
চুয়াডাঙ্গার জীবননগর উপজেলায় শীত মৌসুম এলেই প্রতিটি গ্রামের নারীরা খাবারে বাড়তি স্বাদ আনতে কুমড়ো বড়ি তৈরিতে ব্যস্ত সময় পার করেন। শীতের শুরুতে কয়েকদিন ধরে উপজেলার প্রতিটি গ্রামে কুমড়ো বড়ি তৈরির যেন ধুম লেগেছে। কুমড়ো বড়ি তৈরির উপযুক্ত সময় শীতকাল। এ সময় গ্রামের নারীদের কর্মব্যস্ততাও বেড়ে যায়। নিত্যদিনের অন্যান্য কাজের পাশাপাশি তারা ভোরে সবার আগে কুমড়ো বড়ি তৈরি করেন। কুমড়ো বড়ি তরকারির একটি মুখরোচক খাদ্য, যা রান্নার স্বাদে যোগ করে নতুন মাত্রা। গতকাল শনিবার উপজেলার হরিহরনগর, বেনিপুর, নতুনগ্রাম, রায়পুর গিয়ে দেখা গেছে, জীবননগর উপজেলার শত শত নারী কুমড়ো বড়ি তৈরির কাজে জড়িত রয়েছেন। শীতের আগমনের সঙ্গে সঙ্গে তাদের ব্যস্ততা আরও বেড়ে যায়। বর্ষাকাল বাদে বাকি মাসগুলোতেও কমবেশি কুমড়ো বড়ি তৈরি করা হয়। বিশেষ করে অগ্রহায়ণ থেকে ফাল্গুন- এই চার মাস থাকে কুমড়ো বড়ি তৈরির ভরা মৌসুম। অনেকে পরিবারের প্রয়োজন মিটিয়ে বাকিটা বাজারে বিক্রি করেন। শীতে কুমড়ো বড়ির চাহিদা থাকে বেশি। তাই গ্রামাঞ্চলের নারীরা বাড়তি আয় করার লক্ষ্যে কুমড়ো বড়ি তৈরি করেন।
কুমড়ো বড়ির প্রধান উপকরণ হলো মাসকলাই ডাল ও চালকুমড়া। বাজারে প্রতি কেজি মাসকলাই ১১০-১৩০ টাকা এবং চালকুমড়া ৩০-৪০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। সাইজ অনুযায়ী ১ পিস চালকুমড়া ৭০-১০০ টাকায় পাওয়া যায়। আর পেঁপে প্রতি কেজি ২০ থেকে ২৫ টাকা। ৫ কেজি চালকুমড়া অথবা পেঁপের সঙ্গে ২ কেজি মাসকলাই মিশিয়ে ভালো মানের কুমড়ো বড়ি তৈরি হয়। প্রথমে মাসকলাই রোদে শুকিয়ে যাতায় ভেঙে পরিষ্কার করা হয় অথবা পানিতে ভিজিয়ে খোসা ছাড়ানো হয়। প্রায় ৭৮ ঘণ্টা ভিজিয়ে রাখা প্রয়োজন। এরপর ঢেঁকি বা শিলপাটায় পিষে বড়ির মিশ্রণ তৈরি করা হতো। তবে এখন বিভিন্ন এলাকায় মেশিন স্থাপনের ফলে মাড়াইয়ের কাজ সহজ হয়েছে। মেশিনে মাসকলাই, কুমড়ো ও পেঁপে মিহি করে দ্রুত মিশ্রণ তৈরি করা যায়। বাড়ির আঙিনা, ছাদ বা খোলা জায়গায় সকালে বড়ি তৈরি শুরু হয়। পাতলা কাপড়ে ও লোহার অথবা প্লাস্টিকের নেটের চালনে সারি সারি বড়ি বসিয়ে ৩৪ দিন রোদে শুকানো হয়। সূর্যালোক কম হলে ৪৫ দিন পর্যন্ত সময় লাগে। শুকানো শেষে বড়ি সংরক্ষণ করা হয়। গ্রামের পিছিয়ে পড়া অনেক নারীর ভাগ্য উন্নয়নে বহু বছর ধরে এই কুমড়ো বড়ি তৈরির কাজ বড় অবদান রাখছে। উপজেলার কাঁটাপোল গ্রামের প্রায় ৫০-৬০টি পরিবার ব্যবসায়িকভাবে কুমড়ো বড়ি তৈরি করছে।
ওই গ্রামের নারী রহিমা খাতুন বলেন, আগে কুমড়ো বড়ির ব্যবসা করে সচ্ছল হওয়া সম্ভব ছিল না। এখন অনেকেই এ ব্যবসায় স্বাবলম্বী হয়েছেন। তিনি আরও বলেন, আগে মাসকলাই পরিষ্কার করা আর ঢেঁকিতে বাটা খুব কষ্টসাধ্য ছিল। এখন বাজারে খোসা ছাড়ানো মাসকলাই পাওয়া যায় এবং মেশিনে মাড়াই করায় কাজ সহজ হয়েছে। তিনি জানান, এক কেজি কুমড়ো বড়ি তৈরি করতে প্রায় ১২০ টাকা খরচ হয় এবং বাজারে ২২৫ থেকে ২৭৫ টাকায় বিক্রি করা যায়। এতে পরিবারের প্রয়োজন মিটিয়ে বাড়তি আয় করা সম্ভব হচ্ছে।
জীবননগর উপজেলার হরিহরনগর গ্রামের কুমড়ো বড়ির ব্যবসায়ী রফিকুল ইসলাম বলেন, এখানকার কুমড়ো বড়ি সুস্বাদু হওয়ায় স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে দেশের বিভিন্ন জেলায় বিশেষ করে ঢাকায় পাঠানো হয়। তিনি আরও জানান, সারা বছর কুমড়ো বড়ি তৈরি করা সম্ভব হলেও শীতকালে এর কদর বেশি। কৈ, শিং ও শৈল মাছের সঙ্গে রান্না করলে এর স্বাদ আরও বাড়ে। বড়ি বানানো থেকে শুরু করে সব কাজই বাড়ির নারী সদস্য বা নারী শ্রমিকরা করেন, এবং শ্রমিকদের মজুরিও তুলনামূলক কম। এ বিষয়ে জীবননগর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. আলমগীর হোসেন বলেন, শীত মৌসুমে গ্রামের নারীরা কুমড়ো বড়ি তৈরি করে বাড়তি আয় করছেন। উপযুক্ত প্রশিক্ষণ ও পৃষ্ঠপোষকতা পেলে তারা নিজেদের ভাগ্য উন্নয়ন এবং গ্রামীণ অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারবেন।