
অন্তর্বর্তী সরকারের ১১তম গ্রেড দেওয়ার আশ্বাসে গত ১২ নভেম্বর থেকে ক্লাসে ফেরেন শিক্ষকরা। তবে সেই প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে সরকারের দৃশ্যমান কোনো পদক্ষেপ না থাকায় হতাশ প্রাথমিকের প্রায় সাড়ে তিন লাখ সহকারী শিক্ষক। দাবি আদায়ে তারা চলতি মাসের শেষদিকে আবারও আন্দোলনে নামার চিন্তাভাবনা করছেন। এবার তাদের কর্মসূচি হতে পারে ‘নো টেনথ গ্রেড, নো ওয়ার্ক’। অর্থাৎ দশম গ্রেড না দিলে তারা ক্লাসে বা কোনো ধরনের শিক্ষা কার্যক্রমে অংশ নেবেন না। এতে আগামী ৮ ডিসেম্বর থেকে সাড়ে ৬৫ হাজারের বেশি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শুরু হতে যাওয়া বার্ষিক পরীক্ষা নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে। প্রাথমিকের সহকারী শিক্ষকরা দশম গ্রেডসহ তিন দফা দাবি আদায়ে যে আন্দোলন করছেন, তা মূলত কয়েকটি শিক্ষক সংগঠনের মোর্চা ‘প্রাথমিক শিক্ষক দাবি বাস্তবায়ন পরিষদ’ ব্যানারে। এর আগে দশম গ্রেডে বেতন-ভাতা দেওয়াসহ তিন দফা দাবিতে চলতি মাসে ঢাকায় টানা তিনদিন অবস্থান করেন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের কয়েক হাজার শিক্ষক। একই সময়ে দেশের সাড়ে ৬৫ হাজার বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা কর্মবিরতি পালন করেন। এতে প্রায় এক কোটি কোমলমতি শিশুশিক্ষার্থীর ক্লাস বন্ধ হয়ে যায়।
সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষকদের ৩ দফা দাবিগুলো হলো-দশম গ্রেডে বেতন নির্ধারণ, ১০ বছর ও ১৬ বছরপূর্তিতে উচ্চতর গ্রেড সমস্যার সমাধান ও শতভাগ বিভাগীয় পদোন্নতি।
গত বুধবার এ পরিষদের অন্যতম নেতা মোহাম্মদ শামছুদ্দিন মাসুদ বলেন, ‘গত ১১ নভেম্বর অর্থ মন্ত্রণালয় আমাদের আশ্বস্ত করেছিল। তবে তা নিয়ে শিক্ষকরা সন্তুষ্ট নন। তিনি জানান, ২১ নভেম্বর (আজ শুক্রবার) জাতীয় প্রেস ক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করে পরবর্তী কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে।’ কী ধরনের কর্মসূচি আসতে পারে-এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘এটা নিয়ে আলোচনা চলছে। পাশাপাশি সরকার আমাদের দাবি পূরণে কী পদক্ষেপ নিয়েছে, তা সচিবালয় থেকে জেনে পরবর্তী কর্মসূচি ঠিক করা হবে। এখনই কর্মসূচির বিষয়ে বলা সম্ভব হচ্ছে না।’
তবে প্রাথমিকের এ শিক্ষক নেতা শামছুদ্দিন মাসুদ তার ব্যক্তিগত ফেসবুক আইডিতে গত বুধবার বিকেলে একটি পোস্ট দিয়েছেন। সেখানে তিনি লেখেন, ‘নো গ্রেড, নো ওয়ার্ক’; ‘নো প্রোমোশন, নো ওয়ার্ক’; ‘নো প্রবলেম সলভ, নো ওয়ার্ক’।’ অর্থাৎ, বেতন-ভাতার গ্রেড উন্নীত করা, শতভাগ পদোন্নতি এবং আন্দোলনে আহত শিক্ষকদের চিকিৎসাসহ সব সমস্যার সমাধান না করা পর্যন্ত তারা কোনো কাজ (ক্লাস-পরীক্ষা) করবেন না।
