়। এই ঘোষণার পর দ্বীপে রাতারাতি শতাধিক হোটেল-রির্সোট ও কটেজ তৈরি করেছেন ব্যবসায়ীরা।
পরিবেশ অধিদপ্তর কক্সবাজার কার্যালয়ের পরিদর্শক মো. মুসাইব ইবনে রহমান আজকের পত্রিকাকে বলেন, পরিবেশ অধিদপ্তরের অনুমোদন না নিয়ে স্থাপনা নির্মাণের দায়ে দ্বীপের ১৬৫টি হোটেল-রির্সোট ও কটেজকে নোটিশ দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে সাবেক সংসদ সদস্য আবদুর রহমান বদিসহ কয়েকজনের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে।
পরিবেশ পুনরুদ্ধারে কী হচ্ছে- এখন সেন্টমার্টিনে সেন্টমার্টিন থেকে ছেঁড়া দ্বীপে যেতে পড়ে কোস্ট গার্ড স্টেশন। এ স্টেশনের পাশেই সৈকতে মাথা উঁচু করছে কেয়া বন। পাশের বালুচরে ডানা মেলছে সাগরলতা। আশপাশের বালিয়াড়িতে চোখে পড়েনি প্লাস্টিকপণ্য। কোস্ট গার্ড ও বিজিবি কার্যালয়ের পাশেই প্লাস্টিকের বোতলের পরিবর্তে বিকল্প উপায়ে সুপেয় পানি সরবরাহের জন্য একটি প্রকল্পের কাজ চলছে। এই প্রকল্পের কাজ শেষ হলে সহজেই সুপেয় পানি পাবেন দ্বীপের বাসিন্দারা। এ ছাড়া ভ্রমণে যাওয়া পর্যটকদেরও এখান থেকে পানি সরবরাহ করা হবে। আগামী জুলাই মাসে এ প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার কথা রয়েছে। এ ছাড়া দ্বীপের মাঝেরপাড়ায় তৈরি করা হচ্ছে বর্জ্য শোধনাগারের আরেকটি প্রকল্প। এখানে বর্জ্য থেকে বিদ্যুৎ ও জৈবসার উৎপাদন হবে।
বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে বিশেষ এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর। দুই প্রকল্পে ৩৫ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে বলে জানান জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর কক্সবাজারের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. ইবনে মায়াজ প্রমাণিক। তিনি বলেন, এই প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে সেন্টমার্টিনের জীববৈচিত্র্য ও পরিবেশ-প্রতিবেশের সুরক্ষার পাশাপাশি সুপেয় পানির সংকট দূর হবে। এ ছাড়া দ্বীপে মানববর্জ্য, কঠিন বর্জ্য ও প্লাস্টিক বর্জ্য নিয়েই সমন্বিত বর্জ্য ব্যবস্থাপনার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে জানান তিনি। এ দিকে দ্বীপে সামুদ্রিক কচ্ছপসহ বিভিন্ন প্রাণী কুকুরের আক্রমণের শিকার হয়। দ্বীপের জীববৈচিত্র্য রক্ষায় পরিবেশ মন্ত্রলালয় কুকুর বন্ধ্যাকরণের উদ্যোগ নেয়। অভয়ারণ্য নামের একটি সংগঠনের মাধ্যমে গত ১০ এপ্রিল থেকে ২৬ এপ্রিল পর্যন্ত ৬০০ কুকুর বন্ধ্যাকরণ করা হয়েছে। পর্যায়েক্রম দ্বীপে বিচরণ করা অন্তত ৩ হাজার কুকুরকে এ প্রকল্পের আওতায় বন্ধ্যাকরণ করার পরিকল্পনা রয়েছে। এ ছাড়া দ্বীপে পরিবেশ পুনরুদ্ধারে জেলা প্রশাসন, কোস্ট গার্ড, পরিবেশ অধিদপ্তর ও বেসরকারি সংস্থা সচেতনতা বাড়ানো ও বনায়নের উদ্যোগ নিয়েছে। দ্বীপের স্থানীয় বাসিন্দাদের বিকল্প কর্মসংস্থান নির্ধারণ ও বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিয়েছে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়। গত ২২ এপ্রিল পরিবেশ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ড. মো: কামরুজ্জামানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় ১৩ ধরনের কার্যক্রম হাতে নেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়।