এদিকে, প্রাথমিক শিক্ষক দাবি বাস্তবায়ন পরিষদের আরেকজন আহ্বায়ক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘গত ১১ নভেম্বর প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় যে প্রেস বিজ্ঞপ্তি দিয়েছিল, সেটার আলোকে আমরা দ্রুত প্রজ্ঞাপন চাইবো। এক্ষেত্রে সময়সীমা বেঁধে দেওয়া হতে পারে। ওই সময়সীমার মধ্যে দাবি পূরণ না করলে নভেম্বরের শেষ সপ্তাহ থেকে আবার কর্মবিরতি বা শ্রেণিকক্ষে তালা ঝুলিয়ে দেওয়ার মতো কর্মসূচির ঘোষণা আসতে পারে। শিক্ষকরা কতটা কঠোর কর্মসূচিতে যাবেন, তা নির্ভর করছে সরকারের অবহেলা বা আন্তরিকতার ওপর।’
এদিকে, সহকারী শিক্ষকরা দশম গ্রেডের দাবি জানালেও তা এখন সম্ভব নয় বলে স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়। প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরও বলছে, এখনো প্রাথমিকে এসএসসি-এইচএসসি পাস শিক্ষক রয়েছেন। এছাড়াও নানা বাস্তবতায় দশম গ্রেড দেওয়া সম্ভব নয়।
প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণায়ের সচিব আবু তাহের মো. মাসুদ রানা বলেন, ‘সহকারী শিক্ষকদের ১১তম গ্রেড দেওয়ার সুপারিশ করে আমরা অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগে চিঠি পাঠিয়েছি। গত ১১ নভেম্বর সশরীরে আন্দোলনরত শিক্ষকদের প্রতিনিধিদলের সঙ্গে অর্থ বিভাগের সচিবের বৈঠকও করিয়ে দেওয়া হয়েছে। সেখানে তাদের বর্তমান অবস্থা অবগত করা হয়। শিক্ষকরা সেটা মেনেও নিয়েছেন। বিষয়টির দ্রুতই অগ্রগতি হবে। তার মধ্যেই যদি শিক্ষকরা আবার আন্দোলনে নামেন; পরীক্ষার আগে ক্লাস বর্জন করেন; তাহলে তা হবে অত্যন্ত দুঃখজনক।’ তিনি বলেন, ‘আমরা বিশ্বাস করি, সহকারী শিক্ষকরা আমাদের আন্তরিকতা দেখেছেন। আমাদের দিক থেকে তাদের ১১তম গ্রেডে উন্নীত করার ব্যাপারে সব ধরনের প্রচেষ্টা অব্যাহত আছে। এরপর যা করার তা অর্থ মন্ত্রণালয় করবে। আশা করি শিক্ষকরা আমাদের প্রতিশ্রুতির প্রতি আস্থা রাখবেন।’
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, চলতি বছরের শুরু থেকে বেতন-ভাতা বৃদ্ধিসহ বিভিন্ন দাবি-দাওয়া নিয়ে নানা কর্মসূচি করে আসছেন প্রাথমিকের শিক্ষকরা। মে মাসে টানা কর্মবিরতিও পালন করেন তারা। গত ৫ মে থেকে ১৫ মে পর্যন্ত সারাদেশের সব সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে কর্মদিবসে এক ঘণ্টা করে কর্মবিরতি করেন তারা। এরপর ১৭ মে থেকে দুই ঘণ্টা এবং ২১ মে থেকে ২৫ মে পর্যন্ত আধাবেলা কর্মবিরতি পালন করেন শিক্ষকরা।
২৬ মে থেকে অনির্দিষ্টকালের জন্য কর্মবিরতি শুরু করেন সহকারী শিক্ষকরা। টানা চারদিন কর্মবিরতির পর প্রাথমিক ও গণশিক্ষা উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. বিধান রঞ্জন রায় পোদ্দারের আশ্বাসে ১ জুন থেকে ক্লাসে ফিরে যান তারা। তবে সেই আশ্বাস বাস্তবায়ন হয়নি বলে অভিযোগ শিক্ষকদের।
এরপর একাধিকবার ঢাকায় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে মহাসমাবেশ করে আলটিমেটাম দেন শিক্ষকরা। তাতেও সাড়া না পাওয়ায় গত ৮ নভেম্বর আবারও বড় পরিসরে রাস্তায় নামেন তারা। এ দফায় তিনদিন কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে অবস্থান এবং দুদিন কর্মবিরতি করে সরকারের আশ্বাসে ফিরে গেছেন তারা।